জীবদেহের রক্ত, মাংস, মেদ, মজ্জা সকলই জৈব পদার্থ; এমনকি কফ, থুথু, ঘর্ম এবং মল-মূত্রও। ইহাদের স্বাভাবিক ক্ষয়ের পূরণ ও পুষ্টির জন্য জীবের আবশ্যক হয় খাদ্যের। খাদ্য গ্রহণের আসল উদ্দেশ্য হইল কার্বন সংগ্রহ করা। জীবের জীবন সংগ্রামে খাদ্য লইয়া যে কাড়াকাড়ি ও মারামারি, তাহা সমস্তই এই কার্বন সংগ্রহের ঝামেলা।
গাছেরা কার্বন সংগ্রহ করে বাতাস হইতে এবং জীব-জন্তুরা কার্বন সংগ্রহ করে শাক-পাতা, তরি-তরকারি ও জীবজন্তুর মাংস হইতে। সংগৃহীত কার্বন জীবদেহে বিবিধ প্রক্রিয়ার শেষে রূপান্তরিত হয় জৈব পদার্থে। আবার বহুকাল মাটির তলায় চাপা থাকিয়া গাছপালা রূপান্তরিত হয় কয়লায় এবং জীবজন্তুর দেহ রূপান্তরিত হয় খনিজ তৈলে।
এতক্ষণ যাহা বলা হইল, তাহা সবই জৈব পদার্থের ব্যবহার ও রূপান্তর বিষয়ক। এখন প্রশ্ন থাকিল এই যে, জৈব পদার্থের সৃষ্টি হইল কিভাবে? বিজ্ঞানীগণ এ প্রশ্নের উত্তর দিয়াছেন।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ আলোক বিশ্লেষক যন্ত্রের সাহায্যে জানিতে পারিয়াছেন যে, উত্তাপের কম বেশি হিসাবে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর নক্ষত্র আছে। কোনো শ্রেণীর নক্ষত্রের উত্তাপ ২৮,০০০° সে. পর্যন্ত বা আরও বেশি, আবার কোনো শ্রেণীর নক্ষত্রের উত্তাপ মাত্র ৪,০০০° সে. এবং উহার মধ্যবর্তী উত্তাপে আছে অজস্র নক্ষত্র। স্পেক্টোস্কোপ যন্ত্রের সাহায্যে বিভিন্ন নক্ষত্রের উপাদান বিশ্লেষণ। দ্বারা বিজ্ঞানীরা জানিতে পারিয়াছেন যে, খুব বেশি উত্তপ্ত নক্ষত্রদের কার্বন পরমাণুরা একা একা ভাসিয়া বেড়ায়, অন্য কোনো পরমাণুর সাথে জোড় বাঁধে না। কিন্তু যে সকল নক্ষত্রের উত্তাপ ১২,০০০° সেন্টিগ্রেডের কাছাকাছি, সেখানে কার্বন পরমাণু হাইড্রোজেন পরমাণুর সঙ্গে জোড় বাঁধিয়া সৃষ্টি করিয়াছে হাইড্রোকার্বন। এই হাইড্রোকার্বন একটি জৈবিক পদার্থ। সুতরাং দেখা যাইতেছে যে, এইখান হইতেই জৈবিক পদার্থ সৃষ্টির সূত্রপাত।
আমাদের সূর্যের বাহিরের উত্তাপ প্রায় ৬০০০° সে.। সেখানে দেখা যায় যে, কার্বনের সঙ্গে একাধিক মৌলিক পদার্থের পরমাণুর মিলন ঘটিয়াছে। যেমন –কার্বনের সঙ্গে হাইড্রোজেন, কার্বনের সঙ্গে নাইট্রোজেন, এমনকি কার্বনের সঙ্গে কার্বনের। ইহাতে সেখানে একাধিক জৈব পদার্থের জন্ম হইয়াছে।
ভূপতিত উল্কাপিণ্ডের দেহ পরীক্ষা করিয়া বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পাইয়াছেন যে, উল্কার দেহে কার্বন ও ধাতুর মিলনে জন্ম লইয়াছে কার্বাইড। ইহা একটি জৈব পদার্থ।
বিজ্ঞানীরা বলেন যে, নক্ষত্র, সূর্য ও উল্কার দেহে যে প্রক্রিয়ায় জৈব পদার্থ জমিতে পারিয়াছে, পৃথিবীতেও এককালে অনুরূপ প্রক্রিয়ায় জৈব পদার্থসমূহের জন্ম হইয়া থাকিবে। বিজ্ঞানীরা তাহাদের পরীক্ষাগারে কৃত্রিম উপায়ে বহু জৈব পদার্থ তৈয়ার করিতে সক্ষম হইয়াছেন। যথা –শর্করা, প্রোটিন, স্নেহপদার্থ (চর্বি জাতীয়), নীল, ভিটামিন, হর্মোন ইত্যাদি।
বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, প্রোটিন তৈয়ার হয় হাজার হাজার কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন ও ও নাইট্রোজেন পরমাণুর সুবিন্যস্ত সংযোগে এবং পৃথিবীর আদিম সমুদ্রে প্রোটিন তৈয়ার হইবার মতো অনুকূল অবস্থাও বজায় ছিল। পৃথিবীর আদিম সমুদ্রে লক্ষ লক্ষ বৎসর ধরিয়া হাইড্রোকার্বনের নানা রূপান্তরে তৈয়ার হইয়াছিল প্রোটিন এবং তাহা হইতে জন্ম লইয়াছিল। জীবদেহের মূল উপাদান প্রোটোপ্লাজম।
.
# প্রোটোপ্লাজম কি?
প্রকৃতির একমাত্র কাজ — পরিবর্তন বা রূপান্তর। ইহাকে বিবর্তন বলা যায়। বিভিন্ন বিষয়ে প্রাকৃতিক পরিবর্তনে সময়ের ব্যবধান অত্যধিক। প্রকৃতি দুধকে দধি এবং তালের রসকে তাড়ি করিতে কয়েক ঘণ্টা সময়ের মধ্যেই পারে। কিন্তু রেডিয়ামকে শীশায় পরিণত করিতে তাহার সময়। লাগে লক্ষ লক্ষ বৎসর। ঐরূপ কার্বনাদি জৈব পদার্থ হইতে একটি প্রোটোপ্লাজম তৈয়ার করিতে প্রকৃতির সময় লাগিয়াছে প্রায় একশত কোটি বৎসর।
পদার্থ জৈব বা অজৈব, যাহাই হউক, উহা জীব নামে অভিহিত হইতে পারে না, যে পর্যন্ত উহাতে জীবনের কোনো লক্ষণ প্রকাশ না পায়। পূর্বেই বলিয়াছি যে, জীবনের প্রধান লক্ষণ –দেহপুষ্টি ও বংশবিস্তার। কোনো পদার্থে যদি ঐ দুইটি লক্ষণ দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা হইলে নিশ্চয়তার সহিত বলা যায় যে, ঐ পদার্থটি সজীব। এখন দেখা যাক যে, কোন পদার্থে ঐ লক্ষণ। দুইটি পাওয়া যায়।
প্রোটোপ্লাজমের মুখ্য উপাদান প্রোটিন এবং ইহা ভিন্ন আরও জৈব-অজৈব অনেকগুলি পদার্থ। উহা আদিম সমুদ্রে জলে গোলা দ্রব অবস্থায় ছিল। উহাকে ইংরাজিতে বলে সলিউশন। চিনি বা লবণ গোলা জলকেও সলিউশন বলা যায়। কিন্তু প্রোটোপ্লাজম ঐ ধরণের সলিউশন নহে, উহা এক বিশেষ ধরণের সলিউশন। ইংরাজিতে বলা হয় কলয়ডাল সলিউশন।
চিনি বা লবণ জলে দ্রবীভূত হইলে উহাকে ছাকন প্রণালী দ্বারা জল হইতে ভিন্ন করা যায় না। কিন্তু কলয়ডাল সলিউশন ছাঁকুনিতে আটকা পড়ে। তাই বলিয়া এই আটকা পড়াই ইহার বিশেষত্ব নহে। মাটি বা চুন গোলা জলও সূক্ষ্ম ছাঁকুনি দ্বারা ছাকিলে মাটি ও চুন ভিন্ন হইয়া যায়। কিন্তু ইহা কলয়ডাল সলিউশন নহে। যেহেতু মাটি বা চুন জলে গোলা হইলে সময়ান্তরে উহা থিতাইয়া পড়ে। কিন্তু কলয়ডাল সলিউশন কোনো কালেই থিতায় না। উহা এইরূপ এক বিশেষ পদার্থ যে, জলে সম্পূর্ণ মেশে না, অথচ কোনোকালেই থিতায় না। জানিয়া রাখা উচিত যে, কলয়ডাল সলিউশন জৈব পদার্থের হইতে পারে, আবার অজৈব পদার্থেরও হইতে পারে। অজৈব পদার্থের কলয়ডাল সলিউশন হয়তো জলে সম্পূর্ণ মিশিয়া থাকে, নচেৎ থিতাইয়া পড়ে। কিন্তু জৈব পদার্থের কলয়ডাল সলিউশনই জলে সম্পূর্ণ মেশে না, অথচ থিতাইয়া পড়ে না। এইখানে লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, অজৈব পদার্থের সঙ্গে জৈব পদার্থের একটি চরিত্রগত পার্থক্য প্রকট হইয়া উঠিয়াছে এবং সে এখন হইতে আর জড় পদার্থের নিয়মে অপরের শক্তিতে চালিত হইতে রাজি নহে। তাই কলয়ডাল সলিউশনের এই স্বকীয়তা।