সচরাচর ৬০ মাইল হইতে ৮০ মাইল উপরে উল্কা দেখা যায় এবং ৪০ মাইলের নিচে উল্কা দেখা যায় না। যেগুলি আকারে ছোট, সেগুলি ৪০ মাইলের উপরেই জ্বলিয়া ভস্ম হইয়া যায়, ভূপতিত উদ্ধার সংখ্যা খুবই অল্প।
.
# কৃত্রিম গ্রহ ও উপগ্রহ
প্রকৃতি বা ঈশ্বরের সৃষ্ট গ্রহ-উপগ্রহাদির বিষয় আলোচনা করা হইল। অধুনা আকাশে আরও কতিপয় গ্রহ ও উপগ্রহ বিরাজ করিতেছে, যাহার সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর নহেন, মানুষ। তবে উহারা আকারে নেহায়েত ছোট। কিন্তু উহাদের উভয়ের প্রকৃতি একই। যেমন হস্তী ও পিপীলিকার আকারগত পার্থক্য থাকিলেও উহাদের প্রকৃতি বা জৈবধর্মে কোনো পার্থক্য নাই –ইহা তেমনই।
পূর্বে বলা হইয়াছে যে, পৃথিবীর নিষ্ক্রমণ বেগ ৭ মাইল। অর্থাৎ কোনো পদার্থ যদি প্রতি সেকেণ্ডে সাত মাইল গতিতে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিপরীত দিকে ছুটিতে পারে, তবে পৃথিবী তাহাকে টানিয়া ফিরাইতে পারে না। অর্থাৎ সে আর কখনও মাটিতে পড়ে না। অতঃপর? বিজ্ঞানীগণ কল্পনা করিলেন যে, ঐ পদার্থটি মহাকাশে চলিয়া যাইবে এবং সে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করিতে থাকিবে। অর্থাৎ সে হইবে সূর্যের একটি নূতন বা কৃত্রিম গ্রহ। কিন্তু ঐ পদার্থটির গতি যদি সেকেণ্ডে ৭ মাইল না হইয়া ৫ মাইল হয়, তবে কি হইবে? বিজ্ঞানীরা স্থির করিলেন যে, ঐটি তখন পৃথিবীকে আবর্তন করিতে থাকিবে। অর্থাৎ সে হইবে পৃথিবীর একটি নূতন বা কৃত্রিম উপগ্রহ। এই বিষয়ে গবেষণা চালানো হইলে, উহাতে প্রথমে সাফল্য লাভ করিলেন রাশিয়ান ও পরে আমেরিকান বিজ্ঞানীরা।
.
# কৃত্রিম উপগ্রহ
স্পুটনিক ১
১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর তারিখে স্পুটনিক ১ নামক একটি উপগ্রহ আকাশে প্রথম নিক্ষেপ করেন রাশিয়ার বিজ্ঞানীগণ। এলুমিনিয়ামের সঙ্গে অন্য ধাতুর সংমিশ্রণে ঐটি তৈয়ার হইয়াছিল। আকৃতি গোল, ব্যাস ২৩ ইঞ্চি, ওজন ছিল ১৮৪ পাউণ্ড। প্রতি সেকেণ্ডে ৫ মাইল অর্থাৎ ঘণ্টায় ১৮,০০০ মাইল বেগে চলিয়া ৯৬.২ মিনিটে একবার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করিত শুটনিক ১। কিন্তু উহার এই পৃথিবী প্রদক্ষিণ করা বেশিদিন স্থায়ী হয় নাই। কেননা, স্পুটনিক ১ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাহিরে উহার কক্ষপথ রচনা করিতে পারে নাই। ভূপৃষ্ঠ হইতে প্রায় এক হাজার মাইল পর্যন্ত বায়ুর অস্তিত্ব আছে। কোনো উপগ্রহ ঐ এক হাজার মাইলের উর্ধে স্বীয় কক্ষপথ রচনা করিতে না পারিলে, বায়ুর সংঘর্ষে উহার গতি হ্রাস পাইতে থাকে এবং ক্রমে নিম্নগামী হইয়া বায়ুমণ্ডলের ঘন, স্তরে প্রবেশ করিলে বায়ুর সংঘাতে উহা ভাঙ্গিয়া বা উল্কার ন্যায় জ্বলিয়া-পুড়িয়া ভস্ম হইয়া যায়। বায়ুমণ্ডলের ভিতরে কক্ষপথ থাকায় প্রথম স্পুটনিকের ঐ দশাই হইয়াছিল। বায়ুর সংঘর্ষহেতু ক্রমশ উহার গতিবেগ হ্রাস পাইবার ফলে নিম্নগামী হইয়া ঘন বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করিয়া এক সময় উহা ধংস হইয়া গিয়াছে। প্রথম স্পুটনিক আকাশে ছিল মাত্র ৯৬ দিন।
এক্সপ্লোরার
১৯৫৮ সালের ৩১ জানুয়ারি তারিখে আমেরিকার বিজ্ঞানীরা এই উপগ্রহটি আকাশে নিক্ষেপ করেন। পরিবহন রকেট সহ ইহার ওজন ছিল ৩০.৮ পাউণ্ড। রকেট বাদে এই উপগ্রহটির ওজন ১৮.১৩ পাউণ্ড, ব্যাস ৬ ইঞ্চি এবং রকেট লম্বায় ৬ ফুট ৮ ইঞ্চি। ইস্পাতে নির্মিত খোলের ভিতর রক্ষিত বিবিধ যন্ত্রপাতি। এক্সপ্লোরার একবার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করিতে সময় লয় ১১৪ মিনিট। অর্থাৎ দৈনিক পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে প্রায় বারো বার।
কৃত্রিম গ্রহ-উপগ্রহদের কাহারও কক্ষপথ সম্পূর্ণ গোল নহে। ইহা সৌরাকাশের অন্যান্য গ্রহ উপগ্রহদের মতোই ডিম্বাকার। তাই পৃথিবী প্রদক্ষিণের সময় এক্সপ্লোরার কোনো কোনো সময় ভূপৃষ্ঠের ২২০ মাইলের মধ্যে আসিয়া পড়ে, আবার কোনো কোনো সময় চলিয়া যায় ১,৭০০ মাইল দূরে। আগেই বলা হইয়াছে যে, বায়ুমণ্ডলের গভীরতা প্রায় ১,০০০ মাইল। কাজেই এক্সপ্লোরার কোনো সময় বায়ুমণ্ডলের ভিতরে আসিয়া পড়ে এবং কোনো সময় চলিয়া যায় বাহিরে। সুতরাং উহাকে অনেক সময়ই বায়ুর বাধা ভোগ করিতে হয়। তাই এক্সপ্লোরারও পৃথিবীর আকাশে বেশিদিন থাকিতে পারিবে না। বিজ্ঞানীগণ অনুমান করেন যে, এক্সপ্লোরার উপগ্রহটি আকাশে থাকিয়া পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করিতে থাকিবে ১০ বৎসর। অতঃপর সেও একদিন সম্পূর্ণ বায়ুমণ্ডলে ঢুকিয়া ধংস হইয়া যাইবে।
ভ্যানগার্ড
এই উপগ্রহটিকে আকাশে নিক্ষেপ করা হয় ১৯৫৮ সালের ১৭ মার্চ তারিখে। রকেট বাদে ইহার ওজন মাত্র ৩.৫ পাউণ্ড, আকৃতি বাতাবিলেবুর মতো গোল। কক্ষভ্রমণের সময় ভূপৃষ্ঠ হইতে ইহার দূরত্ব হয় কোনো সময় ৪০০ মাইল এবং কোনো সময় ২৫০০ মাইল। এক্সপ্লোরার উপগ্রহটি যতখানি বায়ুমণ্ডলের ভিতরে আসে, ভ্যানগার্ড ততখানি আসে না, বরং বাহিরেই থাকে বেশি। তাই ইহার গতিবেগ কমিতে এক্সপ্লোরারের চেয়ে সময়ও লাগিবে বেশি। অতঃপর ইহাও ধ্বংস হইবে। তবে আশার কথা এই যে, ভূপৃষ্ঠ হইতে হাজার মাইল উর্ধে কক্ষপথ রচনা করিয়া চিরস্থায়ী উপগ্রহ স্থাপনের চেষ্টা চলিতেছে; হয়তো অচিরেই চেষ্টা সফল হইবে।
.
# কৃত্রিম গ্রহ
লুনিক ১
এই কৃত্রিম গ্রহটি ১৯৫৯ সালের ২ জানুয়ারি তারিখে রাশিয়ার বিজ্ঞানীগণ আকাশে ক্ষেপণ করেন। ইহার ওজন ৩,২৪৫ পাউণ্ড। সূর্য হইতে ইহার গড় দূরত্ব ১০ কোটি ৭৮ লক্ষ মাইল। কিন্তু এই দূরত্ব সব সময় সমান থাকে না। কক্ষপথের বক্রতার দরুন দূরত্ববৃদ্ধি হইয়া কোনো সময় হয় ১২ কোটি ৪৫ লক্ষ মাইল, আবার কমিয়া হয় ৯ কোটি ১১ লক্ষ মাইল। লুনিক সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে ৪৫০ দিনে অর্থাৎ ১৫ মাসে। আমাদের পৃথিবীর বৎসর হইতে লুনিকের বৎসর কিছু বড়। বিজ্ঞানীগণ মনে করেন যে, লুনিক আকাশে থাকিয়া সূর্যকে প্রদক্ষিণ করিতে থাকিবে অনন্তকাল। কেননা সে কখনও বায়ুমণ্ডলের আওতায় পড়ে না।