.
# উল্কা
মেঘমুক্ত রাত্রির আকাশে দেখা যায় যে, হঠাৎ হাউই বাজির মতো একটি আলোর রেখা কিছুদূর যাইয়া মিলাইয়া গেল। সাধারণত ঐগুলিকে লোকে তারাখসা বলে। ছোটবেলায় মা-দিদিমার কাছে ঐসম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিলে তাহারা বলিতেন, “এক জায়গায় থাকিয়া থাকিয়া যখন কোনো তারা অস্বস্তি বোধ করে, তখন সে ঘর বদল করে। চলিবার সময় উহার নাম বলিতে নাই, বলিলে সে যথাসময়ে স্থান পায় না এবং সত্বর স্থান লইতে না পারিয়া হঠাৎ ভূপতিত হইলে মানুষের অমঙ্গল ঘটিতে পারে।”
মা-দিদিমা অথবা ঠাকুরদাদারা যাহাই বলুন, আসলে ঐগুলি তারা নহে। উহারা হইল ছোট বড় নানা রকম বস্তুপিণ্ড। প্রশ্ন হইতে পারে যে, মহাকাশে ঐগুলির সৃষ্টি হইল কিরূপে? এই প্রশ্নের উত্তরে বিজ্ঞানীগণ যাহা বলেন, তাহার কিছু আলোচনা করিব।
বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, সুদূর অতীতকালে কোনো নক্ষত্রের আকর্ষণের ফলে সূর্যের জ্বলন্ত বাষ্পীয় দেহের খানিকটা ছিন্ন হইয়া দূরান্তে গিয়া কুণ্ডলী পাকাইতে পাকাইতে পৃথিবীর জন্ম হয়। প্রথমত পৃথিবীও জ্বলন্ত বাম্পাকারে ছিল। ক্রমে শীতল হইয়া তরল অবস্থাপ্রাপ্ত হয়। কালক্রমে আরও শীতল হইয়া পৃথিবীর বহির্ভাগ কঠিন হইতে থাকে। কিন্তু তাহার অভ্যন্তরভাগ তরল অবস্থায়ই থাকে। পৃথিবীর বহিভাগ শীতল ও কঠিন হইয়া সঙ্কুচিত হইবার ফলে ভূগর্ভস্থ তরল পদার্থের উপর প্রবল চাপ পড়িতে থাকে। পৃথিবীর বহির্ভাগ দ্রুত শীতল হইয়া দ্রুত সকোচনের ফলে ভূগর্ভের তরল পদার্থের উপর যে পরিমাণ চাপ পড়িতে থাকে, অভ্যন্তরভাগের তরল পদার্থ দ্রুত তাপ ত্যাগ করিয়া ঐ পরিমাণ সঙ্কুচিত হইতে না পরিয়া সময় সময় পৃথিবীর বহিরাবরণ ভেদ করিয়া ফোয়ারার আকারে ছিটকাইয়া উর্ধে উঠিতে থাকে (এরূপ অত্যুষ্ণ তরল পদার্থের উদগীরণকে অগ্ন্যুৎপাত বলে এবং তাহার উৎসমুখে সৃষ্ট হয় আগ্নেয়গিরি)। সেকালে এইরূপ তরল পদার্থের উদগীরণ এত অধিক শক্তিসম্পন্ন হইত যে, উহা পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ সীমার বাহিরে চলিয়া যাইত এবং মহাকাশের শীতল স্পর্শে শীতল হইয়া কঠিন পাথরের আকারপ্রাপ্ত হইত ও মহাকাশে ইতস্তত ভাসিয়া বেড়াইত।
কালক্রমে পৃথিবী আরও শীতল ও কঠিন হইয়া প্রাণীবাসের যোগ্য হইয়াছে এবং মহাকাশে ঐ ভাসমান পাথরগুলি আজও ভাসিয়া বেড়াইতেছে। ঐসকল পাথরকে বলা হয় উল্কাপিণ্ড। উল্কাপিণ্ডগুলি ওজনে দুই-তিন ছটাক হইতে বিশ-পঁচিশ মণ বা ততোধিক ভারি হইয়া থাকে। উহারা মহাকাশে ভাসিয়া বেড়াইতে বেড়াইতে কোনো কোনো সময় পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের সীমার ভিতরে আসিয়া পড়ে এবং পৃথিবীর আকর্ষণের ফলে ভূপতিত হইতে থাকে। ভূপতিত হইবার সময় বায়ুর সংঘর্ষে উহারা প্রথমত উত্তপ্ত হয়, পরে জ্বলিয়া উঠে। যে সকল উল্কাপিণ্ড আকারে ছোট, তাহারা জ্বলিয়া মধ্যপথে নিঃশেষ হইয়া ভস্মে পরিণত হয় এবং যেগুলি আকারে বড়, তাহারা নিঃশেষ হইতে পারে না, উহারা আধপোড়া অবস্থায় সশব্দে ভূপতিত হয়। দহনের ফলে সাধারণত উহাদের রং কালো হইয়া থাকে।
পৃথিবীর গঠনোপাদান বা মৌলিক পদার্থের সংখ্যা ১০২টি। বিজ্ঞানীগণ উল্কার দেহ পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছেন যে, উল্কার দেহের মৌলিক উপাদান উহারই মধ্যে ৫০টি। পৃথিবীতে নাই, এমন উপাদান উহাতে একটিও পাওয়া যায় নাই। বিশেষত বয়সেও উল্কারা পৃথিবীর সমবয়সী। সুতরাং বুঝা যাইতেছে যে, এই জাতীয় উল্কারা পৃথিবীরই অংশবিশেষ এবং এককালে ইহারা পৃথিবীতেই ছিল।
এই রকম কোনো উল্কাপিণ্ড লোকালয়ে পতিত হইলে লোকে উহা সংগ্রহ করিয়া সযত্নে রক্ষা করে। ঐরূপ সংগৃহীত আধপোড়া উল্কাপিণ্ড পাশ্চাত্যের প্রায় সকল যাদুঘরেই দেখিতে পাওয়া যায় এবং ভারতের কলিকাতা মিউজিয়মেও আছে বেশ কয়েকটি।
মক্কা শহরে পবিত্র কাবাগৃহে হেজরল আসোয়াদ নামে কালো রঙের একখানা পাথর রক্ষিত আছে। ঐ পাথরখানা নাকি আকাশ (স্বর্গ) হইতে পতিত হইয়াছিল। হাজীগণ উহাকে সসম্মানে চুম্বন করিয়া থাকেন। বোধ হয় যে, ঐ পাথরখানাও একখানা মাঝারি ধরণের উল্কা।
মহাকাশে বস্তুপিণ্ডের অভাব নাই। পূর্বোল্লিখিত কারণ ব্যতীত অন্যান্য কারণেও মহাকাশে বস্তুপিণ্ড জমিতে পারে এবং তাহা পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির আওতাধীনে আসিলে, তাহাতে উল্কাপাত হইতে পারে। পূর্বে বলা হইয়াছে যে, সৌররাজ্যে আসিয়া যে সকল ধূমকেতুর অপমৃত্যু ঘটে, উহাদের দেহের বস্তুপিণ্ডগুলি উহাদের চলার পথে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় থাকিয়া যায়। পৃথিবী তাহার স্বীয় কক্ষে চলিতে চলিতে বৎসরের কোনো কোনো দিন ঐরূপ মৃত ধূমকেতুর পথে হাজির হয় এবং ঐ বস্তুপিণ্ডগুলিকে কাছে পাইয়া টানিয়া ভূপাতিত করে। এইরূপ পতনোন্মুখ পিণ্ডগুলি জ্বলিয়া-পুড়িয়া উল্কার সৃষ্টি হয়। এই কারণেই বৎসরের বিশেষ কয়েকটি দিনে উল্কাপাত খুব বেশি হয়।
দিনে-রাতে পৃথিবীর আকাশে কতগুলি উল্কা প্রবেশ করিতেছে, তাহা নির্ণয় করা দুরূহ। দিবালোকে যে সকল উল্কাপাত হয়, তাহা প্রায়ই দেখা যায় না এবং রাত্রির উল্কাও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রগুলি থাকে দৃষ্টিসীমার বাহিরে। আমরা স্বচ্ছন্দে দেখিয়া থাকি মাত্র বড় বড় উল্কার পতন। একজন বিজ্ঞানী হিসাব করিয়া বলিয়াছেন যে, পৃথিবীর আকাশে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৪২ লক্ষ উল্কা প্রবেশ করে। আবার কোনোও বিজ্ঞানী হিসাব দেখাইয়াছেন যে, মহাশূন্য হইতে যে উল্কা পোড়া ছাই প্রতিদিন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে, তাহার পরিমাণ প্রায় এক হাজার টন।[২৩]