.
অন্যান্য
# ধূমকেতু ধূমকেতু মানে ধুয়ার নিশান। সাধারণ্যে উহা লেজওয়ালা তারা নামে পরিচিত। সৌরাকাশে উহার আবির্ভাব খুব বিরল। তাই উহা বার বার দেখা যায় না। পশু-পাখির জন্য কি না তাহা জানি না, আকাশে ধূমকেতুর উদয় মানুষের জন্য নাকি অমঙ্গলজনক। এতদ্বিষয়ে হিন্দুশাস্ত্রে জানা যায়– যে ধূমকেতুর আকার ইন্দ্রধনুর ন্যায়, অথবা যাহার মস্তকে দুইটি বা তিনটি চূড়া থাকে, উহা সাতিশয় অনিষ্টদায়ক। যাহাদিগের দেহ হ্রস্ব ও প্রসন্ন, তাহারা তত অনিষ্টদায়ক নহে। আবার দক্ষিণদিকে ধূমকেতুর উদয় হইলে ঘোরতর অনিষ্ট হয়; অন্যদিকে উদিত হইলে তাদৃশ অনিষ্টকর হয় না। বলা বাহুল্য যে, এই সকল পৌরাণিক কাহিনীর এখন আর কোনো মূল্য নাই। ধূমকেতু সম্বন্ধে জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ যাহা বলেন, তাহার সামান্য আলোচনা করিতেছি।
খুব দক্ষ শিল্পীরও ইমারত গঠনান্তে দেখা যায় যে, ইট, সুরকি ইত্যাদি সংগৃহীত মাল-মশলার কিয়দংশ ইতস্তত ছিটকাইয়া-ছড়াইয়া পড়িয়া থাকে। দ্রুপ অখণ্ড নীহারিকাপুঞ্জ হইতে নক্ষত্ররাজি সৃষ্টির প্রাক্কালে উহার কিছু মাল-মশলা মহাকাশে ইতস্তত ছিটকাইয়া-ছড়াইয়া পড়িয়াছিল এবং উহা এখনও মহাকাশে বিরাজ করিতেছে।
ঐ সকল ছুটকো পদার্থগুলি –অণু, কণা বা পিণ্ডাকারে ঝক বাধিয়া মহাকাশে ইতস্তত ভ্রমণ করিতেছে। উপগ্রহদের গতির উদ্দেশ্য হইল গ্রহকে প্রদক্ষিণ করা, গ্রহদের গতির উদ্দেশ্য হইল সূর্যকে প্রদক্ষিণ করা এবং সূর্য বা নক্ষত্রদের গতির উদ্দেশ্য হইল নক্ষত্র জগতের কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করা ইত্যাদি; কিন্তু ঐ সকল ছুটকো পদার্থগুলির গতির তেমন কোনো উদ্দেশ্য নাই। উহারা উদ্দেশ্যহীনভাবে মহাকাশে অন্ধের মতো ভ্রমণ করে। এইভাবে চলিতে চলিতে উহাদের কোনো কোনো ঝক কোনো কোনো সময়ে সৌরাকাশে প্রবেশ করে। তখন সূর্যের তাপের প্রভাবে ঋকের অণু-কণাগুলির মধ্যে চঞ্চলতা দেখা দেয় এবং চঞ্চলতা বৃদ্ধির সাথে সাথে ঠোকাঠুকির ফলে কতক অণু-কণা ভাঙ্গিয়া বাষ্পীয় আকার ধারণ করে। আঁকের বস্তুপিণ্ডগুলি চলিবার সময় বাষ্পীয় পদার্থটিকে সঙ্গে লইয়া যাইতে পারে না, উহা পিছনে পড়িয়া থাকে। সূর্যালোকে আমরা ঐ অণু, কণা বা বস্তুপিণ্ডের সমষ্টিকে দেখি ধূমকেতুর মুণ্ডরূপে এবং বাষ্পীয় অংশকে বলি লেজ। কোনো বিশেষ কারণে ধূমকেতুর লেজটি সব সময়ই সূর্যের বিপরীত দিকে থাকে।
সৌররাজ্য প্রবেশ করিলে সূর্যের আকর্ষণের ফলে ধূমকেতুর সরল গতি থাকে না, উহা বাকিয়া যায়। সূর্য হইতে উহার দূরত্বের কম-বেশি অনুসারে আকর্ষণের জোর কম বা বেশি হয়। আকর্ষণের জোর কম হইলে সূর্যকে অর্ধপ্রদক্ষিণ করিয়া, যেদিক হইতে আসিয়াছিল, চিরদিনের জন্য ধূমকেতুটি সেই দিকে চলিয়া যায় এবং আকর্ষণের জোর বেশি হইলে সূর্যের আকর্ষণের নাগপাশ ছিন্ন করিয়া যাইতে পারে না, এক পটলাকৃতি কক্ষপথে নির্দিষ্ট সময়ে সে বার বার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করিতে থাকে। ইহাতে দেখা যাইতেছে যে, ধূমকেতুরা দুই ভাগে বিভক্ত; যাহারা একাধিক বার সৌরাকাশে প্রবেশ করে না, তাহারা হইল ‘পলাতক’ এবং যাহারা বার বার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে, তাহারা হইল ‘বন্দী’।
সৌররাজ্যে বেড়াইতে আসিয়া কোনো কোনো ধূমকেতু ভালোয় ভালোয় ফিরিয়া যায়, আবার কেহবা চিরকালের মতো সূর্যের হাতে বন্দী হইয়া পড়ে। কিন্তু কোনো কোনো ধূমকেতুর বড়ই দুর্ভাগ্য। সৌররাজ্যে ভ্রমণ করিবার সময় যদি কোনো ধূমকেতু শনি, বৃহস্পতি বা অন্য কোনো বড় গ্রহের নিকট দিয়া যাইতে থাকে, তাহা হইলে সূর্য ও গ্রহের টানে ধূমকেতুটি আর আস্ত থাকে না, ছিন্নবিচ্ছিন্ন হইয়া ধূমকেতু নামটিই হারাইয়া ফেলে। এইভাবে যে-সব ধূমকেতু ধংস হইয়া যায়, তাহাদের দেহের ভগ্নাবশেষ তাহাদের চলতি পথে ইতস্তত ছড়াইয়া থাকে।
ধূমকেতু যখন দূরাকাশে থাকে তখন দূরবীনযোগে দেখিলে উহাকে এক টুকরা মেঘের মতো দেখায় এবং যতই সূর্যের নিকটবর্তী হইতে থাকে, ততই উহার উজ্জ্বলতা বাড়ে ও লেজ গজায়। সূর্যের নৈকট্যবৃদ্ধির সাথে সাথে ধূমকেতুর লেজও বৃদ্ধি পায়। সূর্য হইতে যতই দূরে যাইতে থাকে, ধূমকেতুর লেজ ততই ছোট হইতে থাকে ও শেষে অদৃশ্য হইয়া যায়। কোনো কোনো ধূমকেতুর লেজ লম্বায় ১০ কোটি মাইলেরও বেশি হইয়া থাকে। আবার কোনো কোনো ধূমকেতুর একাধিক লেজ দেখা যায়।
সূর্যের হাতে যে সকল ধূমকেতু বন্দী হইয়াছে, অন্য অন্য সময়ে সেইগুলি সৌররাজ্য হইতে এতই দূরে চলিয়া যায় যে, পুনঃ ফিরিয়া আসিতে একশত, দুইশত বা কোনো কোনো ধূমকেতুর সাত-আটশত বৎসর লাগিয়া যায়। অথচ ধূমকেতুর গতিবেগও নেহায়েত কম নহে, প্রতি সেকেণ্ডে প্রায় ৮০০ মাইল। ১৬৮২ খ্রীস্টাব্দে হ্যাঁলি সাহেব একটি ধূমকেতুর গতিবিধি নির্ণয় করেন, তাই ঐটি ‘হ্যালির ধূমকেতু’ নামে পরিচিত। উক্ত ধূমকেতুটি প্রায় ৭৫ ১/২ বৎসর অন্তর একবার সৌরাকাশে উদিত হয়। ঐটি ১৯১০ খ্রীস্টাব্দে শেষবারের মতো আমাদের আকাশে উদিত হইয়াছিল এবং প্রোক্ত হিসাবমতে আগামী ১৯৮৫ বা ৮৬ খ্রীস্টাব্দে আবার উদিত হইবার কথা।[২২]
আকৃতি দেখিয়া মনে হয় যে, ধুমকেতুর লেজ একটি বিরাট কিছু। বস্তুত তাহা নহে। উহা নিতান্ত হাল্কা বাষ্প মাত্র। বিজ্ঞানী জগদানন্দ রায় বলিয়াছেন, “সুবিধা হইলে গোটা ধূমকেতুর লেজ পকেটে পোরা যায় এবং উহা নিক্তিতে মাপিলে ওজন আধসের তিনপোয়ার বেশি হইবে না।” একবার একটি ধূমকেতুর লেজের ভিতর পৃথিবী ঢুকিয়া বেশ কিছুদিন কাটাইয়াছিল। কিন্তু পৃথিবীর মানুষ তখন জানিতেই পারে নাই যে, তাহারা ধূমকেতুর লেজের ভিতর বাস করিতেছে। ইহাতে বুঝা যাইতেছে যে, ধূমকেতুরা মানুষের কোনো ক্ষতি করে না বা করিতে পারে না। পৌরাণিক কাহিনীগুলি শাস্ত্রকারদের অলীক কল্পনা মাত্র।