গ্রহকণিকাদের বাদ দিলে সৌররাজ্যে বৃহস্পতি পঞ্চম গ্রহ। সূর্য হইতে ইহার মোটামুটি দূরত্ব ৪৮ কোটি ৩৯ লক্ষ মাইল। বৃহস্পতির ব্যাস বিষুব অঞ্চলে ৮৮,৭০০ ও মেরু অঞ্চলে ৮২,৭৮০ মাইল। আয়তনে বৃহস্পতি পৃথিবী অপেক্ষা ১,৩১২ গুণ বড়।[১৯]
বৃহস্পতি আপন কক্ষপথে চলে সেকেণ্ডে ৮.১ মাইল বেগে। এইরূপ বেগে চলিয়া একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করিতে তাহার সময় লাগে ১১.৮৬২ বৎসর। অর্থাৎ বৃহস্পতির এক বৎসর আমাদের প্রায় ১২ বৎসরের সমান।
আমাদের পৃথিবীর চন্দ্র আছে একটি এবং মঙ্গলের আছে দুইটি। কিন্তু বৃহস্পতির চন্দ্র আছে। বারোটি। নিকটের চন্দ্রটির নাম আইও। এইটি বৃহস্পতি হইতে ২ লক্ষ ৬১ হাজার মাইল দূরে থাকিয়া ১.৭৭ দিনে একবার বৃহস্পতিকে প্রদক্ষিণ করিয়া আসে। অর্থাৎ প্রায় ৪২ ঘণ্টায় আইওর একবার অমাবস্যা ও একবার পূর্ণিমা হইয়া থাকে। বৃহস্পতির দ্বিতীয় চন্দ্রটির নাম ইওরোপা। এইটি বৃহস্পতির ৪ লক্ষ ১৫ হাজার মাইল দূরে থাকিয়া ৩.৫৫ দিনে একবার বৃহস্পতিকে প্রদক্ষিণ করিয়া থাকে। অর্থাৎ ইওরোপা একবার অমাবস্যা ও একবার পূর্ণিমা দেখায় প্রায় ৩ ১/২ দিনে। বৃহস্পতির বারোটি চাঁদের মধ্যে এগারোটির দূরত্ব জানা গিয়াছে। ইহার শেষ চাঁদটি আছে বৃহস্পতি হইতে ১,৪০,২৪,৮০০ মাইল দূরে এবং ৬৯২.৫ দিনে একবার বৃহস্পতিকে প্রদক্ষিণ করে। অর্থাৎ পৃথিবীর প্রায় দুই বৎসরের সমান ঐটির এক চান্দ্রমাস।[২০]
দেখা যায় যে, খুব মোটা মানুষের গায়ের ওজন তত বেশি হয় না। বৃহস্পতিরও সেই দশা। আয়তনের বিশালতায় বৃহস্পতি গ্রহকুলের রাজা বটে। কিন্তু তাহার ওজন তত বেশি নহে। পৃথিবীর বস্তুগুরুত্ব ৫.৫২। কিন্তু বৃহস্পতির বস্তুগুরুত্ব মাত্র ১.৩৪। অর্থাৎ পৃথিবীর প্রায় এক চতুর্থাংশের সমান। তাই আয়তনে বৃহস্পতি ১,৩১২টি পৃথিবীর সমান হইলেও, ওজন মাত্র ৩১৭ গুণ।
বৃহস্পতির তাপ হিমাঙ্কেরও নিচে, জল আছে বরফের আকারে ও বাতাস আঁটি অক্সিজেনের পরিবর্তে নানাবিধ বিষাক্ত বাষ্পে পরিপূর্ণ। সুতরাং সেখানে কোনোরূপ জীব বা জীবনের অস্তিত্ব থাকিতে পারে না।
হিন্দুদের পুরাণমতে –বৃহস্পতি দেবগণের গুরু ও মন্ত্রী। ইনি অঙ্গিরা ঋষির পুত্র। ইঁহার স্ত্রীর নাম তারা। চন্দ্র তারাকে হরণ করিলে ইনি দেবগণের সহায়তায় চন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আয়োজন করেন। আবার চন্দ্রও দৈত্যগণের সহায়তায় যুদ্ধে প্রস্তুত হয়। অবস্থা গুরুতর দেখিয়া ব্রহ্মা চন্দ্রের নিকট হইতে তারাকে আনিয়া ইহাকে অর্পণ করিলে যুদ্ধ স্থগিত হয়। অতঃপর বৃহস্পতির ঔরসে কচ ও ভরদ্বাজ নামে দুইটি পুত্রেরও জন্ম হয়। সে যাহা হউক, বর্তমান যুগে এই সমস্ত কাহিনী কীটদষ্ট পুরাণের পাতায় চাপা পড়িয়াই আছে।
.
# ৬. শনি
বৃহস্পতির ভ্রমণপথের বাহিরে শনির ভ্রমণপথ। সূর্য হইতে ইহার দূরত্ব ৮৮ কোটি ৭১ লক্ষ মাইল। শনি গ্রহের ব্যাস বিষুব অঞ্চলে ৭৫,০৬০ মাইল ও মেরু অঞ্চলে ৬৭,১৬০ মাইল। পৃথিবীর মতোই ইহার মেরুদেশ চাপা। বৃহস্পতিকে বাদ দিলে এত বড় গ্রহ সৌরাকাশে আর নাই। আয়তনে শনি ৭৩৪টি পৃথিবীর সমান।
বৃহস্পতির ভ্রমণপথের চেয়ে শনির ভ্রমণপথ বড় এবং শনি চলে সেকেণ্ডে মাত্র ছয় মাইল গতিতে। এইরূপ বেগে চলিয়া একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করিতে শনির সময় লাগে ২৯.৪৫৮ বৎসর। অর্থাৎ শনির এক বৎসর আমাদের প্রায় সাড়ে ঊনত্রিশ বৎসরের সমান। শনি নিজ মেরুদণ্ডের চারিদিকে একবার পাক দিতে পারে ১০ ঘণ্টা ১৬ মিনিটে। সুতরাং দিন-রাতের পরিমাণ প্রায় সোয়া দশ ঘণ্টা মাত্র। শনি ও বৃহস্পতির দিন-রাতের পার্থক্য বেশি নহে, মাত্র ১৬ মিনিট। কিন্তু পৃথিবীর এক দিন শনির প্রায় আড়াই দিনের সমান।
শনির চাঁদ আছে নয়টি। উহারা ভিন্ন ভিন্ন দূরত্বে থাকিয়া বিভিন্ন সময়ে শনিকে প্রদক্ষিণ করে। খুব কাছের চাঁদটির নাম মিমাস, এইটি শনির ১ লক্ষ ১৭ হাজার মাইল দূরে থাকিয়া ০.৯৪ দিনে একবার শনিকে প্রদক্ষিণ করে। সুতরাং একদিনের মধ্যেই উহার অমাবস্যা ও পূর্ণিমা হইয়া যায়। সর্বশেষ চাঁদটির নাম ফিবি (Phoebe)। এইটি শনির ৮,০৫৪ হাজার মাইল দূরে থাকিয়া ৫৫০.৪৫ দিনে একবার শনিকে প্রদক্ষিণ করে। সুতরাং পৃথিবীর প্রায় দেড় বৎসরের সমান ফিবি’র এক চান্দ্রমাস।
নয়টি চাঁদ শনিকে ঘিরিয়া পাক খাইতেছে। ইহা ভিন্ন আর একটি পদার্থ শনিকে ঘিরিয়া আছে, উহাকে বলা হয় শনির বলয়। শনির দেহ হইতে কিছু দূরে গাড়ির চাকার মত একটি উজ্জ্বল পদার্থ সব সময়ই শনিকে ঘিরিয়া রাখিয়াছে।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, শনির একটি উপগ্রহ এককালে শনির খুব কাছাকাছি হইয়াছিল। তাই তাহার প্রবল আকর্ষণে ঐটি চূর্ণবিচূর্ণ হইয়া যায় এবং বিচূর্ণ কণাগুলি উহার ভ্রমণপথে বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়ে। ভগ্ন উপগ্রহটির ন্যায় কণাগুলিরও গতিবেগ থাকায় উহারা শনির টানে তাহার পৃষ্ঠদেশে পতিত না হইয়া নির্দিষ্ট দূরত্বে থাকিয়া শনিকে প্রদক্ষিণ করিতে থাকে। কোটি কোটি কণা। ঘেঁষাঘেঁষি করিয়া চলিতে থাকায় দূর হইতে আমরা উহাদিগকে বলয়ের আকারে দেখি।
শনির নিষ্ক্রণ বেগ সেকেণ্ডে ২৩ মাইল এবং তাপ হিমাঙ্কেরও ১৫৫° সে. নিচে। এই তাপে এতোধিক নিষ্ক্রমণ বেগ অর্জন করিয়া শনির কোনো বায়বীয় পদার্থই মহাশূন্যে ছুটিয়া পলাইতে পারে নাই। সুতরাং হাইড্রোজেনাদির সংমিশ্রণে শনির বায়ুমণ্ডল নিশ্চয়ই বিষাক্ত এবং জলের নাম পর্যন্ত নাই, আছে শুধু বরফ, সুতরাং সেখানে জীব বা জীবনের অস্তিত্ব নাই। শনি একটি নির্জীব গ্রহ।