অস্ট্রেলিয়ার আদিম জাতির মত
অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের অন্তর্গত ভিক্টোরিয়া প্রদেশের উত্তরাংশে যে সকল আদিম অধিবাসী বাস করে, তাহারা বলে, পণ্ডজিল নামক পক্ষীই এই বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা। সেই পক্ষীই পৃথিবীকে খণ্ড খণ্ড অংশে বিভক্ত করিয়াছে।
অস্ট্রেলিয়ার অন্যান্য অংশের আদিম অধিবাসীদিগের বিশ্বাস, ‘নুরালি’ অর্থাৎ অতি প্রাচীনকালের মনুষ্যগণই এই পৃথিবী সৃষ্টি করিয়া গিয়াছেন।
আমেরিকার আদিম অধিবাসীদের মত
আমেরিকার ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের সৃষ্টিবর্ণনায় অস্ট্রেলিয়ান মতেরই ছায়াপাত হইয়াছে। কোথায়ও পক্ষী হইতে, কোথায়ও বা বিশেষ বিশেষ জন্তু হইতে এই পৃথিবী ও প্রাণীসমূহের সৃষ্টি হইয়াছে বলিয়া প্রচারিত রহিয়াছে।
উত্তর আমেরিকার আলাস্কা প্রদেশে সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার অভিব্যক্তিমূলক একটি প্রতিমূর্তি দৃষ্ট হয়। ঐ মূর্তিটি এক্ষণে পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তভূর্ত যাদুঘরে রক্ষিত আছে। ঐ অঙ্কিত প্রতিচিত্রে একটি কৃষ্ণবর্ণ কাক মানুষের মুখোশের উপর বসিয়া আছে। বোধ হইতেছে যেন কাকটি তা দিয়া তা দিয়া ডিম্ব হইতে মনুষ্য সৃষ্টি করিতেছে। এই চিত্রটি দর্শনে ইউরোপীয় পণ্ডিতগণ গবেষণা দ্বারা স্থির করিয়াছেন যে, ডিম্ব হইতেই জীবসমাকুল পৃথিবীর সৃষ্টি হইয়াছে, ইহাই আলাস্কাবাসীদের মত।
সৃষ্টি সম্বন্ধে আমেরিকান রেড ইণ্ডিয়ান জাতিদিগেরও ঐরূপ বিশ্বাস। উত্তর-পশ্চিম তীরের থিলিঙ্কিট ইণ্ডিয়ান নামক অধিবাসীগণ কতকাংশে উক্ত মতেরই পোষকতা করিয়া থাকে। তাহাদের মতে, ‘জেল’ বা ‘জেল্চ্’ অর্থাৎ দাঁড়কাক আপনিই উদ্ভূত হয়। সেই দাঁড়কাকই পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা। ঐ দাঁড়কাক একটি বাক্স হইতে চন্দ্র, সূর্য এবং নক্ষত্রসমূহকে বাহির করিয়া অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীতে আলোকরশ্মি আনয়ন করিয়াছিল।
উত্তর আমেরিকার আল্গকিন জাতির মধ্যে সৃষ্টিবিষয়ক প্রচলিত মত—‘মিকাবো’ অর্থাৎ এক বৃহৎ খরগোশ কর্তৃক পৃথিবী সৃষ্ট হইয়াছিল। সেই খরগোশ ভেলার সাহায্যে অন্যান্য জন্তুকে রক্ষা করিয়াছিল। ভেলায় অবস্থিত জন্তুর মধ্যে তিনটিকে খরগোশরাজ একে একে সমুদ্রের তলদেশে মাটি আনিবার জন্য প্ররণ করে। সমুদ্রতল হইতে তাহারা অল্প বালুকণা লইয়া আসে। সেই বালুকণা হইতে খরগোশরাজ একটি দ্বীপের সৃষ্টি করে। সেই দ্বীপটিই এই পৃথিবী। মৃত জন্তুসমূহের অস্থি-কঙ্কাল লইয়া খরগোশরাজ মনুষ্যের সৃষ্টি করিল। ঐ জাতির মধ্যে জলপ্লাবন, প্রলয়, পুনঃ সৃষ্টি প্রভৃতির বিষয়ও বর্ণিত আছে।
উত্তর আমেরিকার ইরোকো নামক সম্প্রদায় আবার অন্য মত পোষণ করে। তাহারা বলে, উপরে স্বর্গ ও নিম্নে অনন্ত বারিধি ভিন্ন আর কিছুই ছিল না। স্বর্গের একটি ছিদ্রের মধ্য দিয়া একটা আতোয়ান্ত্রিসিক নাম্নী এক রমণী জলমধ্যে নিপতিত হয়। সেই স্থানে একটি কচ্ছপ ছিল। কোনো একটি জলজন্তু কর্তৃক কচ্ছপের পৃষ্ঠদেশে কিঞ্চিৎ মৃত্তিকা রক্ষিত হইয়াছিল। রমণী স্বর্গ হইতে সেই কচ্ছপের পৃষ্ঠে পতিত হয় (আতোয়ান্ত্রিসিক ও বিবি হাওয়ার ভূপতনের আখ্যানে কিছুটা সাদৃশ্য আছে)। রমণী ঐ সময় গর্ভবতী ছিল। তাহার গর্ভ হইতে একটি কন্যা জন্মগ্রহণ করে। সেই কন্যা হইতে যমজ পুত্রদ্বয় উৎপন্ন হয়। তাহাদের নাম জোস্কেহা ও টাওয়াস্কারা। জোস্কেহার সহিত বিরোধ হওয়ায় টাওয়াস্কারা আবার মাতাকে নিহত করে। তাহাদের মাতার কঙ্কাল হইতে উদ্ভিদাদি উৎপন্ন হয়। জোস্কেহা মানুষ ও পশু সৃষ্টি করে।
মেক্সিকোর অধিবাসীগণ সৃষ্টির পাঁচটি পর্যায় স্বীকার করে। প্রথম চারিটি পর্যায়ের নাম—স্থল, অগ্নি, বায়ু ও জল (এই মতটি গ্রীক দার্শনিক এম্পিডোকল্স-এর মতের অনুরূপ; তাঁহার মতে সৃষ্টির মৌলিক উপাদান ক্ষিতি, অপ্, তেজঃ ও মরুৎ–অর্থাৎ আব, আতস, খাক, বাত)। পঞ্চমটির নাম নির্দিষ্ট হয় নাই (ভারতীয় আর্যদের মত অনুসারে অতিরিক্তটি ‘পঞ্চভূত’-এর অন্তর্গত ‘ব্যোম’ বলিয়া মনে হয়; ব্যোম অর্থ আকাশ বা শূন্য)। তাহাদের মতে, প্রথম যুগে মৃত্তিকার সৃষ্টি অগ্নি অথবা তাপ বা আলোকপুঞ্জ, তৃতীয় বায়ব পদার্থ, চতুর্থ জলীয় বা বাষ্পীয় পদার্থ। মেক্সিকোবাসীগণ জলপ্লাবনে বিশ্বাসবান।
মেক্সিকোবাসীদের সৃষ্টি প্রকরণে পাশ্চাত্যের বেশ কিছুটা ছাপ আছে।
পেরুদেশবাসীরা তিনজন সৃষ্টিকর্তার প্রাধান্য স্বীকার করিয়া থাকে। তাহাদের—১. ‘পাচা কামাক’, উনি ভূগর্ভস্থ অগ্নিদেবতা; ২. ‘ভিরা কোচা’, ইনি পৃথিবীর সৃষ্টি ও গঠনকর্তা বলিয়া পূজিত; ৩. ‘মাংকোকাপাক; বা অদ্বিতীয় মনুষ্য, তাঁহার পত্মী ও ভগ্নী ‘সৃষ্টিকারী ডিম্ব’ নামে অভিহিত। অদ্বিতীয় মনুষ্য ও ডিম্ব পরিশেষে সূর্য ও চন্দ্র রূপে প্রকাশমান হন। যুকাসদিগের পুরোহিতগণ তাঁহাদিগকে রাজা ও রাণী নামে অভিহিত করিয়া থাকেন।
ব্রাজিলের কোনো কোনো জাতি বলিয়া থাকে, জামোয়া নামক দেবতা পৃথিবীর প্রথম মনুষ্যের পিতামহ। তাহার দ্বারাই সৃষ্টিকার্য সম্পন্ন হয়। উত্তর আমেরিকার এস্কিমো জাতি বলিয়া থাকে, এই পৃথিবী অনন্তকাল বিদ্যমান আছে। কোনো দিন কেহ ইহাকে সৃষ্টি করে নাই।
আমেরিকার অধিকাংশ জাতি সূর্যদেবকে সৃষ্টিকর্তা ও পরমেশ্বর বলিয়া মান্য করে। কিন্তু এস্কিমোগণ এবং উত্তর আমেরিকার আথাবাস্কা জাতি সূর্যদেবের প্রাধান্য আদৌ স্বীকার করে না। এতদপ্রসঙ্গে জার্মান পণ্ডিত অধ্যাপক রাজেল একটি অভিনব সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন। তিনি বলেন, এস্কিমো প্রভৃতি জাতির বাসস্থান উত্তর আমেরিকায়। চির তুষারাবৃত পৃথিবীর ঐ অংশে মনুষ্যগণ মাংসাদি খাইয়াই জীবন ধারণ করে। সূর্যের সহিত তাহাদের সম্বন্ধ অতি অল্প। সুতরাং তাহারা সূর্যের প্রাধান্য স্বীকার করে না। তিনি আরও বলেন, পৃথিবীর যে যে অংশে চাষাবাদ নাই, সেখানকার লোকেরা কদাচ সূর্যের উপাসনা করে না।