ফোবো ও ডাইমো নামে মঙ্গলের দুইটি উপগ্রহ বা চন্দ্র আছে। ফোবো মঙ্গলের ৫,৮২৮ মাইল দুরে থাকিয়া ৭ ঘণ্টা ৪০ মিনিট ৪৮ সেকেণ্ডে একবার মঙ্গলকে প্রদক্ষিণ করিয়া আসে। অর্থাৎ মঙ্গলের আকাশে ফোবোর অমাবস্যা বা পূর্ণিমা হয় দৈনিক তিনবার। ডাইমো আছে মঙ্গল হইতে ১৫ হাজার মাইল দূরে এবং মঙ্গলকে একবার প্রদক্ষিণ করিতে তাহার সময় লাগে ৩০ ঘণ্টা ১৪ মিনিট ২৪ সেকেণ্ড। পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করিতে আমাদের চাঁদের যেখানে সময় লাগে ২৯ দিন ১২ ঘন্টা ৪৪.০৫ মিনিট, অর্থাৎ প্রায় ৩০ দিন, সেখানে ডাইমোর সময় লাগে মাত্র ৩০ ঘণ্টা। আমাদের চাঁদের অমাবস্যা ও পূর্ণিমার মাঝখানের অন্তর প্রায় ১৫ দিন, কিন্তু ডাইমোর অমাবস্যা ও পূর্ণিমার অন্তর মাত্র ১৫ ঘণ্টা। কাজেই মঙ্গলের আকাশে প্রতিরাত্রে পূর্ণিমা তো আছেই, কোনো কোনো রাত্রে ডবল পূর্ণিমাও হইয়া থাকে। মঙ্গলের রাজ্যে যদি মানুষ থাকে, তবে তাহারা খোরাক পোশাক কি পরিমাণ পায় তাহা জানি না, কিন্তু চন্দ্রালোক আমাদের চেয়ে বেশিই পায়।
মঙ্গলের নিষ্ক্রমণ বেগ ৩.২ মাইল। এত অল্প নিষ্ক্রমণ বেগ সত্ত্বেও মঙ্গলে জলবায়ুর খবর পাওয়া যাইতেছে। জলবায়ু থাকিবার কারণ এই যে, মগলে তাপ কম। ভূপৃষ্ঠের গড় উত্তাপ প্রায় ৬৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট। কিন্তু মঙ্গলের উত্তাপ বিষুবাঞ্চলে দিনের বেলা ৫০ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তাহারও কিছু বেশি; আবার মধ্যরাত্রে নামিয়া যায় হিমাঙ্কেরও ১৩০ ডিগ্রী ফারেনহাইট নিচে। মঙ্গলের উত্তাপে দিনে ও রাত্রে এত পার্থক্য হইবার কারণ এই যে, মঙ্গলের বায়ুতে জলীয় অংশ নিতান্ত কম। পৃথিবীতে যেমন উপকূলীয় অঞ্চলের বায়ু সিক্ত বলিয়া সেখানে দিন ও রাত্রের উত্তাপে বিশেষ পার্থক্য হয় না, পক্ষান্তরে মরু অঞ্চলের বায়ু শুষ্ক বলিয়া সেখানে দিন ও রাত্রের উত্তাপে দারুণ পার্থক্য –ইহাও তেমনই।
মঙ্গলের আকাশে বায়ু খুব কম। তাহার মধ্যে আবার অক্সিজেন আছে নামমাত্র। মঙ্গলকে সহজ দৃষ্টিতে একটি উজ্জ্বল লাল রং-এর জ্যোতিষ্ক বলিয়া মনে হয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলেন যে, মঙ্গলের গায়ের লাল রংটি উহার পৃষ্ঠদেশের মরিচা ধরা পাথর বা বালিরই রং। শীতকালে মঙ্গলের মেরু অঞ্চল বরফে ঢাকা থাকে। তাই তখন মেরু অঞ্চলের রং হয় শাদা। গ্রীষ্মকালে মেরু অঞ্চলের শাদা রং থাকে না এবং বিষুবীয় অঞ্চলের রং হয় সবুজ। মঙ্গলের পৃষ্ঠদেশে অনেক কালো কালো রেখা দেখা যায়, কোনো কোনো বিজ্ঞানী ঐগুলিকে বলেন মঙ্গলের নদী বা খাল। গ্রীষ্মকালে মেরু অঞ্চলের বরফ গলা জল ঐ সকল খাল বা নদীপথে আসিয়া বিষুবীয় অঞ্চল সিক্ত করিলে মওশুমী উদ্ভিদ জন্মে এবং তখন মঙ্গলের গাত্রে সবুজ আভা ফুটিয়া উঠে।
সৃষ্টির আদিতে মঙ্গলের দেহের তাপ সূর্যের বহিরাবরণের তাপের সমান ছিল, অর্থাৎ ৬ হাজার ডিগ্রী সে.। কোটি কোটি বৎসরে ঐ বিপুল তাপের সম্বল হারাইয়া বর্তমানে মঙ্গলের তাপ দাঁড়াইয়াছে মাত্র ৫০° ফারেনহাইটে। সুতরাং মঙ্গল এখন মরণপথের যাত্রী।
মঙ্গল গ্রহে উচ্চ শ্রেণীর কোনো জীব আছে কি না, তাহার কোনো সঠিক প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। মঙ্গল গ্রহে জল আছে, অল্প হইলেও বাতাস আছে এবং খুব সামান্য থাকিলেও তাহাতে অক্সিজেন আছে; কাজেই সেখানে জীব থাকা সম্পূর্ণ অসম্ভবও নহে। অধিকন্তু বিজ্ঞানীগণ মনে করেন যে, মঙ্গলের তাপ যখন পৃথিবীর বর্তমান তাপের সমান ছিল, তখন কোনো না কোনোরূপ জীব ও উদ্ভিদাদিতে মঙ্গল সুশোভিত ছিল। হয়তোবা তখন মঙ্গলের সাগরে মাছ, আকাশে পাখি ও স্থলে নানারূপ জীব বিচরণ করিত এবং অনুকূল অবস্থাপ্রাপ্ত হইলে শুক্রগ্রহেও জীবের আবির্ভাব হইয়া গ্রহটি জীবে পূর্ণ হইতে পারে। পৃথিবীর বর্তমান অবস্থা শুক্রের রাজ্যে ভবিষ্যত কিন্তু মঙ্গলের রাজ্যে অতীত।
.
# ৫. বৃহস্পতি
সূর্য হইতে বুধ, শুক্র, পৃথিবী ও মঙ্গলের মোটামুটি দূরত্ব যথাক্রমে ৩, ৬, ৯ ও ১৪ কোটি মাইল। ইহাতে দেখা যায় যে, যে কোনো দুইটি গ্রহের ব্যবধান ৫ কোটি মাইলের বেশি নহে। সুতরাং সূর্য হইতে বিশ, পঁচিশ কিংবা ত্রিশ কোটি মাইলের মধ্যে আর একটি গ্রহ থাকা উচিত। কিন্তু জ্যোতির্বিদগণ দেখিলেন যে, একদম ৪৮ কোটি ৩৯ লক্ষ মাইল দূরে যাইয়া আছে বৃহস্পতি গ্রহ। বিজ্ঞানীগণ ভাবিলেন যে, মঙ্গল ও বৃহস্পতির ভ্রমণপথের মাঝখানে এত বড় একটি ফাঁকা জায়গা থাকিবার কোনো কারণ নাই। সুতরাং সেখানে নিশ্চয়ই একটা কিছু আছে।
পর্যবেক্ষণে প্রথম ধরা পড়িল দুই একটি বস্তুপিণ্ড, যাহা আমাদের চাঁদের চেয়ে বড় নহে। জ্যোতির্বিদগণ ভাবিলেন যে, উহারা উপগ্রহ। পর্যবেক্ষণ চলিতে লাগিল এবং ক্রমে ধরা পড়িতে লাগিল ঐ দলের ছোট হইতে ছোটরা। আকারে উহারা কোনোটি হিমালয় পর্বতের মতো বড়, কোনোটি আবার ত্রিতলা দালানের মতো। কিন্তু আকৃতি উহার কোনোটিরই সম্পূর্ণ গোল নহে। আকৃতিতে উহারা যেন ভাঙ্গা মার্বেলের এক একটি টুকরা।
বিজ্ঞানীগণ স্থির করিলেন যে, মঙ্গল ও বৃহস্পতির ভ্রমণপথের মধ্যে এককালে একটি মাঝারি ধরণের গ্রহ ছিল। হয়তো বৃহস্পতির টানে গ্রহটি ভাঙ্গিয়া টুকরা টুকরা হইয়া গিয়াছে। উহাদের মধ্যে যেগুলি আকারে বড়, সেগুলি দূরবীনে প্রথমেই ধরা পড়িয়াছে ও অপেক্ষাকৃত ছোটগুলি ক্রমে ধরা পড়িতেছে। কিন্তু অতি ছোট টুকরাগুলি হয়তো কোনোকালেই দৃষ্টিগোচর হইবে না। এই দৃশ্যাদৃশ্য টুকরাগুলির একযোগে নাম রাখা হইয়াছে গ্রহাণুপুঞ্জ বা গ্রহকণিকা। মঙ্গল ও বৃহস্পতির মাঝে নির্দিষ্ট কক্ষে থাকিয়া গ্রহকণিকারা সূর্যকে প্রদক্ষিণ করিতেছে।