জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, নীহারিকা, নক্ষত্র বা গ্রহ-উপগ্রহরা সকলেই যেন ব্যোমসমুদ্রের মাঝে এক একটি দ্বীপ। সে হিসাবে আমাদের চন্দ্রও ব্যোমসাগরের একটি দ্বীপ। ইহাকে বলা যাইতে পারে চন্দ্রদ্বীপ। তবে বঙ্গদেশের ইতিহাসপ্রসিদ্ধ ‘বাকলা চন্দ্রদ্বীপ’ নহে, ইহা আসল চন্দ্রদ্বীপ। কেননা বাকলার ‘চন্দ্রদ্বীপ’ নামটির সৃষ্টি হইয়াছিল উহার আবিষ্কর্তা চন্দ্ৰকান্তের নামানুসারে, মতান্তরে ঐ দ্বীপটির আকৃতি চন্দ্রের ন্যায় ছিল বলিয়া, অর্থাৎ চন্দ্ৰকান্তের দ্বীপ বা চন্দ্রের ন্যায় দ্বীপ। আর বিজ্ঞানীদের মতে চন্দ্র প্রকৃতই একটি দ্বীপ।
চন্দ্র যে রজত-কাঞ্চন বা হীরা-মুক্তার তৈয়ারী অথবা স্বর্গীয় মাহাত্মপূর্ণ আজগুবি কিছু নহে, উহা আমাদের পৃথিবীর মতোই একটি দেশ মাত্র, বিজ্ঞানীগণ ইহা বহু আগে হইতেই জানিতেন। এবং গাণিতিক ও যান্ত্রিক উপায়ে উহার বহু তথ্যও সংগ্রহ করিয়াছেন। সম্প্রতি বিজ্ঞানীগণ সফল হইয়াছেন চন্দ্র অভিযানে। নিরাপদে ও নিয়মিতভাবে চন্দ্রে যাতায়াত আরম্ভ হইলে পর, উহার ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক বহু নূতন তথ্য জানা যাইবে। হয়তোবা কোনো কোনো বিষয়ে পুরাতন তথ্যেরও কিছু কিছু সংশোধন আবশ্যক হইতে পারে। যেমন, পূর্বে বলা হইয়াছে পৃথিবী হইতে চন্দ্রের দূরত্ব ২ লক্ষ ৩৯ হাজার মাইল, আর অধুনা জানা যাইতেছে যে, পৃথিবীর কেন্দ্র হইতে চন্দ্রের কেন্দ্রের দূরতম দূরত্ব ২,৫২,৭১০. মাইল এবং নিকটতম দূরত্ব ২,২১,৪৬৩ মাইল, অর্থাৎ গড় দূরত্ব ২,৩৭,০৮৬২ মাইল ইত্যাদি। বিজ্ঞানীদের চন্দ্রাভিযান প্রচেষ্টা সবেমাত্র সফল হইয়াছে। চন্দ্রের যাবতীয় তথ্য সংগ্রহের এখনও অনেক বাকি। চন্দ্রাভিযানের এই যুগসন্ধিক্ষণে চাঁদের দেশের পুরাতন তথ্যের বেশি আলোচনা না করিয়া প্রত্যক্ষদর্শী বিজ্ঞানীদের বিবরণের প্রতীক্ষায় রহিলাম।
চাঁদে অবতরণ
বহুদিন হইতে বিজ্ঞানীগণ চাঁদে যাইবার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। চন্দ্রাভিযানের প্রথম পর্বের অগ্রদূত ছিলেন রাশিয়ান বিজ্ঞানীরা। কিন্তু কেন যেন অবতরণ পর্বে তাহারা পিছাইয়া পড়িলেন, অগ্রগামী হইলেন আমেরিকান বিজ্ঞানীগণ। ১৯৬৯ সাল হইতে এই পর্যন্ত তাহারা চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করিয়াছেন ছয়বার। সেই অবতরণসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে প্রদান করা হইল।
মানুষের চন্দ্রাভিযান সফল করিবার প্রথম গৌরব অর্জন করেন নভোশ্চর-বিজ্ঞানী আর্মস্ট্রং, আলড্রিন ও কলিনস্। উঁহারা ভূপৃষ্ঠ হইতে চন্দ্রাভিমুখে যাত্রা করিয়া ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই চন্দ্রে অবতরণ ও ভ্রমণ শেষে পৃথিবীতে ফিরিয়া আসেন ২৪ জুলাই। উঁহারা চন্দ্রপৃষ্ঠ হইতে নানা স্থানের ফটো ও কিছু মাটি-পাথর লইয়া আসেন এবং সেখানে রাখিয়া আসেন আমেরিকান ফ্ল্যাগ, বাইবেল ও বিয়ারের খালি বোতল। আর ভুলবশত ফেলিয়া আসেন একটি ক্যামেরা।
২য় বার –এইবারের অভিযাত্রী ছিলেন কনার্ড, গর্ডন ও বীন। উঁহারা ভূপৃষ্ঠ হইতে যাত্রা করেন ১৯৬৯ সালের ১৪ নভেম্বর, অবতরণ করেন ১৯ এবং পৃথিবীতে ফিরিয়া আসেন ২৪ নভেম্বর। উঁহারা রকেট বা চন্দ্রযানে একখানা গাড়ি লইয়া যান এবং উহাতে আরোহণ করিয়া চন্দ্রপৃষ্ঠে ভ্রমণ করেন ও গাড়িখানা সেখানে রাখিয়া আসেন।
৩য় বার –এইবারের অভিযাত্রী ছিলেন লভেল, হেইজ ও সুগার্ড। উঁহারা গিয়াছেন ১৯৭০ সালের ১৮ এপ্রিল এবং আনিয়াছেন চন্দ্রপৃষ্ঠের নানা স্থানের ফটো।
৪র্থ বার –এইবারের অভিযাত্রী শেফার্ড, রূসা ও মিচেল। উঁহারা গিয়াছিলেন ১৯৭১ সালের ৩০ জানুয়ারি।
৫ম বার –এইবারের অভিযাত্রী শেরম্যান, ইভা ও স্মিথ। উঁহারা গিয়াছিলেন ১৯৭২ সালের ৮ ডিসেম্বর।
৬ষ্ঠ বার –এইবারে যান স্ট্যাফোর্ড, স্লেটন ও ব্ৰাণ্ড। উঁহারা গিয়াছিলেন ১৯৭৫ সালের ২৬ জুলাই তারিখে।
[ পিয়ার্স সাইক্লোপিডিয়া, ৮০তম এডিশন; পৃ. এ ৩৩ –এ ৩৬ ]
অভিযাত্রীগণ চন্দ্রপৃষ্ঠ হইতে যে মাটি, পাথর, ফটো ইত্যাদি সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছেন, সেই। সবের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলিতেছে, ফলাফল এখনও সাধারণ মানুষের অজ্ঞাত। তবে চাঁদের মাটি পরীক্ষা করিয়া বিজ্ঞানীগণ জানিতে পারিয়াছেন যে, চাঁদের বয়স পৃথিবীর বয়সের সমান। অর্থাৎ প্রায় ৫০০ কোটি বৎসর। চাঁদে জল, বায়ু ও কোনোরূপ জীবের অস্তিত্ব নাই এবং অতীতে কোনোরূপ জীব থাকারও কোনো নিদর্শন নাই। আগামীতে যদি জানা যায় যে, চাঁদের রাজ্যে এমন কোনো পদার্থ আছে, যাহা মানব জাতির পক্ষে কল্যাণকর, তবে সেইটিই হইবে চাঁদের বাস্তব ফজিলত। ধর্মীয় তথাকথিত চাঁদের ফজিলত এখন অচল।
.
# ৪. মঙ্গল
মঙ্গল সৌরজগতের চতুর্থ গ্রহ। পৃথিবীর ভ্রমণপথের বাহিরেই মঙ্গলের ভ্রমণপথ। কাজেই মঙ্গল পৃথিবীর প্রতিবেশী। সূর্য হইতে ইহার মোটামুটি দূরত্ব ১৪ কোটি ১৭ লক্ষ মাইল। কক্ষভ্রমণের সময়ে সূর্য হইতে মলের দূরত্ব কোনো সময় হয় ১২ কোটি ৮০ লক্ষ মাইল ও কোনো সময়ে হয়। ১৫ কোটি ৫০ লক্ষ মাইল।
মঙ্গলের ব্যাস ৪,২১৬ মাইল এবং আয়তনে মঙ্গল পৃথিবীর বিশ ভাগের তিন ভাগের সমান। মঙ্গলের ভ্রমণপথ পৃথিবীর ভ্রমণপথ হইতে কিছু বড় এবং মঙ্গলের চলনও কিছু ধীরগতি। স্বীয় কক্ষে পৃথিবী চলে সেকেণ্ডে ১৮ ১/২ মাইল। কিন্তু মঙ্গল চলে মাত্র ১৫ মাইল। তাই একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করিতে মঙ্গলের সময় লাগে ৬৮৭ দিন। অর্থাৎ মঙ্গলের এক বৎসর আমাদের পৃথিবীর প্রায় দুই বৎসরের সমান। মেরুদণ্ডের চারিদিকে একবার পাক দিতে মঙ্গলের সময় লাগে ২৪ ঘণ্টা ৩৭ ১/২ মিনিট। সুতরাং মঙ্গলের দিন-রাত পৃথিবীর দিন-রাতের চেয়ে ৩৭ ১/২ মিনিট বড়।[১৮]