আহ্নিক গতি –একমাত্র বুধ গ্রহ ব্যতীত অপর সকল গ্রহেরই লক্ষ্যনীয় আহ্নিক গতি আছে। তবে শুক্র, পসিডন ও ভালকান গ্রহের আছে কি না, তাহা এখনও সঠিক জানা যায় নাই। আহ্নিক গতির ফলেই গ্রহরাজ্যে দিন ও রাত্রি হইয়া থাকে। কিন্তু সকল গ্রহের দিন-রাত্রির পরিমাণ সমান নহে। পৃথিবী আপন মেরুদণ্ডের চারিপাশে একবার ঘুরিয়া আসে ২৪ ঘণ্টায়, তাই পৃথিবীর দিন রাত্রির পরিমাণ ২৪ ঘণ্টা। এইরূপ মঙ্গল গ্রহের দিন-রাত্রির পরিমাণ ২৪ ঘন্টা ৩৭ মিনিট, বৃহস্পতির ১০ ঘণ্টা, শনির ১০ ঘণ্টা ১৬ মিনিট, ইউরেনাসের ১০ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট, নেপচুনের ১৫ ঘন্টা ৪০ মিনিট ইত্যাদি।
বার্ষিক গতি –বার্ষিক গতি গ্রহদের সকলেরই আছে। তবে তাহার সময় বিভিন্ন। যে গ্রহ সূর্যের যত নিকটে, কক্ষপথে চলিয়া সূর্যকে প্রদক্ষিণ করিতে সেই গ্রহের সময় লাগে তত কম এবং দূরের গ্রহের সময় লাগে বেশি। এই বিষয়ে পৃথিবী তাহার প্রতিবাসী গ্রহদের সহিত তাল মিলাইয়া চলিতেছে। যথা– সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করিতে শুক্রের সময় লাগে ২২৫ দিন, পৃথিবীর লাগে প্রায় ৩৬৫ দিন এবং মঙ্গলের এক পাক শেষ করিতে সময় লাগে ৬৮৭ দিন।
কক্ষপথে গতি –পূর্বে আলোচনা করিয়াছি যে, যে গ্রহের ভ্রমণপথ বা কক্ষ সূর্য হইতে যত দূরে, সেই গ্রহের চলন তত ধীর এবং যে গ্রহের কক্ষপথ সূর্যের যত নিকটে, সেই গ্রহের গতি তত দ্রুত। এই বেগকে বলা হয় চক্ৰবেগ। পৃথিবীর ভ্রমণপথ শুক্র ও মঙ্গলের কক্ষপথের মধ্যে অবস্থিত। কাজেই পৃথিবীর চক্রবেগ হওয়া উচিত শুক্র ও মঙ্গলের চক্রবেগের মাঝামাঝি। বস্তুত হইয়াছেও তাহাই। যথা –শুক্রের চক্রবেগ সেকেণ্ডে ২১.৭ মাইল এবং মঙ্গলের ১৫ মাইল; উভয়ের মাঝামাঝি পৃথিবীর ১৮.৫ মাইল।
কৌণিক অবস্থান –সূর্যকে প্রদক্ষিণ করিবার সময় গ্রহগণ তাহাদের কক্ষপথ বা নিরক্ষবৃত্তের উপর সমান্তরালভাবে থাকে না, ঈষৎ হেলিয়া থাকে। পৃথিবীর বেলায়ও ইহার ব্যতিক্রম দেখা যায় না। যথা –পৃথিবী ২৩, মঙ্গল ২৫, বৃহস্পতি ৩, শনি ২৭ ও ইউরেনাস ৬০ ডিগ্রী কোণ করিয়া হেলিয়া আছে।[১৫]
উপগ্রহ –বুধ ও শুক্র গ্রহের কোনো উপগ্রহ নাই এবং লুটো, পসিডন ও ভালকানের আছে কি না, তাহা এখনও জানা যায় নাই। অপর সমস্ত গ্রহেরই উপগ্রহ বা চন্দ্র আছে। যথা– পৃথিবীর ১টি, মঙ্গলের ২টি, বৃহস্পতির ১২টি, শনির ৯টি, ইউরেনাসের ৫টি এবং নেপচুনের চন্দ্র আছে ২টি।
স্তর –পূর্বে আলোচিত হইয়াছে যে, সৃষ্টির প্রাক্কালে পৃথিবীর ভারি পদার্থগুলি নিচের দিকে ও হাল্কা পদার্থগুলি উপরে থাকিয়া ভিন্ন ভিন্ন তিনটি প্রধান স্তরে সজ্জিত হইয়া আছে। সুতরাং ভূগর্ভে প্রধান স্তর তিনটি। যথা –কেন্দ্র হইতে গলিত ধাতু স্তর ২,২০০ মাইল, ব্যাসল্ট স্তর ১,৮০০ মাইল এবং উপরে গ্রানাইট স্তর ৩০ মাইল। অনুরূপভাবে অন্যান্য গ্রহেরও স্তরভেদ আছে। যথা –বৃহস্পতির কেন্দ্র হইতে ২২ হাজার মাইল পাথর স্তর, ১৬ হাজার মাইল বরফ স্তর ও ৬ হাজার মাইল বায়ু স্তর; ইউরেনাসের কেন্দ্র হইতে ৭ হাজার মাইল পাথর স্তর, ৬ হাজার মাইল বরফ স্তর এবং প্রায় ৩ হাজার মাইল বায়ু স্তর ইত্যাদি।[১৬]
নিষ্ক্রমণ বেগ –পৃথিবীর নিষ্ক্রমণ বেগ ৭ মাইল। এইখানে যদি কোনো পদার্থ প্রতি সেকেণ্ডে ৭ মাইল অর্থাৎ ঘণ্টায় ২৫,২০০ মাইল গতিবেগ অর্জন করিতে পারে, তবে উহাকে পৃথিবী তাহার মাধ্যাকর্ষণী শক্তির দ্বারা টানিয়া রাখিতে পারে না, উহা মহাকাশে চলিয়া যায় বা চাঁদের মতো এক কক্ষপথে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করিতে থাকে। এই নিয়মের ভিত্তিতেই বিজ্ঞানীগণ আজকাল পরিচালনা করিতেছেন রকেটের সাহায্যে কৃত্রিম উপগ্রহ। অনুরূপ অন্যান্য গ্রহেরও ভিন্ন ভিন্ন রকম নিষ্ক্রমণ বেগ আছে। যথা –বুধের ২.৪, শুক্রের ৬.৫, মঙ্গলের ৩.২ ও বৃহস্পতির ৩৮.০ মাইল ইত্যাদি।[১৭]
ভূপৃষ্ঠের তাপ পরিমিত ও সহনীয়। কাজেই এইখানে জলবায়ুর সৃষ্টি হইতে পারিয়াছে এবং পৃথিবীর নিষ্ক্রমণ বেগ বেশি বলিয়া উহার সমস্তই সে ধরিয়া রাখিতে পারিয়াছে, তাই এইখানে জীবনের সৃষ্টি ও জীবের বসবাস সম্ভব হইয়াছে।
পৃথিবীর চাঁদ
আকাশের জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর মধ্যে সূর্য ভিন্ন দৃশ্যত চন্দ্ৰই সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ও উজ্জ্বল। বস্তুত চন্দ্র একটি অনুজ্জ্বল পদার্থ এবং আয়তনেও বেশি বড় নহে। চন্দ্রের ব্যাস মাত্র ২,১৬০ মাইল। অর্থাৎ পৃথিবীর ব্যাসের প্রায় এক-চতুর্থাংশের সমান। তথাপি চন্দ্রকে এতোধিক বড় দেখাইবার কারণ এই যে, অন্যান্য জ্যোতিষ্কের তুলনায় চন্দ্র পৃথিবীর অতি নিকটে অবস্থিত। চন্দ্রের নিজের কোনো আলো নাই। সূর্যালোক পতিত হইবার ফলেই উহাকে উজ্জ্বল দেখায় এবং আমরা যে চন্দ্রালোক পাইয়া থাকি, আসলে উহা চন্দ্রের আলো নহে; উহা প্রতিফলিত সূর্যালোক। অর্থাৎ চন্দ্রপৃষ্ঠে ঠিকরানো সূর্যালোক।
সেকালের লোকে চন্দ্রকে লইয়া কতরকম কাহিনীই না রচনা করিয়াছেন। চন্দ্রের কলককে কেহ বলিয়াছেন হরিণশিশু, কেহ বলিয়াছেন, ‘চাঁদের মা সুতা কাটিতেছে’ ইত্যাদি। কোনো কোনো মতে, চন্দ্রের সংখ্যা বারোটি। অর্থাৎ বারো মাসে বারো চাঁদ।
হিন্দুদের পুরাণ-শাস্ত্রমতে চন্দ্র অত্রি ঋষির পুত্র (মতান্তরে সমুদ্রমন্থনে ইহার জন্ম)। ইনি দশটি কুন্দধবল অশ্ব বাহিত রথে আকাশভ্রমণ করেন। ইনি দক্ষরাজের ২৭টি কন্যাকে বিবাহ করেন। স্ত্রীদের প্রতি অবিচার করায় তাহারা দক্ষরাজের নিকট নালিশ করিলে তিনি যে আদেশ দেন, তাহা অমান্য করায় দক্ষরাজের অভিশাপে চন্দ্র যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন এবং প্রভাসতীর্থে গিয়া শ্বশুরের আদেশ পালন করিয়া রোগমুক্ত হন। প্রবাদ আছে যে, চন্দ্র বৃহস্পতির স্ত্রী তারাকে হরণ করেন এবং তাহার গর্ভে বুধ জন্মলাভ করেন (এই মতে বুধ তারার গর্ভজাত সন্তান, তবে জারজ)।