প্রতি সেকেণ্ডে ২১.৭ মাইল, অর্থাৎ প্রায় পৌনে বাইশ মাইল পথ চলিয়া প্রায় সাড়ে সাত মাসে শুক্র একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। সুতরাং আমাদের সাড়ে সাত মাসের সমান শুক্রের এক বৎসর। শুক্র গ্রহকে সঁঝের তারা বা পোয়াতে তারাও বলা হয়। কিন্তু প্রচলিত নাম শুকতারা। শুকতারাকে সকল সময়ে দেখা যায় না। শুকতারার ভ্রমণপথ পৃথিবীর ভ্রমণপথের ভিতরে অবস্থিত। তাই সূর্য প্রদক্ষিণের সময়ে দেখা যায় যেন শুকতারা কখনও সূর্যের আগে আগে চলে এবং কখনও চলে পিছনে। যখন আগে আগে চলে, তখন প্রায় সাড়ে তিন মাস উহাকে দেখা যায় পূর্ব আকাশে সূর্য উদয়ের পূর্বে এবং যখন পিছনে চলে, তখন দেখা যায় পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্তের পরে। শুক্র পূর্ব আকাশে থাকিলে তখন তাহার নাম হয় পোয়াতে তারা এবং পশ্চিম আকাশে থাকিলে বলা হয় সাঁঝের তারা।
রাত্রের আকাশে শুক্রের মতো উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক দ্বিতীয়টি নাই। কিন্তু উহার উজ্জ্বলতা সব সময়ে সমান থাকে না। তাহার কারণ এই যে, পৃথিবীর ভ্রমণপথের ভিতরে শুক্রের ভ্রমণপথ থাকায় চন্দ্রকলার ন্যায় শুক্রকলারও হ্রাস-বৃদ্ধি এবং অমাবস্যা বা পূর্ণিমা হয়। তবে অমাবস্যা বা পূর্ণিমা ও তাহার কাছাকাছি সময়ে উহাকে দেখাই যায় না। যেহেতু ঐ সময়ে শুক্র সূর্যের প্রায় সাথে সাথেই উদিত হয় ও অস্ত যায়। কাজেই ঐ দুই সময়ে শুক্র থাকে সূর্যের আলোকসমুদ্রে ডুবিয়া। আর একটি কথা এইখানে জানিয়া রাখা ভালো যে, কেহ যদি বৃহস্পতি, শনি ইত্যাদি পৃথিবীর ভ্রমণপথের বাহিরে অবস্থিত কোনো গ্রহে বসিয়া পৃথিবীর গতিবিধি লক্ষ্য করিতে থাকেন, তবে তিনি পৃথিবীকে শুকতারার মতোই দেখিবেন এবং দেখিবেন চন্দ্রকলার মতোই তাহার কলার হ্রাস বৃদ্ধি, অমাবস্যা ও পূর্ণিমা। তবে সময়ের ব্যবধান হইবে। আমাদের চন্দ্রের অমাবস্যা ও পূর্ণিমার ব্যবধান প্রায় ১৪ দিন, শুক্রের প্রায় ৩ ১/২ মাস; কিন্তু পৃথিবীর অমাবস্যা ও পূর্ণিমার ব্যবধান হইবে প্রায় ৬ মাস।
শুক্রের দেহের বস্তুসমূহের আপেক্ষিক গুরুত্ব পৃথিবীর চেয়ে সামান্য কম। পৃথিবীর আপেক্ষিক গুরুত্ব ৫.৫২ এবং শুক্রের ৫.২১। ওজনে শুক্র পৃথিবীর ওজনের ১০০ ভাগের ৮১ ভাগের সমান। পৃথিবী ও শুক্রের নিষ্ক্রমণ বেগের ব্যবধান অল্পই। পৃথিবীর ৭ ও শুক্রের ৬ ১/২ মাইল। শুক্রের তাপ পৃথিবীর তাপের চেয়ে অনেক বেশি। যেহেতু শুক্র আছে পৃথিবীর চেয়ে সূর্যের ২ কোটি ৫৭ লক্ষ মাইল নিকটে। অধিকন্তু শুক্রে জলের নামগন্ধও নাই। যেহেতু সেখানে এখনও জলের সৃষ্টি হয় নাই। শুক্রে বাতাস আছে। কেননা শুক্রের নিষ্ক্রমণ বেগ অতিক্রম করিয়া এক কণা বাতাসও মহাকাশে পালাইতে পারে নাই। কিন্তু উহার সবই কার্বন-ডাই-অক্সাইড, সেই বাতাসে আঁটি অক্সিজেন মোটেই নাই। ইহার কারণ এই যে, শুক্রে গাছপালা নাই। উদ্ভিদেরাই কার্বন-ডাই অক্সাইড হইতে অক্সিজেন প্রস্তুত করে। আর যেখানে অক্সিজেন নাই, সেখানে কোনো জীবের অবস্থানও অসম্ভব।
বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, দূর ভবিষ্যতে শুক্রের দেহের তাপ কমিয়া পৃথিবীর তাপের কাছাকাছি হইলে সেখানে জলের অণুর সৃষ্টি হইবে এবং উদ্ভিদাদির জন্ম হইবে। তৎপর শুক্রের বাতাসে অক্সিজেনের সৃষ্টি হইলে জীবোৎপত্তির সম্ভাবনাও আছে। তবে তাহা কয়েক শত কোটি বৎসর পরের কথা। শুক্র আছে বর্তমান পৃথিবীর প্রায় আড়াই শত কোটি বৎসর আগের অবস্থায়।
পৃথিবীর তুলনায় শুক্র গ্রহের বর্তমান অবস্থা খুবই নিকৃষ্ট। কিন্তু ধর্মজগতে উহার কদর যথেষ্ট। শুক্রবারের আরাধনায় নাকি পুণ্য বেশি হয় এবং ঐদিন নাকি স্বর্গের দ্বার খোলা এবং নরকের দ্বার বন্ধ থাকে। পৌরাণিক মতে, শুক্র নাকি দৈত্যগণের গুরু। ইহার পিতার নাম ভৃগু, তাই ইহার অপর নাম ভার্গব। আবার মতান্তরে –মহেশ্বরের উপস্থ (শিবের লিঙ্গ) দ্বার হইতে বহির্গত হইয়াছে বলিয়া ইহার নাম হইয়াছে শুক্র। ইহার ছেলেমেয়ে তিনটি। ছেলের নাম ষণ্ড ও অমর্ক এবং মেয়ের নাম দেবযানী। বলি রাজার দানে ব্যাঘাত করায় ইহার একটি চক্ষু নষ্ট হয়।
এই জন্য ইহার সাধারণ নাম কাণা শুক্র। সে যাহা হউক, এই সকল বাক্যালকার চটকদার বটে, কিন্তু ইহা এখন বিজ্ঞানের বাজারে বিকায় না।
.
# ৩. পৃথিবী
ধর্মীয় মতে, পৃথিবী ঈশ্বরের এরূপ একটি বিশেষ সৃষ্টি, যাহার সমতুল্য সৃষ্টিরাজ্যে আর কিছুই নাই। কিন্তু বিজ্ঞানীগণ তাহা বলেন না। তাহারা বলেন যে, পৃথিবী নবগ্রহের একটি গ্রহ মাত্র। পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহদের মধ্যে আকৃতি ও প্রকৃতিতে বিশেষ কোনো পার্থক্য নাই। এই বিষয়ে বিজ্ঞানীগণ যাহা বলেন, তাহার কিছু আলোচনা করিতেছি।
মেরু –পৃথিবী গোল, অথচ উত্তর ও দক্ষিণ দিকে কিঞ্চিৎ চাপা। দেখা যায় যে, অন্যান্য গ্রহের আকৃতিও ঐরূপ। যথা– পৃথিবীর ব্যাস বিষুবীয় অঞ্চলে ৭,৯২৬ মাইল ও মেরু অঞ্চলে ৭,৯০০ মাইল। ঐরূপ বৃহস্পতির ব্যাস বিষুবীয় অঞ্চলে ৮৮,৭০০ মাইল ও মেরু অঞ্চলে ৮২,৭৮০ মাইল, শনির ব্যাস বিষুবীয় অঞ্চলে ৭৫,০৬০ মাইল ও মেরু অঞ্চলে ৬৭,১৬০ মাইল ইত্যাদি।
আয়তন –গ্রহদের আয়তনে ব্যবধান যথেষ্ট আছে। কিন্তু তাহা অতুলনীয় নহে। বুধ গ্রহের আয়তন পৃথিবীর আয়তনের প্রায় ১৭ ভাগের এক ভাগের সমান। কিন্তু বৃহস্পতি পৃথিবী হইতে প্রায় ১৩ শত গুণ বড়। পক্ষান্তরে শুক্র ও পৃথিবীর আয়তন প্রায় সমান। অর্থাৎ ৯ ও ১০-এ পার্থক্য যতখানি, শুক্র ও পৃথিবীর আয়তনে পার্থক্য তাহার চাইতে বেশি নহে।