বুধ গ্রহের ব্যাস ৩,০০৮ মাইল। ইহা পৃথিবীর ব্যাসের অর্ধেকেরও কম। আয়তনে বুধ পৃথিবীর তুলনায় ০.০৬; অর্থাৎ প্রায় ১৭টি বুধ একত্র করিলে তবে পৃথিবীর সমান হইতে পারে। আয়তনে বুধ সকল গ্রহের মধ্যে ছোট, এমনকি বৃহস্পতির দুইটি চাঁদের চেয়েও ছোট। বুধ গ্রহের আহ্নিক। গতি অতি ধীর, দিন ও বৎসর সমান। উহার এক অংশে চিরকাল দিন ও অপর অংশে চিরকাল রাত্রি। আমাদের চন্দ্র যেমন তাহার এক অংশ পৃথিবীর দিকে রাখিয়া পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করিতেছে, বুধও তেমনি তাহার এক অংশ সূর্যের দিকে রাখিয়া গড়ে প্রতি সেকেণ্ডে ২৯.৭ মাইল বেগে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করিতেছে। এই বেগ সব সময়ে সমান থাকে না। বুধ যখন সূর্যের কাছে থাকে, তখন তাহার চক্রবেগ হয় প্রতি সেকেণ্ডে ৩৬ মাইল এবং যখন দূরে থাকে, তখন হয় ২৪ মাইল। এইভাবে চলিয়া সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করিতে বুধের সময় লাগে পৃথিবীর হিসাবে ৮৮ দিন।
যে গ্রহ সূর্যের যত নিকটে, তাহার কক্ষভ্রমণের গতিবেগ তত বেশি এবং যে গ্রহ যত দূরে, তাহার গতিবেগ তত কম। যেমন সূর্য হইতে বুধের দূরত্ব ৩ কোটি ৬০ লক্ষ মাইল এবং তাহার কক্ষভ্রমণের গতিবেগ সেকেণ্ডে প্রায় ৩০ মাইল। আর প্লুটোর দূরত্ব ৩৬৭ কোটি মাইল এবং তাহার কক্ষভ্রমণের গতিবেগৃ সেকেণ্ডে প্রায় ৩ মাইল মাত্র।
বুধ গ্রহ খুব ছোট বলিয়া তাহার কোনো উপগ্রহ নাই। বুধ সূর্যের খুব নিকটের গ্রহ বলিয়া উহার তাপমাত্রা অত্যধিক, এমনকি ফুটন্ত জলের চেয়েও বেশি। বুধের দেহ যে, সকল মাল মশলায় তৈয়ারী, তাহার গড় ওজন অর্থাৎ বস্তুগুরুত্ব (জলের অনুপাতে) ৩.৭৩। পৃথিবীর চেয়ে বুধ হাল্কা পদার্থের তৈয়ারী। স্মরণ রাখা দরকার যে, পৃথিবীর বস্তুগুরুত্ব ৫.৫২।
বিশ্বের যে কোনো পদার্থ অপর কোনো পদার্থকে তাহার নিজের কেন্দ্রের দিকে টানে। এই টানকে বলা হয় মাধ্যাকর্ষণ শক্তি। যে পদার্থের ভর যত বেশি, তাহার মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তত বেশি। ঐ শক্তির বলেই পৃথিবী আমাদিগকে টানিয়া রাখিতেছে। উপর দিকে বন্দুক বা কামান হুঁড়িলে তাহার গুলি বা গোলা যতই উপরে উঠুক না কেন, পৃথিবী তাহাকে টানিয়া ভূপাতিত করেই। যেহেতু কোনো গুলি বা গোলার বেগ সাধারণত সেকেণ্ডে ২-৩ মাইলের বেশি নহে, তাই উহারা পৃথিবীর আকর্ষণকে অতিক্রম করিয়া যাইতে পারে না। কিন্তু কোনো গোলা বা গুলি বেগ যদি প্রতি সেকেণ্ডে ৭ মাইল হয়, তবে উহাকে পৃথিবী টানিয়া ফিরাইতে পারে না। তখন উহা পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের সীমা ছাড়াইয়া মহাকাশে চলিয়া যায়। এই রকম বেগকে বলা হয় নিষ্ক্রমণ বেগ। বুধের নিষ্ক্রমণ বেগ মাত্র ২.৪ মাইল।
সাধারণত দেখা যায় যে, কোনো পদার্থ উত্তপ্ত হইলে তাহা আয়তনে বাড়ে। উহার কারণ এই যে, উত্তপ্ত পদার্থের অণুগুলির চঞ্চলতা বাড়ে। অর্থাৎ অণুগুলির কম্পনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং পরস্পর ধাক্কাধাক্কির ফলে অণুগুলি দূরে দূরে সরিয়া যায়, ইহাতে মূল বস্তুটি আয়তনে বাড়ে। কোনো বায়বীয় পদার্থ উত্তপ্ত হইয়া উহার অণুর গতিবেগ যদি ঐ গ্রহের নিষ্ক্রমণ বেগের সমান হয়, তবে ঐ বায়বীয় পদার্থকে সেই গ্রহ টানিয়া রাখিতে পারে না। উহা মহাকাশে উধাও হইয়া যায়।
বুধ গ্রহের নিষ্ক্রমণ বেগ মাত্র ২.৪ মাইল। অত্যধিক তাপপ্রযুক্ত বুধের জল ও বায়ুর অণুগুলির গতিবেগ বুধ গ্রহের নিষ্ক্রমণ বেগের সমান বা তাহারও বেশি হইয়াছিল বলিয়া উহারা সমুদয়ই মহাকাশে উড়িয়া গিয়াছে। বুধ গ্রহে জল ও বায়ুর কোনো অস্তিত্ব নাই। কাজেই সেখানে কোনো জীব বা জীবনের অস্তিত্ব নাই।
পৃথিবীর ভ্রমণপথের ভিতরে বুধের ভ্রমণপথ। তাই মাত্র কয়েক দিনের জন্য বুধকে দেখা যায়। পশ্চিম আকাশে সূর্যাস্তের পরে এবং মাত্র কয়েক দিন পূর্বের আকাশে সূর্যোদয়ের পূর্বে। তাহাও খালি চোখে নহে, দূরবীন যোগে।
বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, বুধ ঠিক ঔরসজাত না হইলেও সূর্যের পুত্রস্থানীয়। কেননা সূর্যের দেহ হইতেই বুধ জন্মলাভ করিয়াছে। কিন্তু হিন্দুদের পুরাণে বলে অন্য কথা। পুরাণে বলে — চন্দ্রের ঔরসে ও তারার গর্ভে বুধের জন্ম হয় এবং বুধ ইলা নাম্নী এক রমণীকে বিবাহ করে। এই ঘরে বুধের এক পুত্রও জন্মে, তাহার নাম পুরুরবা। বুধ নাকি চন্দ্রবংশের আদিপুরুষ। বেশ মনোজ্ঞ কাহিনী। মৃত কি জীবিত যেভাবেই থাকুক, বুধ এখনও আকাশে আছে। কিন্তু তাহার স্ত্রী-পুত্র কোথায় গেল, তাহার কোনো হদিস নাই।
.
# ২. শুক্র
বুধের ভ্রমণপথের বাহিরে শুক্রের ভ্রমণপথ। সুতরাং শুক্র বুধের প্রতিবেশী এবং পৃথিবীরও। সূর্য হইতে শুক্রের দূরত্ব বুধের দূরত্বের প্রায় দ্বিগুণ। অর্থাৎ মোটামুটি ৬ কোটি ৭০ লক্ষ মাইল। কক্ষপথের বক্রতার দরুন এই দূরত্ব বৃদ্ধি পাইয়া কোনো সময়ে হয় ৬ কোটি ৭৫ লক্ষ মাইল, আবার কমিয়া হয় ৬ কোটি ৬৫ লক্ষ মাইল।
শুক্রের ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের চেয়ে সামান্য কম। পৃথিবীর বিষুব অঞ্চলের ব্যাস ৭,৯২৬ মাইল, কিন্তু শুক্রের ৭,৫৭৬ মাইল। অর্থাৎ পৃথিবীর ব্যাসের চেয়ে ৩৫০ মাইল কম। আয়তনে শুক্র পৃথিকর আয়তনের প্রায় দশ ভাগের নয় ভাগের সমান। শুক্রের দেহ সব সময়ে গাঢ় ধূলির মেঘে আবৃত থাকায় উহার আহ্নিক গতি আছে কি না, তাহা এখনও জানা যায় নাই।