বলিতে শুরু করিয়াছিলাম সূর্যের আকর্ষণশক্তির কথা। কোনো ব্যক্তি এক পোয়া বা এক সের ওজনের কোনো একটি পদার্থে রশি বাঁধিয়া নিজের চারিপার্শ্বে উহাকে চক্রাকারে ঘুরাইতে পারে, কিন্তু সেই ব্যক্তি নিজের বা তাহার চেয়ে বেশি ওজনের কোনো পদার্থকে ঐরূপ ঘুরাইতে পারিবে না, ঘুরাইতে চাহিলে সে নিজেই স্থানচ্যুত হইবে। সূর্য একস্থানে দাঁড়াইয়া তাহার আকর্ষণের রশিতে বাধিয়া গোটা এগারো গ্রহকে প্রতিনিয়ত ঘুরাইতেছে। ইহা সহজ ব্যাপার নহে। কোলের কাছে যে বুধ গ্রহটি আছে, তাহাকে ঘুরানো সহজ হইলেও প্রায় ২৮০ কোটি মাইল দূরে অবস্থিত ১৭টি পৃথিবীর সমান ওজনের নেপচুন গ্রহটিকে ঘুরাইতে যে কতটুকু শক্তির দরকার, তাহা ভাবিলে বিস্ময়ে অভিভূত হইতে হয়। সূর্যের শক্তি কম্পনার অতীত। কিন্তু সূর্যগ্রহণের ব্যাখ্যাকম্পে পৌরাণিকগণ এত অধিক শক্তিশালী সূর্যটিরও রাহুর হস্তে পরাজয় ঘটাইয়াছেন। বস্তুত সূর্যগ্রহণের আধুনিক তথ্য নিম্নরূপ।
আকাশ বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, সূর্যকে কেন্দ্র করিয়া প্রায় ৯ কোটি ৩০ লক্ষ মাইল দূরে থাকিয়া ৩৬৫ দিন ৬ ১/৪ ঘণ্টায় পৃথিবী একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করিতেছে এবং পৃথিবীকে কেন্দ্রে রাখিয়া প্রায় ২ লক্ষ ৩৯ হাজার মাইল দূরে থাকিয়া প্রায় ২৯ ১/২ দিনে চন্দ্র একবার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করিতেছে। এই ঘোরাফেরায় কোনো কোনো সময়ে চন্দ্র, সূর্য ও পৃথিবী এক সরলরেখায় দাঁড়ায়। সেই সময়ে পূর্ণিমা তিথি হইলে চন্দ্র ও সূর্যের মাঝখানে পৃথিবী অবস্থান করার ফলে পৃথিবীর ছায়া চন্দ্রে পতিত হইয়া চন্দ্রকে ঢাকিয়া ফেলে, আমরা উহাকে চন্দ্রগ্রহণ বলি এবং ঐ সময়ে অমাবস্যা তিথি হইলে পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে চন্দ্র দাঁড়াইয়া সূর্যকে ঢাকিয়া রাখে, আমরা উহাকে সূর্যগ্রহণ বলি। আসলে চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ হইল পৃথিবী ও চন্দ্রের ছায়ামাত্র; রাহু, কেতু বা অন্য কিছু নহে।
.
# মৃত্যু
পৌরাণিকগণ বলেন –ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, কার্তিক, গণেশ, ইন্দ্র, চন্দ্র, সূর্য এবং লক্ষ্মী, সরস্বতী, কালী, দুর্গা ইত্যাদি দেব-দেবীগণ সকলেই অমৃত পান করিয়া অমর হইয়াছিলেন। কিন্তু চন্দ্র ও সূর্যদেব ছাড়া বিশ্বের কোথায়ও উহাদের অন্য কাহারও কোনো খোঁজ-খবর মিলিতেছে না। সম্ভবত উহাদের সকলেরই তিরোধান ঘটিয়াছে। তবে কি চন্দ্র ও সূর্যদেব বাস্তবিকই অমর?
আকাশ বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, চন্দ্রদেবের মৃত্যু ঘটিয়াছে লক্ষ লক্ষ বৎসর পূর্বে। আমরা এখন দেখিতেছি মৃত চন্দ্রের ককাল। চন্দ্রদেবের গায়ে এখন তাপ নাই, রক্ত (জল) নাই; অধিকন্তু তাহার শ্বাস-প্রশ্বাস (বায়ু) নাই। আর জল, বায়ু ও তাপ নাই বলিয়া চন্দ্রদেবের মরদেহে একটি কীটও (প্রাণী) নাই। চন্দ্রদেব এখন বাস্তবিকই নির্জীব। সূর্যদেবের মৃত্যু সম্বন্ধে বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা রহিয়াছে ‘প্রলয়’ পরিচ্ছেদে।
০৮. গ্রহমণ্ডলী
গ্রহমণ্ডলী
ধর্মীয় মতে, বিশ্বে বিশালতায় মাতা বসুন্ধরার সমকক্ষ আর কেহ নাই এবং তাহাররকোনো দোসর নাই। কিন্তু বিজ্ঞানীদের মতে, বিশাল বিশ্বে আমাদের বসুমাতা একটি বালুকণা সদৃশও নহেন এবং বসুমাতা তাঁহার পিতার একমাত্র কন্যাও নহেন। হঁহারা সহোদর ভাই-ভগিনীতে বর্তমানে এগারো জন, অর্থাৎ এগারো গ্রহ।
বহুদিন পূর্ব হইতেই মানুষ কয়েকটি গ্রহের সন্ধান জানিত। তাহারা নক্ষত্র হইতে গ্রহদের পার্থক্য করিত শুধু উহাদের আলোতে ও গতিতে। তাহারা দেখিত যে, নক্ষত্রদের আলো মিটমিট করে আর গ্রহদের আলো স্থির এবং নক্ষত্ররা আকাশের বিশেষ স্থানে স্থায়ীভাবে বাস করে, কিন্তু গ্রহরা চলাফেরা করে। ইহা ভিন্ন গ্রহদের সম্বন্ধে তাহাদের আর বেশি কিছু জানা ছিল না।
বিজ্ঞানী জিনস ও জেফরিজ-এর মতে –প্রায় তিন শত কোটি বৎসর আগে (কোনো কোনো মতে পাঁচ শত কোটি বৎসর) কোনো একটি নক্ষত্র সূর্যের খুব নিকট দিয়া চলিয়া যাওয়ায় তাহার আকর্ষণে (কোনো মতে কেন্দ্ৰাপসারণী শক্তির প্রভাবে) সূর্যের দেহের খানিকটা অংশ বিচ্ছিন্ন হইয়া যায় এবং তাহা হইতে পৃথিবীসহ এগারোটি গ্রহের সৃষ্টি হয়। পূর্বেই বলা হইয়াছে যে, সূর্য একটি অগ্নিপিণ্ড, উহার কেন্দ্রীয় অঞ্চলের তাপমাত্রা চারি কোটি ডিগ্রী সে. এবং বাহিরের অংশের তাপমাত্রা ছয় হাজার ডিগ্রী সে.। তাই গ্রহগণের জন্ম হইবার সময়ে তাহাদের কাহারও দেহের তাপ ছয় হাজার ডিগ্রীর কম ছিল না। আয়তন ও সূর্য হইতে দূরত্বের তারতম্যানুসারে দেহের তাপ ত্যাগ করিয়া কালক্রমে গ্রহরা ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় পৌঁছিয়াছে। সে যাহা হউক, আকাশ বিজ্ঞানীগণ গ্রহদের বর্তমান অবস্থার যে বিবরণ দিতেছেন, তাহার কিছু আলোচনা করিতেছি।
সচরাচর দেখা যায় যে, একই পিতার ঔরসজাত সন্তানদের মধ্যে আকৃতি ও প্রকৃতিগত কিছু না কিছু সাদৃশ্য থাকেই। বিজ্ঞানীদের মতে, গ্রহরা একই পিতার ঔরসজাত সন্তান। তাই যদি হইয়া থাকে, তবে উহাদের আকৃতি ও প্রকৃতিতে কিছু না কিছু সাদৃশ্য থাকা উচিত। এখন দেখা যাক যে, উহা কতদূর আছে।
.
# ১. বুধ
গ্রহ মাত্রই গোলাকার। কিন্তু সম্পূর্ণ গোল কেহই নহে। প্রত্যেক গ্রহেরই মেরুপ্রদেশ চাপা এবং এক গোলাকার কক্ষপথে নির্দিষ্ট সময়ে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। কিন্তু কোনো গ্রহের ঐ পথটি সম্পূর্ণ গোল নহে, দুইদিকে কিঞ্চিৎ চাপা, অর্থাৎ ডিম্বাকার; সূর্য আছে উহার কেন্দ্রবিন্দু হইতে একদিকে সামান্য সরিয়া। ইহাতে গ্রহগণ চলিবার সময়ে সূর্য হইতে উহাদের দূরত্ব সমান থাকে না, বাড়ে ও কমে। বুধ সূর্যের নিকটতম গ্রহ। সূর্য হইতে বুধ গ্রহের মোটামুটি দূরত্ব ৩ কোটি ৬০ লক্ষ মাইল। কিন্তু এই দূরত্ব বৃদ্ধি পাইয়া কোনো সময়ে হয় ৪ কোটি ৩৫ লক্ষ মাইল, আবার কমিয়া হয় ২ কোটি ৮৫ লক্ষ মাইল।