বিজ্ঞানীগণ দেখিয়াছেন যে, যে সকল কলঙ্ক মাসাধিককাল স্থায়ী হইয়া থাকে, উহারা সূর্যের এক প্রান্ত হইতে উদিত হইয়া অপর প্রান্তে অস্ত যায়। তাহারা আরও লক্ষ্য করিয়াছেন যে, কোনো একটি বিশেষ কলক একবার সূর্যকে আবর্তন করিয়া ২৭ দিনে পুনঃ স্বস্থানে ফিরিয়া আসে। তাই তাঁহারা বলেন যে, পৃথিবীর আহ্নিক গতির ন্যায় সূর্যেরও একটি গতি আছে। নিজ মেরুদণ্ডের উপর একবার আবর্তিত হইতে যেমন পৃথিবীর সময় লাগে ২৪ ঘণ্টা, তেমন সূর্যের লাগে ২৭ দিন। আপাতদৃষ্টিতে স্থির দেখা গেলেও আসলে সূর্য আবর্তনশীল।
বর্ণমণ্ডল ও ছটামণ্ডল আমরা সূর্যের যে চেহারা দেখিতে পাই, তাহা হইল তাহার আসল দেহের উপর আলোকমণ্ডলের আচ্ছাদন। ইহার উপর তাহার আরও দুইটি আবরণ আছে। কিন্তু আলোকমণ্ডলের প্রচণ্ডতায় তাহা আমাদের নজরে পড়ে না। সূর্যগ্রহণের সময়ে যখন আলোকমণ্ডল ঢাকা পড়ে, তখন অল্প সময়ের জন্য বর্ণমণ্ডল ও ছটামণ্ডলকে দূরবীক্ষণ দ্বারা স্পষ্ট দেখা যায়। বর্ণমণ্ডলের গভীরতা ৩–১০ হাজার মাইল। দাউদাউ করিয়া সেখানে আগুন জ্বলে। সময়ে সময়ে তাহার কোনো কোনো শিখা সূর্যের আকাশে ৫০ হাজার মাইল পর্যন্ত উর্ধে উঠিয়া থাকে। ১৮৯২ খ্রীস্টাব্দে যে সূর্যগ্রহণটি হইয়াছিল, তখন বিজ্ঞানীগণ একটি শিখাকে প্রায় আড়াই লক্ষ মাইল উঁচু হইতে দেখিয়াছিলেন। বাস্তবিকই সূর্যের দেহটি আগুন দিয়া গড়া এবং সেখানে নিয়ত চলিতেছে আগুনের প্রবল বন্যা।
বর্ণমণ্ডলের পরে আছে ছটামণ্ডল। এইখানেও নানাবিধ বাষ্প জ্বলিয়া থাকে। তবে ইহার তাপ অপেক্ষাকৃত মৃদু। অন্য দুই মণ্ডলের ন্যায় এই মণ্ডলের গভীরতা পাঁচ-দশ হাজার মাইল নহে, লক্ষ লক্ষ মাইল ইহার গভীরতা। ১৮৭৮ সালে বিজ্ঞানীরা সূর্যগ্রহণের সময়ে সূর্যের এক কোটি মাইল দূরে ছটামণ্ডল দেখিয়াছিলেন।
.
# উপকারিতা
বিজ্ঞানীদের মতে, সৌররাজ্যের বস্তুসমূহের বৃহত্তম গ্রহ-উপগ্রহ হইতে ক্ষুদ্রতম অণু-পরমাণু পর্যন্ত, সবই সূর্য হইতে উদ্ভূত, এমনকি প্রাণও। সৌরশক্তির প্রভাবে আবহাওয়ার বিবর্তনের ফলে এককালে পৃথিবীতে এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হইয়াছিল, যখন সাগরজলে সৃষ্টি হইয়াছিল কলয়ডাল সলিউশন নামক আদিম জৈব পদার্থের। সেই জৈব পদার্থটি হইতে ধাপে ধাপে নানাবিধ জীবের উৎপত্তি হইয়াছে এবং কিভাবে হইয়াছে, তাহার কিছু আলোচনা করা হইবে পরবর্তী এক পরিচ্ছেদে। কিন্তু শুধু জীবন উৎপত্তির জন্যই নহে, জীবনের রক্ষার জন্যও সৌরশক্তি অপরিহার্য।
প্রত্যক্ষভাবে সূর্য আমাদের দুইটি বস্তু দান করিয়া থাকে –তাপ ও আলো। এই আলোই জীবের চক্ষু দান করিয়াছে, আবার সেই চক্ষু আলোর মাধ্যমে জগত প্রত্যক্ষ করিতেছে। এই বিষয়টি বোধ হয় আর একটু বাড়াইয়া বলা আবশ্যক। অ্যামিবা বা স্পঞ্জের মতো ইন্দ্রিয়বিহীন জীবের পর্যায় পার হইয়া যে সকল জীব আলোর সংস্পর্শে বাস করিতেছিল, তাহাদের দেহের এক শ্রেণীর কোষ (cell) আলোক গ্রহণে উন্মুখ হয় এবং লক্ষ লক্ষ বৎসর সমবেত চেষ্টার ফলে দুর্শনেন্দ্রিয়ের উৎপত্তি হয়। পক্ষান্তরে যাহারা আলোর সংস্পর্শলাভে বঞ্চিত হইয়াছিল, তাহারা হয় চক্ষুহীন বা অন্ধ। যেমন কেঁচো, উইপোকা ইত্যাদি। এই দর্শনেন্দ্রিয়ের দ্বারা আলোর মাধ্যমে জীব বিশেষত মানুষ উপভোগ করিতেছে জগতের যত সব রূপমাধুরী। হীরকের ঔজ্জ্বল্য, স্বর্ণের চাকচিক্য, পুষ্পের সৌন্দর্য ও রমণীর কান্তি –আলোকের অভাবে সমস্তই মিশিয়া যাইত এক অব্যক্ত অন্ধকারে। পক্ষান্তরে সে অন্ধকার উপভোগ করিবার মতো একটি প্রাণীও থাকিত না পৃথিবীতে, যদি সূর্য তাপ বিতরণ না করিত।
সূর্যের তাপে সমুদ্ৰাদির জল বাষ্পে পরিণত হইয়া আকাশে উঠিয়া মেঘ হয় এবং সূর্যের তাপে বায়ু গতিশীল হয়। তাই বায়ুপ্রবাহের দ্বারা জলভাগের উপরিস্থিত মেঘরাশি স্থলভাগে নীত হয় এবং বৃষ্টিপাত হয়। সেই বৃষ্টিপাতের ফলে ভূপৃষ্ঠে নানারূপ তরু-তৃণ জন্মায় এবং সূর্যালোকপ্রাপ্তির ফলে বৃক্ষপত্রে ক্লোরোফিল জন্মিয়া উদ্ভিদের খোরাকি জোগায় ও দেহ পুষ্ট করে (পরবর্তীতে ক্লোরোফিল সম্বন্ধেও আলোচনা করা হইবে)। নিরামিষভোজী জীবেরা সেই তরুরাজির পাতা-পল্লব ও ফলমূলাদি ভক্ষণ করিয়া জীবন ধারণ করে এবং আমিষভোজী জীবেরা নিরামিষভোজীদের মাংস ভক্ষণ করিয়া বাঁচিয়া থাকে। মূলত পৃথিবীকে সজীব করিয়া রাখিয়াছে একমাত্র সূর্য।
.
# শক্তি
সূর্য নিয়ন্ত্রণ করে গ্রহজগতের বিশেষত পৃথিবীর সব কিছু –প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে, মুখ্য বা গৌণভাবে। বলা যায় যে, সৌরজগতের পার্থিব বা অপার্থিব যাবতীয় শক্তির উৎসই হইল সূর্য। শক্তি বিকাশের কয়েকটি বিশেষ রূপ আছে। যেমন –তাপশক্তি, আলোকশক্তি, বিদ্যুৎশক্তি, মহাকর্ষশক্তি ইত্যাদি। এইখানে সূর্যের মহাকর্ষশক্তি সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করা যাইতেছে।
মহাকর্ষের নিয়ম মাফিক জগতের প্রতিটি বস্তু একে অন্যকে আকর্ষণ করে। আকর্ষণী শক্তির ন্যূনাধিক্য নির্ভর করে বস্তুদ্বয়ের ওজন ও দূরত্বের উপর। যে বস্তুর ওজন যত বেশি, তাহার আকর্ষণী শক্তি তত অধিক। পক্ষান্তরে বস্তুদ্বয়ের দূরত্ব বৃদ্ধি পাইলে আকর্ষণী শক্তি কমিয়া যায়। ভূপৃষ্ঠের যাবতীয় বস্তুর চেয়ে পৃথিবী ওজনে ভারি। তাই ভূপৃষ্ঠের সকল বস্তুকে সে নিজের কোলের দিকে টানিয়া রাখিতেছে, এমনকি বাতাসকেও। তাই সম্ভব হইয়াছে ভূপৃষ্ঠে জীবাদি বস্তুসমূহের স্থিতি। পৃথিবী যদি টানিয়া না রাখিত, তবে বায়ুসমেত মানুষ, পশু-পাখি ও বৃক্ষাদি নিমেষে মহাশূন্যে উড়িয়া যাইত, এমনকি বালুকণাও। আর যদি বায়ু থাকিত আকর্ষণমুক্ত, তবে পৃথিবীর আহ্নিকগতির ফলে ভূপৃষ্ঠে প্রতি ঘণ্টায় ১,০৪১২ মাইল বেগে পশ্চিম দিকগামী ঝড় বহিত। কেননা পৃথিবীর আহ্নিকগতি বা আবর্তনের ফলে ভূপৃষ্ঠ উক্ত বেগে পূর্বদিকে সরিয়া যাইতেছে। সেই প্রলয়ঙকরী ঝড়ের মুখে ভূপৃষ্ঠে টিকিয়া থাকিত না কোনো পর্বতও। বস্তুত পৃথিবীর সমস্ত সৌরভ-গৌরবের মূলে নিহিত রহিয়াছে তাহার মহাকর্ষশক্তি। অনুরূপভাবে সূর্য স্বীয় আকর্ষণে বাঁধিয়া তাহার চতুর্দিকে পৃথিবীকে ঘুরাইতেছে। আর তাহারই ফলে হইতেছে দিন রাত্রি, ঋতু-বৎসর এবং বজায় থাকিতেছে পৃথিবীতে জীববাসের অনুকূল আবহাওয়া। যদি সূর্যের আকর্ষণ না থাকিত, তবে পৃথিবী ছুটিয়া চলিত অনির্দিষ্ট মহাশূন্যে। সেখানে পৃথিবী হইত অন্ধকার শৈত্যরাজ্যে জনপ্রাণীহীন একটি বস্তুপিণ্ড।