আধুনিক সৌরবিজ্ঞানীগণ সূর্য সম্বন্ধে এত অধিক তথ্য সংগ্রহ করিয়াছেন যে, এই ক্ষুদ্র পুস্তকে সেই সব আলোচনা করা অসম্ভব। এইখানে মাত্র গুটিকতক তথ্যের সারাংশের সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রদত্ত হইল।
আকার আপাতদৃষ্টিতে সূর্যকে একখানা থালার মতো চ্যাপ্টা-গোল দেখা যায়। কিন্তু আসলে সূর্য থালাকৃতি নহে, ফুটবলের মতো গোল। তবে আয়তনে বৃহৎ এক অগ্নিপিণ্ড।
আয়তন আমাদের পৃথিবীর তুলনায় সূর্য আয়তনে প্রায় ১৩ লক্ষ গুণ বড়। সূর্যের ব্যাস প্রায় ৮ লক্ষ ৬৪ হাজার মাইল। ইহা পৃথিবীর ব্যাসের প্রায় ১০৮ গুণ। পৃথিবী হইতে সূর্য আয়তনে যত বড়, ওজনে তত বেশি নহে। ইহার কারণ এই যে, যে বাষ্পরাশি দ্বারা সূর্যের দেহ গঠিত, তাহার ওজন পৃথিবীর মাটির ওজনের ১ অংশ মাত্র। তথাপি সূর্যের ওজন প্রায় ২ x ১০২৭ টন। অর্থাৎ দুই-এর ডাহিনে সাতাশটি শূন্য।
আমাদের পৃথিবীর পরিধি প্রায় ২৫ হাজার মাইল। ঘণ্টায় ৫০ মাইল বেগবিশিষ্ট কোনো যানে আরোহণ করিয়া একবার ইহাকে প্রদক্ষিণ করিতে সময় লাগে প্রায় ২১ দিন। কিন্তু ঐরকম বেগবিশিষ্ট কোনো যানে আরোহণ করিয়া সূর্যকে প্রদক্ষিণ করিতে চাহিলে সময় লাগিবার কথা প্রায় ৭ বৎসর। কিন্তু এত বড় বস্তুটিকেও দেখা যায় একখানা থালার মতো। ইহার কারণ এই যে, সূর্য বহুদূরে অবস্থিত।
দূরত্ব পৃথিবী হইতে সূর্যের মোটামুটি দূরত্ব ৯ কোটি ৩০ লক্ষ মাইল। এই দূরত্বটি লিখিতে বা পড়িতে সময় লাগে দুই-এক সেকেণ্ড মাত্র। কিন্তু পূর্বোক্ত বেগবিশিষ্ট কোনো যানে আরোহণ করিয়া পৃথিবী হইতে সূর্যে পৌঁছিতে সময় লাগিবে প্রায় ২১৩ বৎসর। অর্থাৎ পলাশীর যুদ্ধের সময় (১৭৫৭) পৃথিবী হইতে যাত্রা করিতে পারিলে সূর্যে পৌঁছান যাইত বাংলাদেশ স্বাধীন হইবার আগের বৎসর (১৯৭০)।
অবস্থা সাধারণভাবে সূর্যকে একটি উজ্জ্বল নিরেট পদার্থ বলিয়া মনে হয়। কিন্তু সূর্য একটি নিরেট পদার্থ নহে, উহার সমস্তটিই জ্বলন্ত বাম্প। সৌরবিজ্ঞানীগণ বলেন যে, সূর্যের আসল দেহটি সম্ভবত তরল বা ঘন বাষ্প দিয়া গড়া এবং উহা অনুজ্জ্বল। কিন্তু সাধারণত উহা আমাদের নজরে পড়ে না। আমাদের পৃথিবীকে ঘিরিয়া যেমন একটি বায়ুমণ্ডল আছে, সূর্যকে ঘিরিয়া সেইরূপ তিনটি বাষ্পীয় আবরণ আছে। যথা –আলোকমণ্ডল (Photosphere), বর্ণমণ্ডল (Chromosphere) ও ছটামণ্ডল (Corona)।
আলোকমণ্ডল পৃথিবীর নদী-সমুদ্ৰাদির জল যেমন বাষ্প হইয়া আকাশে উঠিয়া ঠাণ্ডা হইয়া মেঘে রূপান্তরিত হয়, সূর্যের আলোকমণ্ডল এইরকম মেঘের মতোই কিছু। তবে উহা পৃথিবীর মেঘের মতো ঠাণ্ডা ও অনুজ্জ্বল নহে। উহা সর্বদা জ্বলিয়া-পুড়িয়া প্রচণ্ড তাপ দেয়। সূর্য হইতে আমরা যে তাপ ও আলো পাইয়া থাকি, তাহা এই আলোকমণ্ডল হইতেই আসে। এই তাপ সম্বন্ধে কোনো একজন বিজ্ঞানী বলিয়াছেন যে, যদি সমস্ত সূর্যটিকে ৭০ ফুট গভীর বরফ দ্বারা মোড়া হয়, তবে সূর্যের তাপে তাহা এক মিনিটে গলিয়া যাইতে পারে। আর একজন বিজ্ঞানী বলিয়াছেন যে, সূর্যপৃষ্ঠের ৩ x ৩ ফুট জায়গা হইতে এক ঘণ্টায় যে পরিমাণ তাপ নির্গত হয়, পৃথিবীতে ঐ পরিমাণ তাপ উৎপন্ন করিতে হইলে কয়লা পোড়াইতে হইবে ১৭০ মণ।
উনুনের আগুনের তাপ সাধারণত গজখানেকের বেশি দূরে ছড়ায় না এবং শহর-বন্দরে যে সব বড় বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়া থাকে, তাহার তাপও দুই-একশত গজের বেশি দূরে অনুভূত হয় না। জাপানের নাগাসাকি ও হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের ফলে যে অভূতপূর্ব উত্তাপের সৃষ্টি হইয়াছিল, তাহার রেশও বাংলাদেশে আসিয়া পৌঁছে নাই। কিন্তু নয় কোটি ত্রিশ লক্ষ মাইল দূর হইতে আসিয়া সূর্যোত্তাপ আমাদের অতিষ্ঠ করিয়া তোলে। বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, আলোকমণ্ডলের তাপ অর্থাৎ সূর্যের পৃষ্ঠের তাপের পরিমাপ ৬ হাজার ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড এবং কেন্দ্রপ্রদেশের তাপ ৪ কোটি ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড।
কোনোরূপ তৈলাক্ত পদার্থ বা কাষ্ঠাদি জ্বালাইয়া আমরা অগ্নি উৎপাদনপূর্বক তাহার আলো ব্যবহার করিয়া থাকি এবং বিজ্ঞানীগণ বৈদ্যুতিক আলো, গ্যাসবাতির আলো ইত্যাদি অনেক রকম আলো উৎপন্ন করেন। কিন্তু সূর্যালোকের সমকক্ষ আলো আজ পর্যন্ত কেহই সৃষ্টি করিতে পারেন নাই। কেহ কেহ বলেন যে, সূর্যের আলো ছয় লক্ষ পূর্ণচন্দ্রের আলোকের সমান।
সৌরকলঙ্ক— চন্দ্রের কলকের ন্যায় সূর্যেরও কলঙ্ক আছে। এ সম্বন্ধে জ্যোতির্বিদগণ বলেন যে, সূর্যের আলোকমণ্ডলে সর্বদা আগুনের ঝড় হয় এবং সেই ঝড়ের তাণ্ডবে আলোকমণ্ডলের কোনো কোনো স্থান ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হইয়া যায়। সেই বিচ্ছিন্ন স্থান বা ফাঁক দিয়া সময়ে সময়ে সূর্যের অনুজ্জ্বল আসল দেহ দৃষ্টিগোচর হয়। ইহাই সূর্যের কলক। চন্দ্রের কলঙ্কের ন্যায় সূর্যের কোনো কলক চিরস্থায়ী নহে। সূর্যপৃষ্ঠে কোথাও কোনো কলঙ্ক দেখা দিলে উহা কয়েক দিন বা কয়েক মাস থাকিয়া মিলাইয়া যায়, আবার কোথায়ও নূতন কলঙ্ক দেখা দেয়। এগারো বৎসর পর পর সৌরকলক বৃদ্ধি পাইয়া থাকে। কিন্তু কেন যে এগারো বৎসরে একবার সৌরকলঙ্ক বাড়ে, তাহা এখনও অজ্ঞাত।
স্বাভাবিক অবস্থায় সূর্যের আলোকমণ্ডল হইতে যে পরিমাণ তাপ ও আলো বিকীর্ণ হইয়া থাকে, সৌরকলঙ্ক বৃদ্ধি পাইলে তখন আর সেই পরিমাণ তাপ ও আলো বিকীর্ণ হইতে পারে না, কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটিয়া থাকে। শোনা যায় যে, কোনো একজন বিজ্ঞানী একটি গাছের গুঁড়ি পর্যবেক্ষণ করিবার সময়ে দেখিলেন যে, খুঁড়িটির কেন্দ্র হইতে স্তরে স্তরে তাহার আয়তন বৃদ্ধি পাইয়াছে। স্তরগুলি সম্ভবত খুঁড়িটির বার্ষিক বৃদ্ধির চিহ্ন। তিনি আরও দেখিলেন যে, প্রতি এগারোটি স্তরের পর এমন একটি বিশেষ স্তর দৃষ্ট হয়, যাহা অন্য সকল স্তর হইতে ভিন্ন ধরণের। তিনি জানিতেন যে, প্রতি এগারো বৎসর পর পর সৌরকলঙ্ক বাড়ে। তাই তিনি সিদ্ধান্ত করিলেন যে, সেই গুঁড়িটির ঐ বিশেষ স্তরগুলি হয়তো সৌরকলঙ্কেরই প্রতিক্রিয়ার ফল। সৌরকলঙ্ক পৃথিবীর আবহাওয়ার উপর প্রভাব বিস্তার করিয়া থাকে।