শাস্ত্রোক্ত সূর্যদেবের স্ত্রী-পুত্ররা বোধ হয় যে, যমভিন্ন বুড়া হইয়া সকলেই মারা গিয়াছে। কিন্তু তাঁহার নিজের আজও যৌবনকাল।
হিন্দু মতে, লক্ষ্মী ও সরস্বতীর মতো সূর্যও একজন দেবতা। লক্ষ্মী দেবী মানুষকে ধনরত্ন, সরস্বতী বিদ্যা-বুদ্ধি এবং সূর্যদেব তাপ ও আলো দান করিয়া থাকেন। লক্ষ্মী বা সরস্বতী দেবী কাহাকে কি পরিমাণ ধনরত্ন বা বিদ্যা-বুদ্ধি দান করিয়াছেন, কোনো ব্যক্তি তাহা পরিমাপ করিয়া দেখিতে পারে নাই। কিন্তু সূর্যদেব যে তাপ ও আলো দান করিতেছেন, তাহা পরিমাপ করা হইয়াছে; তবে তাহার উপকারিতা অপরিমেয়। তাই হিন্দুগণ অন্যান্য দেব-দেবীর পূজা করেন। বৎসরে মাত্র একদিন, আর সূর্যদেবের পূজা করেন সংবৎসর, প্রতিদিন। এই পরমপূজ্য সূর্যদেবেরও সময় সময় একটি বিপদ আসে, তাহা হইল রাহুর গ্রাস বা গ্রহণ।
সূর্যগ্রহণ সম্বন্ধে হিন্দুদের পৌরাণিক আখ্যান এইরূপ — সমুদ্রমন্থনকালে রাহু ও কেতু নামক দৈত্যদ্বয় উপস্থিত না থাকায় উহারা সমুদ্রোখিত অমৃত-এর অংশ পায় নাই। যখন উহারা উপস্থিত হইল, তখন সমস্ত অমৃত দেবগণ বণ্টন করিয়া নিয়াছিলেন। অমৃতের অংশ না পাইয়া রাগান্ধ হইয়া কেতু চন্দ্রকে ও রাহু সূর্যকে গ্রাস করিয়া থাকে এবং কিয়ৎক্ষণ পরে আবার উদগীরণ করিয়া দেয়।
গ্রহণের সময় ইষ্টদেবের দুর্দশা দেখিয়া কিছুটা ভীত ও সন্ত্রস্ত হইয়া হিন্দুগণ উঁহার বিপদ ও দুর্দশা মোচনের জন্য নানারূপ কোশেশ করিয়া থাকেন। আর্যরা হয়তো মনে করিতেন যে, রাহুর গ্রাসে পতিত হইয়া সূর্যদেব অতিশয় কষ্ট ভোগ করিতেছেন। অচিরে তাহাকে গ্রহণমুক্ত করিতে না পারিলে হয়তো তিনি মারাও যাইতে পারেন এবং তৎফলে বিশ্বজীবের বিশেষত মানব জাতির অমঙ্গল ঘটিতে পারে। তাই মানবকল্যাণ ও সূর্যদেবের আশুমুক্তির উদ্দেশ্যে আর্যরা করিয়াছেন হুলুধ্বনি, ঘণ্টা ও কাঁসর বাদন, গঙ্গাস্নান এবং কুম্ভমেলায় যাওয়ার ব্যবস্থা। আর তাহাদের এক সারিতে দাঁড়াইয়া মুসলমানগণ করিয়াছেন কসুফ ও খসুফ নামক নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা।
প্রাচীন মিশরীয়রা যখন নীলনদে নৌবিহার করিত, তখন আকাশের নীল রং দেখিয়া তাহারা ভাবিত –আকাশ যখন নীলবর্ণ, তখন উহাও হইবে একটি নদী বা সমুদ্র। কিন্তু ঐ নীল সাগরে সূর্যদেব চলে কি রকম? অত বড় সমুদ্র প্রত্যহ সঁতরাইয়া পার হওয়া সম্ভব নহে। বোধ হয় সূর্যদেব আমাদের মতোই রোজ রোজ নৌকায় ভ্রমণ করেন।
মুসলমানগণ বলিয়া থাকেন যে, সুর্যের বাহন নৌকা (বোধ হয় যে, ইহা প্রাচীন মিশরীয়দেরই অনুকরণ)। মুসলমানগণ আরও বলিয়া থাকেন যে, চতুর্থ আসমানে একখানা সোনার নৌকায় সূর্যকে রাখিয়া ৭০ হাজার ফেরেশতা সূর্যসহ নৌকাখানা টানিয়া পুর্ব হইতে পশ্চিম দিকে লইয়া যায়। সারারাত সুর্য আরশের নিচে বসিয়া
আল্লাহর এবাদত করে এবং প্রাতে পুনরায় পূর্ব দিকে হাজির হয়। এককালে মানুষের ধারণা ছিল যে, আকাশ একটি ছাদের মতো এবং চন্দ্র-সূর্য ও তারকারা তাহার গায়ে লটকানো আছে। তখন প্রশ্ন হইল, উহারা চলিতেছে কিভাবে? উত্তরে সেকালের পণ্ডিতগণ বলিলেন, আকাশ ঘোরে। আবার প্রশ্ন হইল, কেন ঘোরে? উত্তর হইল, বাতাসে। এই সম্বন্ধে আমাদের অঞ্চলে একটি পল্লীগীতি আছে। উহার ধূয়াটি এইরূপ —
হাওয়ার জোরে আসমান ঘোরে।
সঙ্গে লইয়া শেতারা,
গুরুর বাক্য শুনিয়া লও তোরা।
ইহার পর আবার প্রশ্ন উঠিল, আকাশ ঘুরিলে, চন্দ্র, সূর্য ও তারকারা একই গতিতে চলিত, উহারা ভিন্ন ভিন্ন গতিতে চলে কেন? ইহার উত্তর দিলেন ধর্মগুরুরা, বলিলেন –উহাদিগকে স্বর্গদূতেরা টানে।
পরবর্তীকালের যুক্তিবাদীরা সাব্যস্ত করিলেন যে, আকাশ ঘোরে বটে, তবে উহা সংখ্যায় একটি নহে, কয়েকটি। তাহারা দেখিলেন যে, চন্দ্র, সূর্য ও তারাদের চলিবার গতি ভিন্ন ভিন্ন, সুতরাং উহারা ভিন্ন ভিন্ন তিন আকাশে অবস্থিত। আবার তারাদের মধ্যে চারিটি বিশেষ তারা (গ্রহ) যথা–শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনি– ইহাদের চলিবার গতি ভিন্ন ভিন্ন। সুতরাং উহারাও ভিন্ন ভিন্ন চারি। আকাশে অবস্থিত। কাজেই আকাশ সাতটি। বোধহয় যে, এইরূপ ধারণার ফলেই ‘সপ্ত আকাশ’ কথাটির উৎপত্তি হইয়াছিল। বলা বাহুল্য যে, তখনকার লোকে বুধ বা অন্যান্য গ্রহদের বিষয়ে কিছুই জানিতেন না।
.
# আধুনিক মতবাদ
পুরানো ধারণা ও ধর্মীয় মতবাদের মূলে ছিল অলীক কল্পনা ও অন্ধবিশ্বাস। অন্ধবিশ্বাসের মূলে প্রথম আঘাত দিলেন পিথাগোরাস নামক একজন গণিতজ্ঞ প্রায় আড়াই হাজার বৎসর আগে। তিনি বলিলেন, সূর্য পৃথিবীকে আবর্তন করে না, সূর্যকে আবর্তন করে পৃথিবী। প্রায় চারিশত বৎসর পূর্বে পুরানো ভ্রান্ত মতবাদের অপনোদন করিয়া বহুল খাঁটি সত্যের সন্ধান দেন রোম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কোপারনিকাস। ইহার একশত বৎসর পরে গ্যালিলিও দূরবীন আবিষ্কার করিয়া জ্যোতিষ্কলোকের জটিল রহস্যোদঘাটনের দ্বার খুলিয়া দেন। ধর্মীয় কোনো মতবাদের বিরুদ্ধে সত্যের সন্ধান করা ছিল তখন গুরুতর অপরাধ (কতকটা আজও)। কিন্তু সত্যের সন্ধানী গ্যালিলিও মানুষের জ্ঞানসমুদ্রে যে ঢেউ তুলিয়া গিয়াছেন, তাহা আজ বিরাট আকার ধারণ করিয়াছে এবং সেই আঘাতে আজ অন্ধবিশ্বাসের বেলাভূমিতে গুরুতর ভাঙ্গন ধরিয়াছে।