মৌলিক পদার্থগুলির অধিকাংশই বায়বীয় অবস্থা ত্যাগ করিয়া কঠিন ও তরল আকারে পৃথিবীতে আশ্রয় লইলে, অবশিষ্ট নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, আর্গন, নিয়ন, ক্রিপ্টন, হিলিয়াম, ওজন, জেনন ইত্যাদি বিভিন্ন অনুপাতে মিশিয়া সৃষ্টি হয় বাতাসের।
বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, পৃথিবীর বয়স প্রায় ৪০০ কোটি বৎসর। কোনোও মতে ৫০০ কোটি বৎসর। সৃষ্টির আদিতে পৃথিবীর আবর্তন (rotation) কাল ছিল ৪ ঘণ্টা এবং চন্দ্র ছিল মাত্র ৮ হাজার মাইল দূরে। উহা কালক্রমে বৃদ্ধি পাইয়া বর্তমানে পৃথিবীর আবর্তনকাল হইয়াছে ২৪ ঘণ্টা এবং চন্দ্র গিয়াছে প্রায় ২৩৯ হাজার মাইল দূরে। পৃথিবীর আবর্তনকাল এবং চন্দ্রের দূরত্ব এখনও বাড়িতেছে। প্রতি একশত বৎসরে চন্দ্র ৫ ইঞ্চি দূরে সরিয়া যায় এবং ১২০ হাজার বৎসরে পৃথিবীর দিন এক সেকেণ্ড বাড়ে।[১৩]
বর্তমানে পৃথিবীর মেরুরেখা ২৩ ১/২ ডিগ্রী হেলিয়া আছে। কিন্তু ইহা চিরকাল একই রূপ থাকে।, বাড়ে ও কমে। এই বাড়া ও কমা একবার শেষ হইতে প্রায় ৪০ হাজার বৎসর সময় লাগে। এই মেরুরেখা পরিবর্তনের জন্য প্রতি ২৬ হাজার বৎসর পর পর পৃথিবীতে শীত ঋতুতে গ্রীষ্ম ঋতু এবং গ্রীষ্ম ঋতুতে শীত ঋতু আসে।
বর্তমানে পৃথিবীর কক্ষপথ ডিম্বাকার। কিন্তু ইহা চিরকাল একই আকৃতিতে থাকে না, কখনও গোল এবং কখনও ডিম্বাকার হয়। এইরূপ কক্ষপথের একবার আকার পরিবর্তনে সময় লাগে ৬০ হাজার হইতে ১২০ হাজার বৎসর।
বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, পৃথিবীর বর্তমান গড় উত্তাপ ৬৮° ফা.। কিন্তু ইহা চিরকাল একই মাত্রায় থাকে না, কোনো কোনো সময় অতিমাত্রায় কমিয়া যায়। এই সময়কে বলা হয় হিমযুগ। একলক্ষ বৎসরেরও কম সময় পর পর এক একটি হিমযুগ আসে। বর্তমান কালের হিমযুগটি গিয়াছে ৩০ হাজার বৎসর আগে এবং আগামী ৭০ হাজার বৎসরের মধ্যে আর একবার হিমযুগ আসিবে।[১৪]
হিমযুগের আগমনে পৃথিবীতে বিরাট পরিবর্তন ঘটিয়া থাকে। হিমযুগে পৃথিবীর স্থলভাগের অধিকাংশ জায়গাই তুষারে ঢাকা পড়ে, তাই ঐ সব জায়গার উদ্ভিদাদি বাঁচিয়া থাকিতে পারে না। বৃক্ষারোহী জন্তুরা সমতল ভূমিতে নামিয়া আসিতে বাধ্য হয় এবং তুষারাবৃত জায়গার বাসিন্দারা কেহ অপেক্ষাকৃত উষ্ণ অঞ্চলে চলিয়া যায়, কেহ গুহাবাসী হইয়া হিমকে গা-সহা করিয়া লয়; আর যাহারা উহার একটিও পারে না, তাহারা মারা পড়ে। যাহারা বাঁচিয়া থাকে, আবহাওয়া ও দেশ পরিবর্তনের ফলে তাহাদের আকৃতি ও প্রকৃতির পরিবর্তন হইয়া অনেক নূতন জীবের উদ্ভব হয়। বিভিন্ন অঞ্চলে খননকার্যের দ্বারা যে সকল জীবাশ্ম পাওয়া গিয়াছে, জীববিজ্ঞানীগণ তাহা পর্যবেক্ষণ পূর্বক জানিতে পারিয়াছেন যে, কোনো কোনো অঞ্চলে হিমযুগের পূর্ববর্তী বহু জন্তু লুপ্ত হইয়া গিয়াছে এবং হিমযুগের পূর্বে যে সব অঞ্চলে কোনো জীবের বসতি ছিল না, হিমযুগোত্তর কালে সেখানে কোনো কোনো জীবের বসবাস আরম্ভ হইয়াছে এবং অনেক অভিনব জীবের আবির্ভাব হইয়াছে। তাহারা আরও বলেন যে, বিগত হিমযুগে মানুষের বৃক্ষচারী পূর্বপুরুষগণ বৃক্ষশাখা ত্যাগ করিয়া গুহাবাস শুরু করিয়াছিল।
আর দুইটি মাত্র কথা বলিয়া এই আলোচনা শেষ করিব।
১. বিজ্ঞানের কতগুলি সিদ্ধান্ত আজগুবি ও অসম্ভব বলিয়া কাহারও মনে হইতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞানের কোনো সিদ্ধান্তই আজগুবি নহে, প্রত্যেকটি সিদ্ধান্তের পিছনে একাধিক প্রমাণ ও যুক্তি আছে। স্থানাভাবে এইখানে যুক্তি-প্রমাণের কোনোরূপ ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হয় নাই। বিজ্ঞানের বিবিধ পুস্তকে উহার সবিস্তার বর্ণনা পাওয়া যাইতে পারে।
২. বিজ্ঞানে শেষ বলিয়া কিছু নাই। আজ যাহা সত্য বলিয়া গৃহীত হইল, ভবিষ্যতে তাহা মিথ্যা প্রমাণিত হইতে পারে এবং আজ যেখানে শেষ বলিয়া মনে হয়, তারপর আরও থাকিতে পারে; বিজ্ঞান এই সম্ভাবনাটিকে মানিয়া চলে। আর এইটিই বিজ্ঞানের বিশেষত্ব। অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী দূরবীক্ষণাদি যন্ত্র আবিষ্কারের সাথে সাথে বিশ্বের দৃষ্টিগোচর আকার ও আয়তন দিন দিন বৃদ্ধি পাইতেছে। কাজেই অত্রপুস্তকের আলোচনাসমূহে যে সীমা ও সংখ্যা ব্যবহার করা হইল, ভবিষ্যতে তাহার পরিবর্তন অসম্ভব নহে।
————
১০. পৃথিবীর ঠিকানা, অমল দাসগুপ্ত, পৃ. ৫০।
১১. পৃথিবীর ঠিকানা, অমল দাসগুপ্ত, পৃ. ৬০,৬১।
১২ পৃথিবীর ঠিকানা, অমল দাসগুপ্ত, পৃ. ১৩৬।
১৩. পৃথিবীর ঠিকানা, অমল দাসগুপ্ত, পৃ. ৫, ৬, ২৮।
১৪. পৃথিবীর ঠিকানা, অমল দাসগুপ্ত, পৃ. ১৮১-১৮৪।
০৭. সূর্য
সূর্য
# পৌরাণিক মতবাদ
আনুষঙ্গিকভাবে সূর্য সম্বন্ধে এযাবত বিজ্ঞানসম্মত কিছু কিছু তথ্য আলোচিত হইয়াছে। কিন্তু বিশেষভাবে উহা সম্বন্ধে কোনো আলোচনা করা হয় নাই। এখন সূর্য সম্বন্ধে কথঞ্চিৎ আলোচনা করা হইবে।
হিন্দুদের পুরাণে বর্ণিত আছে যে, কশ্যপ মুনির ঔরসে তৎপত্নী অদিতির গর্ভে সূর্যের জন্য হয়। সেইজন্য উহার আর এক নাম আদিত্য। ইনি রথে আরোহণ করিয়া আকাশ ভ্রমণ করেন এবং রথটিকে সাতটি ঘোড়া টানিয়া লয়। রথের সারথির নাম অরুণ।
পৌরাণিকেরা আরও বলেন যে, সূর্যদেব বিশ্বকর্মার কন্যা সংজ্ঞাকে বিবাহ করেন। তাহার গর্ভে ইহার বৈবশ্বতমনু ও যম নামে দুই পুত্র এবং যমুনা নাম্নী এক কন্যা জন্মে। অতঃপর সংজ্ঞা স্বামীর তেজ সহ্য করিতে না পারিয়া ছায়া নাম্নী এক রমণীর সৃজন করেন এবং তাহাকে স্বামীর নিকট রাখিয়া নিজে পলায়ন করেন। সূর্যের ঔরসে ছায়ার গর্ভে শনি নামে এক পুত্র ও তপতী নাম্নী এক কন্যা জন্মে। অতঃপর সূর্য প্রকৃত ঘটনা জানিতে পারিয়া সংজ্ঞার অন্বেষণে বাহির হন এবং উত্তর কুরুবর্ষে তাহাকে অশ্বিনীরূপে দেখিতে পান এবং সূর্য নিজেও অশ্বরূপ ধারণ করিয়া তাহার সহিত মিলিত হন (তিব্বতের উত্তর-পশ্চিমাংশ বা ইরান দেশকে অতিপূর্বকালে উত্তর কুরুবর্ষ বলা হইত)। সেই সময় হঁহার অশ্বিনীকুমার নামে দুই পুত্র জন্মে (ইহারা নাকি উভয়ে চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন)। অতঃপর বিশ্বকর্মা ঘঁহার তেজোহ্ৰাস করিয়া দিলে সংজ্ঞা পতিসহ সুখে বাস করিতে থাকেন। এতদ্ভিন্ন বানররাজ বালী ও সুগ্রীব এবং কুন্তির গর্ভজাত কর্ণও নাকি সূর্যের ঔরসজাত পুত্র।