এই পুস্তকখানার রচনাকাল ১৯. ৪. ১৩৭২ হইতে ২৫. ৪. ১৩৭৭, কিন্তু মুদ্রণকাল মাঘ, ১৩৮৪। এই সময়ের মধ্যে দেশ তথা সমাজে নানারূপ উত্থান-পতন ও ভাগা-গড়া ঘটিয়াছে আর বিজ্ঞান জগতে নানাবিধ পরিবর্তন ঘটিয়াছে বিজ্ঞানীদের নব নব আবিষ্কারের ফলে। তাহারই পরিপ্রেক্ষিতে আবশ্যক হইয়াছিল এই পুস্তকের পাণ্ডুলিপিখানার কিছু কিছু পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের। আর সেই সংশোধনের বিরক্তিকর ঝামেলার বেশির ভাগই ভোগ করিতে হইয়াছে। প্রেস কর্তৃপক্ষকে। ইহাতে প্রেস কর্তৃপক্ষ মো. তাজুল ইসলাম সাহেব ও তাহার কর্মচারীবৃন্দের উদারতা ও সহিষ্ণুতা আমাকে বিমুগ্ধ করিয়াছে।
নানা কারণে এই পুস্তকখানিতে এমন কতগুলি ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকিয়া গেল, যাহা শুদ্ধিপত্র দ্বারাও দূর করা দুষ্কর। ইহার জন্য প্রিয় পাঠকবৃন্দের নিকট আমার ক্ষমা প্রার্থনা ভিন্ন আর কোনো উপায় নাই।
বিনীত
আরজ আলী মাতুব্বর
লামচরি
১১ আষাঢ় ১৩৮৪
০১. আদিম মানুষের সৃষ্টিতত্ত্ব
চৈনিক মত
প্রাচীন চীনাদের বিশ্বাস, তাহারা চীন দেশেরই আদিম অধিবাসী। তাহারা যে অন্য কোনো দেশ হইতে সেখানে যাইয়া উপনিবেশ স্থাপন করিয়াছে, তাহাদের কোনো পুরাণ-গ্রন্থাদিতে এই কথা নেই। চীন দেশে ঈশ্বর প্রথম যে মনুষ্যটি সৃষ্টি করিয়াছিলেন, তাহার নাম ‘পাং-কু’। পাং-কুর উৎপত্তি দশ লক্ষ বৎসর পরে চীনে দশটি রাজবংশ রাজত্ব করিয়াছিল। প্রথম দেবগণের রাজত্ব, দ্বিতীয় উপদেবগণের রাজত্ব, তৃতীয় নরগণের রাজত্ব, চতুর্থ জুচানগণের রাজত্ব, পঞ্চম সুইজন বা অগ্ন্যুৎপাদকগণের রাজত্ব ইত্যাদি। ইতিহাসে চীনের প্রথম রাজার নাম ‘ফু-হিয়া’। ইঁহার রাজত্বকাল (পাশ্চাত্য মতে) ২৮৩২-২৩৩৮ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে। ইহাই চীনের সৃষ্টি প্রকরণের প্রাচীন বিবরণ।
মিশরীয় মত
মিশরের কোনো কোনো প্রদেশের প্রাচীন অধিবাসীগণের বিশ্বাস, সৃষ্টিকর্তা ‘ক্ষুণুম’ প্রথমে ডিম্বাকার পৃথিবী এবং পরে মনুষ্য সৃষ্টি করেন। অন্যত্র আবার প্রচার, শিল্পনিপুণ ঈশ্বর ‘টা’ নামক হাতুড়ি দ্বারা পূর্বোক্ত ডিম্ব ভাঙ্গিয়া ফেলেন, সেই ডিমের মধ্য হইতে পৃথিবী ও প্রাণীগণের উৎপত্তি হয়। কাহারও কাহারও মতে ‘থোথ’ বা চন্দ্রদেবতার আদেশক্রমে পৃথিবী উত্থিত হয়। অনেকের মতে ‘রা’ বা ‘রে’ (সূর্যদেবতা) পৃথিব্যাদি সকলের সৃষ্টিকর্তা।
অন্যমতে—মিশরের প্রথম রাজার নাম ‘রা’ বা ‘রে’। মনুষ্যগণ তাঁহার সম্মান করে নাই বলিয়ে বৃদ্ধবয়সে তিনি বড়ই রুষ্ট হন। প্রথমে তিনি মনুষ্য সমাজকে ধ্বংস করিতে বদ্ধপরিপক হইয়াছিলেন। পরিশেষে স্বর্গীয় গাড়িতে আরোহণ করিয়া এক নুতন পৃথিবী সৃষ্টি করেন। তাঁহার সেই পৃথিবীর নামই ‘স্বর্গ’।
ফিনিসীয় মত
ফিনিসিয়ার অধিবাসীদিগের বিশ্বাস, ক্রন্স্ নামক দেবতা ফিনিসিয়া ও তাহার অধিবাসীদিগকে সৃষ্টি করিয়াছিলেন। সৃষ্টিকর্তা ক্রন্স্-এর পশ্চাতে ও সম্মুখে দুইদিকেই চক্ষু ছিল। তাহার ছয়টি পক্ষ, তন্মধ্যে কয়েকটি বিস্তারিত ও কয়েকটি সঙ্কুচিত। প্রাচীন ফিনিসীয়দের মতে ক্রন্স্ই এই বিশ্বসংসারের সৃষ্টিকর্তা।
ব্যাবিলনীয় মত
প্রাচীন ব্যাবিলনীয়দের মত এই—প্রথমে সংসার জলময় ছিল। ‘অপসু’ ও ‘তিয়ামত’ দেবতাগণ উৎপন্ন হন। সেই সকল দেবতা তিয়ামতের সন্তান-সন্ততির মধ্যে পরিগণিত। এক সময় তিয়ামতের সহিত দেবগণের বিরোধ উপস্থিত হয়। তখন ‘মার্দক’ বা ‘মেরোডাক’ (ঈশ্বর) দেবতাগণের অধিপতি ছিলেন। তিনি তিয়ামতের সংহার সাধন করেন। তিয়ামত আপনার সহায়তার জন্য যে দৈত্যসমূহ সৃষ্টি করিয়াছিলেন, মার্দক তাহাদিগকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া রাখেন। অবশেষে মার্দক কর্তৃক তিয়ামতের দেহ দ্বিখণ্ডিত হয়। সেই দেহের একাংশে পৃথিবী এবং অপর অংশে স্বর্গ সৃষ্ট হইয়াছিল।
আফ্রিকার অসভ্য জাতিদের মত
আফ্রিকা মহাদেশের বন্য জাতিদিগের মধ্যে সৃষ্টি সম্বন্ধে একটা সাধারণ উপাখ্যান প্রচলিত আছে। এক সম্প্রদায়ের লোকের বিশ্বাস, ‘মাণ্টিস’ জাতীয় পতঙ্গই সৃষ্টির আদিভূত। মাণ্টিস জাতীয় পতঙ্গের মধ্যে ‘ফাগন’ বা ‘ইকাগন’ পতঙ্গ পরম উপকারী বলিয়া পূজিত হইয়া থাকে (দেব-দেবীর সহচর বলিয়া এদেশের হিন্দুদের নিকট সর্প, বৃষ, পেঁচক, মূষিক ইত্যাদিও সম্মানার্হ বা পূজনীয়)। তাহাদের বিশ্বাস—মণ্টিসের স্ত্রী, কন্যা ও দৌহিত্র আছে। মাণ্টিস আপন জামাতার পাদুকা হইতে দ্বীপের সৃষ্টি করিয়াছিলেন। তাহার নিজের পাদুকা হইতে চন্দ্র উৎপন্ন হয়। চন্দ্রের বর্ণ রক্তিমাভ দেখিয়া উক্ত বন্য জাতিরা সিদ্ধান্ত করে, মাণ্টিসের পাদুকায় রক্তবর্ণ ধূলা ছিল বলিয়া চন্দ্রের এইরূপ বর্ণ হইয়া থাকিবে। একটি বিড়ালের সহিত যুদ্ধে একবার মাণ্টিস পরাজিত হয়। যাহা হউক, ঐ সকল জাতি মাণ্টিসকেই ঈশ্বর বলিয়া বিশ্বাস করে।
দক্ষিণ আফ্রিকার হটেনটট জাতির মতে, সৃষ্টিকর্তা নাম ‘সুনিগোয়ান’। তাহার উপাসনগণ বলিয়া থাকেন, তিনিই অবিদ্যমান শূন্য হইতে বিশ্বের সৃষ্টি করিয়াছিলেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার জুলু জাতি প্রধানত পিতৃপুরুষের উপাসক। তাহাদের মতে, পিতৃপুরুষগণের এক আদিপুরুষই এই সসাগরা ধরিত্রীর সৃষ্টিকর্তা। জুলুরা বলে, সেই আদিপুরুষ বা সৃষ্টিকর্তাই পৃথিবীর আদিমানুষ। তাহার নাম ‘উনকুলুলু’। তাহা হইতেই অন্যান্য সবকিছুর সৃষ্টি হইয়াছে।