জ্বলন্ত সূর্যের বাষ্পীয় দেহ হইতে জন্ম লইবার সময় পৃথিবীও জ্বলন্ত দেহধারী ছিল এবং পৃথিবীর তাপমাত্রাও সূর্যের তাপমাত্রার সমান ছিল। বিশেষত আয়তনেও বর্তমানের তুলনায় বহুগুণ বড় ছিল। কালক্রমে তাপ ত্যাগ করিয়া পৃথিবীর দেহ সঙ্কুচিত হইতে থাকে এবং ভারি ধাতুর পরমাণুগুলি বায়বীয় অবস্থা ত্যাগ করিয়া তরল অবস্থাপ্রাপ্ত হয়। যে সকল ধাতু অপেক্ষাকৃত ভারি, তাহা পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে এবং অপেক্ষাকৃত হাল্কা ধাতু-পদার্থগুলি উপরে থাকিয়া ভিন্ন ভিন্ন স্তরে সজ্জিত হয়।
ভূবিজ্ঞানীরা বলেন যে, ভূগর্ভে প্রধান স্তর তিনটি। প্রথম –ভূ-কেন্দ্র হইতে ‘তরল ধাতু স্তর’ ২২০০ মাইল, ইহার আপেক্ষিক গুরুত্ব (জলের তুলনায়) প্রায় ১১; দ্বিতীয়– ‘নমনীয় ব্যাসল্ট স্তর’ ১৮০০ মাইল, ইহার আপেক্ষিক গুরুত্ব ২.৮৬; তৃতীয় –‘কঠিন গ্রানাইট স্তর ৩০ মাইল, ইহার আপেক্ষিক গুরুত্ব ২.৬৫। পৃথিবীর যাবতীয় পদার্থের গড় আপেক্ষিক গুরুত্ব ৫.৫২।[১০]
বর্তমানে ভূপৃষ্ঠের গড় উত্তাপ প্রায় ৬৮° ফারেনহাইট বা ২০° সেন্টিগ্রেড। কিন্তু ভূগর্ভের ৩০ মাইল নিচের উত্তাপ প্রায় ১২০০° সে. এবং কেন্দ্রীয় অঞ্চলের তাপমাত্রা ৬০০০° সে.। ইহা সূর্যের বহিরাবরণের তাপের সমান।[১১]
পৃথিবী সূর্যের প্রজ্জ্বলিত বাষ্পীয় দেহের স্খলিত অংশ হইতে জন্ম লইয়া ক্রমশ তাপ ত্যাগ করিয়া শীতল ও সঙ্কুচিত হইতে থাকে এবং ইহার ফলে পৃথিবীর আবর্তন (rotation) বেগ বৃদ্ধি পাইতে থাকে। আবর্তন বেগ বৃদ্ধির ফলে নিরক্ষদেশ স্ফীত ও মেরুদেশ চাপা হইতে থাকে। নিরক্ষদেশ অতিমাত্রায় স্ফীত হইলে, স্ফীত অংশ বিচ্ছিন্ন হইয়া (মতান্তরে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের গ্রানাইট স্তরের খানিকটা অংশ বিচ্ছিন্ন হইয়া) যায় এবং তাহা হইতে চন্দ্রের জন্ম হয়।
“কোনো গোলকের ব্যাস বা পরিধি এবং আপেক্ষিক গুরুত্ব জানা থাকিলে, উহার ওজন নির্ণয় করা সম্ভব।” এই সূত্রটি অনুসারে বিজ্ঞানীগণ পৃথিবীর ওজন নির্ণয় করিয়াছেন। উহা টনের হিসাবে লিখিতে হইলে ৬-এর ডানে ২১টি শূন্য বসাইতে হয়।
যথা –৬,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০, ০০০,০০০ টন।[১২]
পৃথিবীর পরিধি প্রায় ২৫ হাজার মাইল এবং ভূপৃষ্ঠের মোট আয়তন ১৯.৬৯ কোটি বর্গমাইল। ইহার মধ্যে জলভাগ ১৩.৯৪ এবং স্থলভাগ ৫.৭৫ কোটি বর্গমাইল। অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের শতকরা ৭০.৭৮ ভাগ জল ও ২৯.২২ ভাগ স্থল।
কতিপয় ফল শুকাইলে যেমন তাহার পৃষ্ঠদেশ কুঁচকাইয়া যায়, অর্থাৎ উঁচুনিচু হইয়া নানাবিধ ভাঁজ পড়ে, তেমন পৃথিবী ক্রমশ শীতল ও সঙ্কুচিত হইয়া ভূপৃষ্ঠের গ্রানাইট স্তরে ভাঁজ পড়ে। কথাটি আর একটু পরিষ্কার করিয়া বলি।
মনে করা যাক, একটি ফলের ত্বকের পরিধি হইল ৬ ইঞ্চি এবং তাহার মাংসল অংশের পরিধি ৫ ইঞ্চি। ঐ ফলটি শুকাইয়া তাহার মাংসল অংশের পরিধি হইল ৪ ইঞ্চি। কিন্তু উহার ত্বকের পরিধি বিশেষ কমিল না। এমতাবস্থায় ফলটির মাংসল অংশের সহিত সমতা রাখিয়া উহার একাংশে ১ ইঞ্চি ভাজ পড়িবে। হয়তো উহার ২ ইঞ্চি উঁচু ও ২ ইঞ্চি নিচু হইয়া ভাজ পড়িবে। ভঁজের রকম ও সংখ্যা যতই হউক না কেন, উহাদের যোগফল হইবে ১ ইঞ্চি।
এককালে পৃথিবীর অবস্থাও ঐরূপই হইয়াছিল। তাপ ত্যাগ করিয়া ভূগর্ভস্থ তরল পদার্থ যে পরিমাণ সঙ্কুচিত হইল, বাহিরের ত্বকাংশ (কঠিন গ্রানাইট স্তর) সেই অনুপাতে সঙ্কুচিত হইতে না পারায় উহাতে ভঁজের সৃষ্টি হইল। ইহাতে ভূপৃষ্ঠের কোথায়ও উঁচু এবং কোথায়ও নিচু হইল ও কিছুটা সমতল থাকিল। বলা বাহুল্য যে, উঁচু স্থানগুলি পর্বত, নিচু স্থানগুলি সমুদ্রগহবর এবং অবশিষ্টভাগ সমতল ভূমি হইল।
ভূবিজ্ঞানীগণ বলেন যে, কোনো পর্বতই চিরকাল স্থায়ী থাকে না। পদার্থের ক্ষয় বা রূপান্তর অনিবার্য। তাপ, আলো ও বায়ুর প্রভাবে কঠিন প্রস্তর, এমনকি লৌহেরও রূপান্তর ঘটে। পর্বতের প্রস্তরাদি নিয়ত ক্ষয় হইয়া নানা উপায়ে উহা সমুদ্রে পতিত হয় ও সমুদ্রকে ভরাট করিতে থাকে। ইহার ফলে পর্বতের উচ্চতা এবং সমুদ্রের গভীরতা কমিয়া কালক্রমে ভূপৃষ্ঠ প্রায় সমতলে পরিণত হয়। পৃথিবীর ক্রমিক সঙ্কোচনের ফলে কালক্রমে আবার নূতন ভাজ পড়িতে আরম্ভ করে এবং পুনঃ পর্বত ও সাগরের সৃষ্টি হয়।
এক একবার পাহাড়াদির সৃষ্টি ও বিলয়কে বলা হয় এক একটি বিপ্লব। প্রতিটি বিপ্লবের ব্যাপ্তিকাল কোটি কোটি বৎসর। সৃষ্টির পর পৃথিবীতে এইভাবে পর্বতাদির সৃষ্টি ও বিলয় হইয়াছে দশবার। ইহার মধ্যে জীব সৃষ্টির পূর্বে ছয়বার এবং পরে চারিবার বিপ্লব ঘটিয়াছে। সর্বশেষ বিপ্লব অর্থাৎ বর্তমান বিপ্লবটি শুরু হইয়াছে প্রায় ৭ কোটি বৎসর আগে। তাই আধুনিক সাগর ও পাহাড়গুলির বয়স সাত কোটি বৎসরের কিছু কম। ভূবিজ্ঞানীগণ বলেন যে, বর্তমান বিপ্লবটি। এখনও শেষ হয় নাই অর্থাৎ পর্বতাদি এখনও বৃদ্ধি পাইতেছে। তবে উহা পাঁচ-দশ হাজার বৎসরে নজরে পড়ে না।
পৃথিবীর যাবতীয় সাগর ও পাহাড়ের পরিমাণ প্রায় সমান। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে, পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতের উচ্চতা প্রায় ৫ মাইল এবং গভীরতম সমুদ্রের গভীরতাও প্রায় ৫ মাইল।
হাল্কা-পরমাণুঘটিত পদার্থগুলি ভারি-পরমাণুঘটিত পদার্থের সহিত সমান তালে জমাট বাঁধিতে পারে না। ভূপৃষ্ঠে পর্বতাদি সৃষ্টির সময় পর্যন্ত হাইড্রোজেনাদি হাল্কা বায়বীয় পদার্থগুলি জমাট বাধিতে পারে নাই। অতঃপর পৃথিবীর তাপ আরও কমিলে বায়বীয় পদার্থ জমিতে আরম্ভ করে। ২টি হাইড্রোজেন ও ১টি অক্সিজেন পরমাণু যুক্ত হইয়া জলের অণুর সৃষ্টি হয় এবং কালক্রমে আকাশের তাপ আরও কমিলে জলের অণুগুলি সংযুক্ত হইয়া বৃষ্টির আকারে ভূপতিত। হয় এবং উহা নিচু গহ্বরগুলিতে আশ্রয় লইলে সাগরাদির সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর সমস্ত জলের আয়তন ১৫০ কোটি ঘনকিলোমিটার।