সৃষ্টিতত্ত্ব নির্ণয়ের ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের মধ্যে কোনো কোনো বিষয়ে সামান্য মতভেদ আছে। সেই মতভেদ উপেক্ষা করিয়া আমরা উহাদের মধ্যে বহুজন স্বীকৃত মতবাদ-এর ভিত্তিতে সৃষ্টিতত্ত্বের বর্ণনা করিব। বলা বাহুল্য যে, বিজ্ঞানীদের সকলের সকল মতবাদের মূল একই, অর্থাৎ বস্তুবাদ।
বিজ্ঞানীদের মতে –বর্ণনাতীত কালে অনন্ত বিশ্বের সর্বত্র বিরাজ করিত নিরাকার এক শক্তি বা তেজ। কালক্রমে তেজশক্তি রূপান্তরিত হয় তড়িৎশক্তিতে, যাহার পরিবাহক ইলেকট্রন প্রোটনাদি শক্তিকণিকা। ইহারা সম্পূর্ণ নিরাকার নহে এবং সাকারও নহে। ইহারা সাকার ও নিরাকারের মাঝামাঝি অর্থাৎ ইহারা পদার্থও নহে এবং অপদার্থও নহে। ইহারা সতত চঞ্চল ও গতিশীল।
কালক্রমে মহাশূন্যে ঐ সকল শক্তিকণিকা সংহত হয়, অর্থাৎ বিভিন্ন সংখ্যায় জোড় বাধিয়া যায়। ইহাতে সৃষ্টি হয় বিভিন্ন ধরণের পরমাণুর। ইহারাও চঞ্চল ও গতিশীল। এই পরমাণুময় জগতটিই নীহারিকা জগত।
হয়তো অনেকেই দেখিয়া থাকিবেন যে, জলা মাঠের কর্দম শুকাইতে থাকিলে মাটিতে ফাটল ধরে। কিন্তু কেন ধরে? জলসহ কাদামাটির যে আয়তন থাকে, মাটিস্থ জল বাষ্প হইয়া উড়িয়া যাওয়ায় তাহার সে আয়তন থাকে না, কমিয়া যায়। কিন্তু মাঠের পরিধি কমে না। অর্থাৎ মাঠের প্রান্তসীমা ঠিকই থাকিয়া যায়। কাজেই ফাটলের মাধ্যমে জলের ঐ ঘাটতি পূরণ হয়। পক্ষান্তরে ইতস্তত ফাটলের যোগাযোগে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষেত্র উৎপন্ন হয় এবং ক্ষেত্রগুলির আকৃতিতে মোটামুটি সাদৃশ্য থাকে। কিন্তু আয়তন হয় বিভিন্ন।
উক্তরূপ — অখণ্ড নীহারিকা জগতের ইলেকট্রন ও প্রোটনাদি পরস্পর জোড় বাধিয়া সংহত হওয়ার ফলে হাইড্রোজেনাদি বায়বীয় পদার্থের সৃষ্টি হয় এবং ইহাতে নীহারিকার আয়তন কমিবার দরুন স্থানে স্থানে ফাটলের সৃষ্টি হয়। ইহার ফলে অখণ্ড নীহারিকা জগত বহু খণ্ডে বিভক্ত হইয়া ভিন্ন ভিন্ন নীহারিকার উদ্ভব হয়।
কালক্রমে অন্যান্য মৌলিক পদার্থের ভারি পরমাণুগুলির সৃষ্টি হয় এবং খণ্ডিত নীহারিকার আয়তন আরো কমিতে থাকে। ইহার ফলে পরমাণুদের নৈকট্য বৃদ্ধি পায় এবং পরস্পর সংঘর্ষের ফলে নীহারিকা রাজ্যে সৃষ্টি হয় তাপ-এর।
কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হইলেও পরমাণুর গঠন সম্বন্ধে এইখানে কিছু বলা আবশ্যক মনে করি। পরমাণুদের গঠনোপাদান প্রধানত ইলেকট্রন ও প্রোটন; কিছু নিউট্রন, পজিট্রন, নিউট্রিনো এবং মিসোটুনও থাকে। কিন্তু উহারা এলোমেলোভাবে থাকে না, থাকে সুসংবদ্ধভাবে। পরমাণুর কেন্দ্রে। থাকে পজিটিভ বিদ্যুযুক্ত প্রোটন এবং বাহিরের বৃত্তাকার কক্ষে ভ্রমণ করে নেগেটিভ বিদ্যুৎযুক্ত ইলেকট্রন। ইলেকট্রন ও প্রোটনের সংখ্যার উপর নির্ভর করে যাবতীয় মৌলিক পদার্থের রূপায়ণ। বাহিরে ভিন্ন ভিন্ন কক্ষে ভ্রমণরত ইলেকট্রনের সংখ্যা থাকে যত, কেন্দ্রে প্রোটনের সংখ্যা থাকে তত।
হাইড্রোজেন পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে একটি প্রোটন ও বাহিরের কক্ষে থাকে একটি মাত্র ইলেকট্রন। তাই বিশ্বের যাবতীয় পদার্থের মধ্যে হাইড্রোজেনই বেশি হাল্কা। এই রকম ইলেকট্রন বা প্রোটনের সংখ্যা হিলিয়ামে ২, লিথিয়ামে ৩, বেরিলিয়ামে ৪; বরাবর যাইয়া সোনায় সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৯, পারদে ৮০, ইউরেনিয়ামে ৯২ এবং নোবেলিয়ামে ১০২। এক একটি পরমাণু যেন এক একটি ছোট সৌরজগত। সূর্যকে কেন্দ্রে রাখিয়া যেমন গ্রহগণ ঘুরিতেছে, প্রোটনকে কেন্দ্রে রাখিয়া তেমন ইলেকট্রনরা প্রতি সেকেণ্ডে ১৩০০ মাইল বেগে ঘুরিতেছে।
একটি জলপূর্ণ পাত্রে কয়েক টুকরা শোলা বা অনুরূপ কিছু ঘুরাইয়া জলের উপর আলাদা আলাদাভাবে ছাড়িয়া দিলে দেখা যায় যে, উহারা জলের উপর ভাসিয়া পৃথক পৃথক ঘুরিতে থাকে এবং কোনো কৌশলে উহাদের পরস্পরকে সংলগ্ন করিয়া রাখিলে দেখা যায় যে, উহারা পৃথক থাকিয়া যে পাকে ঘুরিতেছিল, সমবেতভাবে এখন সেই একই পাকে ঘুরিতেছে। উক্তরূপ ঘূর্ণায়মান গতিবিশিষ্ট ইলেকট্রনে গঠিত পরমাণুরা হয় ঘূর্ণিগতিশীল এবং পরমাণুগঠিত নীহারিকারাজিও হয় ঘূর্ণায়মান ও গতিশীল।
কালক্রমে নীহারিকারাজি তাহাদের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে আয়তনে ছোট হইতে থাকে এবং উহাতে তাহাদের তাপ ও ঘূর্ণিবেগ বৃদ্ধি পাইতে থাকে। এইভাবে নীহারিকার তাপবৃদ্ধি হইয়া কয়েক লক্ষ বা কোটি ডিগ্রী হইলে উহারা হইয়া দাঁড়ায় এক একটি নক্ষত্র। তবে সকল নক্ষত্র সমান তাপ ও আয়তন বিশিষ্ট হয় না, উহাতে যথেষ্ট পার্থক্য থাকে।
প্রজ্জ্বলিত বাষ্পীয়দেহধারী নক্ষত্র বা সূর্যের আবর্তনবেগ অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পাইলে উহাদের কেন্দ্ৰাপসারণী শক্তির (centrifugal force) প্রভাবে নিরক্ষদেশ স্ফীত হইতে থাকে এবং মেরুদেশ চাপিয়া যায়। ক্রমসকোচনের ফলে কেন্দ্ৰাপসারণী শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং নিরক্ষদেশ হইতে অভগুরীয় আকারে খানিকটা অংশ বিচ্ছিন্ন হইয়া যায়। বিচ্ছিন্ন অংশও দূরে যাইয়া আবর্তিত হইতে থাকে এবং পরে উহাই হইয়া দাঁড়ায় এক একটি গ্রহ।
আমাদের সৌরজগতটিও একটি খণ্ড নীহারিকা মাত্র। ইহার আবর্তনবেগে (মতান্তরে অন্য কোনো নক্ষত্রের আকর্ষণে) ক্রমশ ১১টি অঙ্গুরীয় খসিয়া ১১টি গ্রহের সৃষ্টি হইয়াছে। এই এগারোটি গ্রহের মধ্যে একটি আমাদের এই পৃথিবী এবং অপর গ্রহসমূহ –বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন, প্লুটো, পসিডন ও ভালকান (ইহাদের বিষয় পরে আলোচিত হইবে)। আমাদের সৌরজগতের ব্যাস প্রায় ৭৩৪ কোটি মাইল।