সেকালে এই গোটা পৃথিবীটিকেই বলা হইত জগত। এখন দেখা যাইতেছে যে, জগত একটি নহে, অনেক। যেমন –সৌরজগত, নক্ষত্র জগত, নীহারিকা জগত ইত্যাদি। আর এই সকল জগতকে একত্রে বলা হয় বিশ্ব। এখন প্রশ্ন হইল এই যে, এই বিশ্বের আকৃতি কিরূপ?
আমরা যে নক্ষত্র জগতে বাস করি, এই জগতটির আকৃতি গোল অথচ চ্যাপ্টা, কতকটা ডাক্তারদের ট্যাবলেট-এর মতো। আমাদের পৃথিবী উত্তর-দক্ষিণে চাপা, অর্থাৎ ইহার বিষুবীয় অঞ্চলের ব্যাস ৭,৯২৬ মাইল ও মেরু অঞ্চলের ব্যাস ৭,৯০০ মাইল; ব্যবধান ২৬ মাইল মাত্র। আর আমাদের নক্ষত্র জগতটির বড় ব্যাস ১২০ হাজার আলোক বর্ষ এবং ছোট ব্যাস ২০ হাজার আলোক বর্ষ; ব্যবধান ১ লক্ষ আলোক বর্ষ।
প্রত্যেকটি নক্ষত্র জগত বা নীহারিকার মাঝখানের দূরত্ব লক্ষ লক্ষ আলোক বর্ষ। যে কোনো দুইটি নীহারিকার মাঝখানে যে স্থান, সেখানে তাপ নাই, চাপ নাই, আলো নাই; অর্থাৎ কোনো পদার্থই নাই। উহা চিরঅন্ধকার, চিরশীতল, বিশাল মহাশূন্য! মতান্তরে –বস্তুশূন্য কোনো স্থান নাই। কেননা সমস্ত বিশ্বব্যাপী ইথর বিদ্যমান এবং উহা একটি পদার্থ।[৭]
নীহারিকাগুলি পরস্পর দূরে সরিয়া যাইতেছে এবং নীহারিকা বিশ্বটি ক্রমশ স্ফীত হইতেছে। বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, আমাদের নক্ষত্র জগত হইতে যে নীহারিকার দূরত্ব যত বেশি, সেই নীহারিকার দূরে সরিয়া যাওয়ার বেগও তত বেশি। প্রতি এক লক্ষ আলোকবর্ষ দূরত্ব বৃদ্ধিতে প্রতি সেকেণ্ড ১০০ মাইল বেগ বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে সবচেয়ে দূরের নীহারিকার দূরে সরিয়া যাওয়ার বেগ আলোর বেগের ৯/১০; অর্থাৎ প্রতি সেকেণ্ড ১,৬৭,৪০০ মাইল। নীহারিকাগুলি কত যুগ-যুগান্ত হইতে এইরূপ প্রচণ্ড বেগে ছুটিয়া চলিয়াছে, তাহার ইয়ত্তা নাই এবং কোনো কালেও যে উহারা কোনো সীমান্তে পৌঁছিবে– বিজ্ঞানীগণ আজ পর্যন্ত তাহারও কোনো হদিস পান না।
আর একটি কথা এই যে, আমরা যে পৃথিবীটিতে আছি, তাহারই চতুষ্পর্শ্বে যে নক্ষত্র নীহারিকাগুলি ভীড় জমাইয়া আছে, এইরূপ মনে করিবার কোনো কারণ নাই। হয়তো এই বিশ্বের। অনুরূপ কোটি কোটি বিশ্ব লইয়া ‘মহাবিশ্ব গঠিত হইয়া থাকিবে। আবার কোটি কোটি মহাবিশ্ব লইয়া ‘পরমবিশ্ব’, অতঃপর ‘চরমবিশ্ব’ ইত্যাদি অনন্ত বিশ্ব থাকা বিচিত্র নহে।[৮] তাই বলিতে হয়, বিশ্ব অসীম। আর অসীমের কোনো আকৃতি থাকিতে পারে না। কাজেই বিশ্বের নির্দিষ্ট কোনো আকৃতি নাই।
.
# বিশ্বের উপাদান
জগতের যে কোনো পদার্থের উপাদানসমূহের পরিচয় জানিতে হইলে পদার্থটিকে ভাঙ্গা আবশ্যক। বিজ্ঞানীগণ জগতের বিবিধ পদার্থের মৌলিক উপাদান নির্ণয়ের জন্য জৈবাজৈব বহু পদার্থই ভাঙ্গিয়া দেখিয়াছেন। ইহাতে তাহারা ফল যাহা পাইয়াছেন, এইখানে তাহার কিছু আভাস দিতে চেষ্টা করিব।
প্রথমত, বিশ্বের একটি অংশ নীহারিকা, নীহারিকার অংশ নক্ষত্র বা সূর্য, সূর্যের অংশ গ্রহ এবং গ্রহের অংশ উপগ্রহ ইত্যাদি। আমাদের পৃথিবী একটি গ্রহ এবং ইহার একটি অংশ হিমালয় পর্বত। এই হিমালয়কে ভাঙ্গিলে পাওয়া যাইবে ক্রমে প্রস্তরখণ্ড, কত্তকর, শেষ পর্যন্ত ধূলিকণা। এই ধূলিকণাকে ক্রমাগত ভাগিতে থাকিলে পাওয়া যাইবে অণু।
জগতের কঠিন, তরল ও বায়বীয় যে কোনো পদার্থ ভাঙ্গিয়া পাওয়া যায় এই অণু। এই অণুর পর্যায়ে পৌঁছা পর্যন্ত পদার্থের পূর্ব গুণাগুণ বজায় থাকে। অণু এত ছোট যে, খালি চোখে উহা দেখা যায় না। একটি অণুর ব্যাস এক সেন্টিমিটারের পাঁচ কোটি ভাগের এক ভাগের সমান। একটি ক্ষুদ্র জলকণাকে যদি পৃথিবী বলিয়া মনে করা হয়, তবে একটি অণু হইবে একটি ফুটবলের সমান। বিজ্ঞানী অ্যাস্টন বলেন, “এক গ্লাস জলের প্রতিটি অণুর গায়ে লেবেল আঁটিয়া অর্থাৎ চিহ্নিত করিয়া ঐ জল যদি পৃথিবীর সাগর, মহাসাগর, নদী ও পুকুরাদির যাবতীয় জলের সহিত ভালোরূপে মিশাইয়া দেওয়া যায় এবং মিশ্রিত জল হইতে এক গ্লাস জল তোলা হয়, তবে এই এক গ্লাস জলে চিহ্নিত অণুর সংখ্যা থাকিবে অন্তত দুই হাজার।”
জগতের বস্তুসমূহের রূপ-গুণের যে বৈচিত্র, তাহা এই অণুর পর্যায়ে আসিয়াই শেষ হইয়া যায়। বিজ্ঞানীগণ বিবিধ কৌশলে এই অণুকে ভাঙ্গিয়াছেন এবং অণুকে ভাঙ্গিয়া যাহা পাইয়াছেন, তাহাকে বলা হয় পরমাণু বা অ্যাটম। যে সকল পদার্থ অণুর পর্যায় পর্যন্ত স্বধর্ম বজায় রাখিতে পারে এবং তৎপরে হারাইয়া ফেলে, তাহাদের বলা হয় যৌগিক ও যে সকল পদার্থ পরমাণুর পর্যায় পর্যন্ত স্বধর্ম বজায় রাখিতে পারে, তাহাদের বলা হয় মৌলিক পদার্থ।
তুঁতে ও লবণ দুইটি যৌগিক পদার্থ। ইহাদের অণুকে ভাঙ্গিলে কাহারও নিজ নিজ রূপগুণ বজায় থাকে না। অঁতের অণুকে ভাঙ্গিলে পাওয়া যায় তামা, গন্ধক ও অক্সিজেন নামক বায়বীয় পদার্থের পরমাণু এবং লবণের অণুকে ভাঙ্গিলে পাওয়া যায় সোডিয়াম ও ক্লোরিন নামক পদার্থের পরমাণু। সুতরাং পুঁতে ও লবণ যৌগিক পদার্থ এবং তামা, গন্ধক, অক্সিজেন, সোডিয়াম ও ক্লোরিন মৌলিক পদার্থ। কোনো যৌগিক পদার্থের অণুকে ভাঙ্গিলে বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের পরমাণু পাওয়া যায়, কিন্তু মৌলিক পদার্থের অণুকে ভাগিলে অন্য কিছুই পাওয়া যায় না। যেমন স্বর্ণ একটি মৌলিক পদার্থ। উহার অণুকে ভাঙ্গিলে স্বর্ণ পাওয়া যায়, অন্য কিছু নহে। প্রকৃতিতে স্বভাবত যে সকল যৌগিক পদার্থের সৃষ্টি হয়, তাহার সংখ্যা প্রায় ৪ লক্ষ। কিন্তু মৌলিক পদার্থের সংখ্যা বেশি নহে।