কোনো স্থানের কেন্দ্রবিন্দু ঠিক করিতে হইলে উহার পরিধি জানা দরকার। পরিধি নির্ধারণ না করিয়া কেন্দ্র নির্ধারণ অসম্ভব। কিন্তু ধর্মীয় মতবাদে বিশের পরিধি নির্ধারণ না করিয়াই পৃথিবীকে বিশ্বের কেন্দ্র বলিয়া সাব্যস্ত করা হইয়াছে।
পৃথিবী সূর্য হইতে প্রায় ৯৩০ লক্ষ মাইল দূরে থাকিয়া এক গোলাকার (দুইদিকে ঈষৎ চাপা) কক্ষপথে ভ্রমণ করিতেছে এবং প্রায় একই সমান্তরালে কম-বেশি দূরে থাকিয়া আরো ১০টি গ্রহ সূর্যকে প্রদক্ষিণ করিতেছে। গ্রহদের এই আবর্তনক্ষেত্রকে বলা হয় সৌরজগত। সৌরজগতের কেন্দ্রে অবস্থিত আছে সূর্য এবং সীমান্তে আছে ভালকান গ্রহ। পৃথিবী উহার কেন্দ্রেও নহে এবং সীমান্তেও নহে।
বুধ, শুক্র ও মঙ্গল গ্রহ ভিন্ন পৃথিবীর চেয়ে ছোট গ্রহ সৌরাকাশে আর নাই। পৃথিবীর ব্যাস মাত্র ৭,৯২৬ মাইল। কিন্তু ইউরেনাসের ব্যাস ৩০,৮৮০ মাইল, নেপচুনের ব্যাস ৩২,৮৪০ মাইল, শনির ব্যাস ৭৫,০৬০ মাইল এবং বৃহস্পতির ব্যাস ৮৮,৭০০ মাইল। পৃথিবী অপেক্ষা সূর্য ওজনে ৩৩০ হাজার গুণ বেশি এবং আয়তনে প্রায় ১৩ লক্ষ গুণ বড়। সৌররাজ্যে পৃথিবী নেহায়েত ছোট জিনিষ এবং মহাকাশে ইহার দৃশ্যমান অস্তিত্বই নাই।
সৌরজগতের বাহিরে যে সকল জ্যোতিষ্ক দেখা যায়, উহাদের দূরত্ব এত বেশি যে, উহা লিখিয়া কোনো ভাষায় প্রকাশ করিতে হইলে মাইল বা ক্রোশে কুলায় না। তাই বিজ্ঞানীরা উহা হিসাব করেন আলোক বৎসরে। এক সেকেণ্ডে প্রায় ১৮৬ হাজার মাইল বেগে চলিয়া আলোকরশ্মি এক বৎসরে যতদূর পথ অতিক্রম করিতে পারে, বিজ্ঞানীরা তাহাকে বলেন ‘এক আলোক বৎসর। সৌরজগতের বাহিরের যে কোনো জ্যোতিষ্কের দূরত্ব নির্ণয় করিতে হইলে আলোক বৎসর ব্যবহার করিতে হয়। পৃথিবী হইতে সূর্যের দূরত্ব প্রায় ৯৩০ লক্ষ মাইল, সূর্য হইতে পৃথিবীতে আলো আসিতে সময় লাগে প্রায় ৮ মিনিট। কিন্তু মহাকাশের কোটি কোটি নক্ষত্রের মধ্যে সবচেয়ে কাছে অন্য যে নক্ষত্রটি আছে, তাহার আলো পৃথিবীতে আসিতেও সময় লাগে প্রায় ৪ বৎসর। মহাকাশে চারি আলোক বৎসরের কম দূরত্বে কোনোদিকে সূর্য ব্যতীত কোনো নক্ষত্রই নাই।
আজ পর্যন্ত মহাকাশে প্রায় ১০,০০০ কোটি নক্ষত্রের সন্ধান বিজ্ঞানীরা পাইয়াছেন। উক্তরূপ দূরে দূরে থাকিয়া ঐ সমস্ত নক্ষত্র যে বিশাল স্থান জুড়িয়া আছে, তাহাকে বলা হয় নক্ষত্র জগত। নক্ষত্ররা প্রত্যেকেই এক একটি সূর্য, কোনো কোনোটি মহাসূর্যও বটে। মহাকাশে এরূপ নক্ষত্রও আছে, যাহারা আমাদের সূর্য অপেক্ষা কোটি কোটি গুণ বড়।[৪]
আমাদের সূর্য যে নক্ষত্র জগতে অবস্থিত, সেই নক্ষত্র জগতটি আবর্তিত হইতেছে। আমাদের সৌরজগতটি এই নক্ষত্র জগতের কেন্দ্র হইতে প্রায় ৩০ হাজার আলোক বৎসর দূরে থাকিয়া প্রতি। সেকেণ্ডে প্রায় ১৭৫ মাইল বেগে নক্ষত্র জগতের কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করিতেছে। একবার প্রদক্ষিণ করিতে সময় লাগে প্রায় ২২২ কোটি বৎসর। আমাদের এই সৌরজগতটিও নক্ষত্র জগতের কেন্দ্রে নহে।[৫]
নক্ষত্র জগতকে সুদূর হইতে দেখিলে উহার নক্ষত্রগুলিকে ভিন্ন ভিন্ন দেখা যায় না, সমস্ত নক্ষত্র মিলিয়া একটি ঝাপসা আলো বা মেঘের মতো দেখায়। ঐ রকম মেঘকে নীহারিকা বলা হয়। (ইহা ভিন্ন আর এক জাতীয় নীহারিকা আছে, উহারা শুধু বাম্পময়)। বিজ্ঞানীরা এই পর্যন্ত প্রায় ১০ কোটি নীহারিকা বা নক্ষত্র জগতের সন্ধান পাইয়াছেন এবং সবগুলি নীহারিকা মিলিয়া যে পরিমাণ স্থান জুড়িয়া আছে, তাহাকে বলেন নীহারিকা জগত বা ‘বিশ্ব। আমাদের নক্ষত্র জগত বা নীহারিকাটি যে বিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত, এমন কথাও বলা যায় না। এই বিশ্ব এতই বিশাল যে, ইহার এক প্রান্ত হইতে আর এক প্রান্তের দূরত্ব অর্থাৎ ব্যাস প্রায় ৪,০০০ কোটি আলোক বর্ষ।[৬] বিজ্ঞানীপ্রবর আইনস্টাইন বলেন যে, নীহারিকা জগত বা বিশ্ব ক্রমশ প্রসারিত হইতেছে।
বিশ্বের আয়তনের বিশালতা আমরা শুধু কথায় বা লেখায়ই প্রকাশ করিতে পারি, কিন্তু ধারণায় আনিতে পারি না। এই কল্পনাতীত বিশ্ব এমনই বিশাল যে, জীবসমাকুল পৃথিবী, গ্রহসমাকুল সৌরজগত, এমনকি সৌরসমাকুল নক্ষত্র জগত পর্যন্ত ইহার মধ্যে হারাইয়া যায়। অর্থাৎ বিশ্বে এমনও স্থান আছে, যেখান হইতে চাহিলে আমাদের পৃথিবী, সূর্য, এমনকি বিশাল নক্ষত্র জগতও অদৃশ্য হইয়া পড়ে।
.
# বিশ্বের আকৃতি
এককালে মানুষের ধারণা ছিল যে, পৃথিবী থালার মতো গোল ও চ্যাপ্টা এবং ইহার চতুর্দিকে প্রাচীর বা পর্বত দ্বারা ঘেরাও করা। সেই প্রাচীর বা পর্বতের নাম কোহেক্বাফ। কোহেকৃাফের বহির্ভাগে কি আছে না আছে, কোনো মানুষ তাহা জানে না। তখন স্থির হইয়াছিল যে, পৃথিবীর উপরে আছে আসমানি ছাদ এবং সীমান্তে কোহেক্বাফ। কিন্তু নিচে? কেহ বলিলেন, পৃথিবীর নিচে জল, কেহ বলিলেন মাছ; এইরূপ কেহ গরু, কেহ কচ্ছপ ইত্যাদি বলিলেন। এই সব অলীক কল্পনার জন্য উহাদের নিন্দা করা যায় না। কেননা সেই যুগের মানুষ হইলে আমরা কি বলিতাম? হয়তো ঐরূপই কিছু। আর তাহারা যদি এই যুগের মানুষ হইতেন এবং ভূগোল খগোল পাঠ করিতেন, তবে তাহারাও বলিতেন, “পৃথিবী কমলালেবুর মতো গোল এবং শূন্যে থাকিয়া নিজে নিজে ঘুরপাক খায় ও নিয়ত সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে; অধিকন্তু পৃথিবীর ন্যায় আরও ১০টি গ্রহ আছে, উহারাও পৃথিবীর মতো সূর্যের চতুর্দিকে ঘুরপাক খায়।”