“তৃতীয়ত নিছক শূন্য (nothing) থেকে জগত সৃষ্টি করা ঈশ্বরের পক্ষেও সম্ভব নয়, কেননা শূন্য থেকে শূন্যই পাওয়া যায়। অসৎ থেকে সৎ-এর সৃষ্টি কিভাবে সম্ভব? যদি ধরে নেওয়া যায়। যে, ঈশ্বর নিছক শূন্য থেকে জগত সৃষ্টি করেছেন, তাহলে জগতও নিছক শূন্য হবে; যেহেতু কার্য কারণেরই পরিণাম। কারণে যা থাকে, তাই কার্যে পরিণত হয়। আবার যদি বলা যায় যে, ঈশ্বর পূর্বস্থিত জড় থেকেই এই জগত সৃষ্টি করেছেন, তাহলে এই জড়ের অস্তিত্ব ঈশ্বরকে সীমিত করবে, কিন্তু ঈশ্বরকে বলা হয়েছে অসীম ও অনন্ত, তার কোনো সীমা থাকতে পারে না।
“চতুর্থত ঈশ্বর কোনো এক বিশেষ মুহূর্তে জগত সৃষ্টি করলেন কেন? তার পূর্বে বা পরে কেন জগত সৃষ্টি করলেন না? সৃষ্টিবাদীরা এই সব প্রশ্নের উত্তর দেন নি। তা ছাড়া অনন্তকালের কোনো এক বিশেষ মুহূর্তে ঈশ্বর জগত সৃষ্টি করেছেন –এ যদি স্বীকার করা যায়, তাহলে জগত সৃষ্টির পূর্বেও কালের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়। কিন্তু জগত ছাড়া অর্থাৎ কোনো ঘটনা ছাড়া শূন্যগর্ভ কালের অস্তিত্ব কল্পনাই করা যায় না।
“পঞ্চমত জগত সৃষ্টির পর ঈশ্বর যদি জগতের বাইরে অবস্থান করেন অর্থাৎ কিনা এই জগত যদি ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্কবিযুক্ত হয়ে অবস্থান করে, তাহলে এই স্বতন্ত্র জগতের সত্তা ঈশ্বরকে সীমিত করবে এবং সে ক্ষেত্রে ঈশ্বরকে সসীম বলা যাবে।
“যষ্ঠত জগতের মধ্যে যদি বিপর্যয় দেখা দেয় বা জগত যদি ঈশ্বরের পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট পথে না চলে, তাহলে প্রয়োজনবোধে ঈশ্বর জগতের কার্যে হস্তক্ষেপ করেন— এ মতবাদও গ্রহণযোগ্য নয়, কেননা তাহলে ধারণা করতে হয় যে, ঈশ্বর নিখুঁত শিল্পী নন এবং ঈশ্বরের জগতসৃষ্টির মধ্যে নৈপুণ্যের অভাব ছিল। তা ছাড়া জগতের অমজননক বিষয় ও ঘটনাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে : যদি জগতের উপাদান এড়ই অমওঃ লর কারণ হয়, তাহলে ধারণা করতে হবে যে, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের উপাদানের দোয়ত্রুটি দূর করার সামর্থ নেই; কিন্তু এ জাতীয় ধারণা ঈশ্বরের ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
“সপ্তমত সৃষ্টিবাদ অনুসারে ঈশ্বরের সঙ্গে জগতের সম্পর্ক বাহ্য সম্পর্ক (external relation), কিন্তু এ মত স্বীকার করা যায়না। ঈশ্বর জগতের কারণ বলার অর্থ, জগতের মধ্য দিয়েই ঈশ্বরের প্রকাশ বা ঈশ্বরের সত্তা জগতের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত। অর্থাৎ ঈশ্বরের সঙ্গে, জগতের সম্পর্ক আন্তর সম্পর্ক (internal relation)।
“সবশেষে, এই মতবাদে ঈশ্বরকে মানুষ বা সাধারণ কারিগরের মতো কল্পনা করা হয়েছে। কোনোমতেই যুক্তিসঙ্গত নয়।
“সুতরাং, সৃষ্টিবাদ গ্রহণযোগ্য মতবাদ নয়। আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ এই জগতের গঠন ও ইতিহাস সম্পর্কে গভীরভাবে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, একটি সহজ সরল অবস্থা থেকে ক্রমে ক্রমে পরিবর্তিত হয়ে জগত আজকের এই জটিল অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। সুতরাং বিজ্ঞানের দ্বারা সমর্থিত এই অভিব্যক্তিবাদ বা বিবর্তনবাদই গ্রহণযোগ্য মতবাদ।” এখন আমরা সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক মতবাদ বা বিবর্তনবাদ-এর কিঞ্চিৎ আলোচনা করিব, প্রথম পদার্থ ও পরে জীব বিষয়ে।
০৫. বিজ্ঞান মতে সৃষ্টিতত্ত্ব (পদার্থ বিষয়ক)
বিজ্ঞান মতে সৃষ্টিতত্ত্ব
পদার্থ বিষয়ক
দেখা যায় –সনাতন ধর্মীয় সৃষ্টিতত্বে কোথায়ও কার্যকারণ সম্পর্কের ধারা বজায় নাই এবং জীব বা জড় পদার্থ, ইহাদের কোনো কিছু সৃষ্টির জন্য কোনো উপাদানের উল্লেখ নাই, আছে শুধু ব্যবহার। উহা যেন পূর্ব হইতেই প্রস্তুত ছিল। সৃষ্টিতত্ত্বের ধর্মীয় ব্যাখ্যায় যুক্তির কোনো স্থান নাই। কার্যকারণ সম্পর্ক বজায় রাখিয়া যুক্তির সাহায্যে জগতের প্রত্যেকটি ঘটনা ব্যাখ্যা করিবার চেষ্টা করিল দর্শন। পরবর্তীকালে দর্শনশাস্ত্রের কার্যকারণ সম্পর্ক ও যুক্তিসমূহের উপর ভিত্তি করিয়া প্রমাণসহ জাগতিক ঘটনা ব্যাখ্যা করিতে চেষ্টা করিল বিজ্ঞান।
সৃষ্টিতত্ত্বের ধর্মীয় মতবাদের অনেকটাই আজ বিজ্ঞানের কাছে অবান্তর বলিয়া প্রতিপন্ন হইয়াছে। “পৃথিবী চ্যাপ্টা নহে, গোল” –ইহা এখন সর্ববাদীসম্মত সত্য। “পূর্ব হইতে সূর্যের পশ্চিম দিকে গতি কোনো স্বর্গীয় দূতের টানাটানিতে হয় না, উহা হয় পৃথিবীর আহ্নিক গতির ফলে” –ইহা এখন পাঠশালার শিশুরাও জানে। “পৃথিবী মাছ, গরু বা জলের উপর অবস্থিত নহে এবং চন্দ্র, সূর্য ও তারকারা ছাদ-আকৃতি আসমানে লটকানোও নহে; উহারা সকলেই শূন্যে অবস্থিত” –ইহা অবিশ্বাস করিবার মতো লোক এখন দুনিয়ায় অল্পই আছে।
সৃষ্টিতত্ত্বে বিজ্ঞানের এলাকা সুবিশাল। ধর্ম যেমন এক কথায়, গ্রন্থের কয়েক পঙক্তি বা পৃষ্ঠায়। বিশ্বের যাবতীয় সৃষ্টিতত্ত্ব সাগ করিয়াছে, বিজ্ঞান তাহা পারে নাই। বিজ্ঞানের সৃষ্টিতত্ত্ব বহুশাখাবিশিষ্ট এবং প্রত্যেক শাখায় গ্রন্থরাজি অজস্র। যেমন –আকাশতত্ত্ব, ভূতত্ত্ব, উদ্ভিদতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, জীবতত্ত্ব, ভূণতত্ত্ব ইত্যাদি। উহার আলোচনাসমূহের বিষয়সূচী লিখাও দুই-চারিখানা পুস্তকে সম্ভব নহে। কাজেই আমরা শুধু উহার কয়েকটি বিষয়ের কিঞ্চিৎ আভাস দিতে চেষ্টা করিব।
.
# বিশ্বের বিশালতা
সনাতন ধর্মীয় মতে –পৃথিবী বিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত, যাবতীয় সৃষ্টির মধ্যে বৃহত্তম বস্তুপিণ্ড এবং মানুষ জীবকুলের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, ঈশ্বরের শখের সৃষ্টি এক বিশেষ জীব। মানুষ ঈশ্বরের শখের সৃষ্টি এক বিশেষ জীব কি না, সেই আলোচনা পরে হইবে; এখন দেখা যাক– পৃথিবী বিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত ও বৃহত্তম পদার্থ কি না।