পূর্বে আলোচিত আদিম জাতিসমূহের ও বেদ-বাইবেলাদির সৃষ্টিতত্ত্বসমূহ সৃষ্টিবাদ-এর অন্তর্ভুক্ত এবং সামান্য মতানৈক্য থাকিলেও জগতের যাবতীয় ধর্মীয় মতবাদই সৃষ্টিবাদের আওতাভুক্ত। জগত ও জীবন সৃষ্টি সম্বন্ধে বিজ্ঞানীদের সর্বস্বীকৃত যে মত, তাহাই অভিব্যক্তিবাদ বা বিবর্তনবাদ। দার্শনিকগণ সকলে না হইলেও বেশির ভাগই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে বিবর্তনবাদী। এই বিষয়ে একজন আধুনিক দার্শনিকের মতবাদের উল্লেখ করিতেছি। তিনি বলেন —
“সৃষ্টিবাদ অনুসারে জগতের একজন স্রষ্টা আছে। সাধারণত ঈশ্বরকেই জগতের স্রষ্টা বলা হয়; কিন্তু যারা ঈশ্বরবিশ্বাসী নন, এমন লেখকেরা প্রকৃতিকে জগতের উৎস বলে মনে করেন। যেমন, মিল (Mill)-এর মতে ঈশ্বর বলে কেউ নেই।“
“প্রকৃতি থেকেই জগতের সৃষ্টি। এমন এক সময় ছিল যখন জগতের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ঈশ্বর বা প্রকৃতি কোনো এক বিশেষ মুহূর্তে জগত সৃষ্টি করেছিল। যাবতীয় বস্তু এবং জীব জগতসৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই সৃষ্ট হয়েছে। গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র, বিভিন্ন ধরণের উদ্ভিদ এবং প্রাণীতে পূর্ণ এই জগত প্রথমে যেভাবে সৃষ্ট হয়েছিল, আজও ঠিক একইভাবে বর্তমান। মূলত এর রূপ বিন্দুমাত্রও পরিবর্তিত হয়নি।
“ঈশ্বরবিশ্বাসী সৃষ্টিবাদের দুইটি রূপ আছে। যথা –ক. নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদ (Theory of Absolute Creation) 978 3. 129Tapa lama (Theory of Dependent or Conditional Creation)।
“ক. নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদ –এ মতবাদ অনুসারে নিছক শূন্য (nothing) থেকে ঈশ্বরের দ্বারা এই জগত সৃষ্ট হয়েছিল। এমন এক সময় ছিল, যখন এই জগতের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ঈশ্বর হলেন সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, সর্বব্যাপী এক শাশ্বত সনাতন পুরুষ। তিনি হলেন পূর্ণ; সেই কারণে এই জগতের কোনো প্রয়োজন তার ছিল না। কিন্তু তবু তার ইচ্ছা হলো, এক জগতের সৃষ্টি হোক। অমনি সঙ্গে সঙ্গেই জগতের সৃষ্টি হলো। জগত সৃষ্ট হবার পর ঈশ্বর তাঁর সৃষ্টি প্রাকৃতিক শক্তির উপরই জগতকে ছেড়ে দিলেন। এই প্রাকৃতিক শক্তিই জগতকে নিয়ন্ত্রিত ও চালিত করতে লাগল। ঈশ্বর এই জগতের প্রথম বা মুখ্য কারণ (first cause)। এই প্রাকৃতিক শক্তিগুলি হলো দ্বিতীয় বা গৌণ কারণ (second cause)। জগত সৃষ্ট হবার পর ঈশ্বর জগতের বাইরে অবস্থান করেন এবং প্রয়োজন হলে জগতের পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করেন। এই মতবাদ অনুসারে জগতকে আমরা বর্তমানে যেভাবে বা যে রূপে দেখছি, জগত সেইভাবে সৃষ্ট হয়েছিল। জগত কোনোরূপ ক্রমবিকাশ বা বিবর্তনের ফলে বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়নি।
“খ. সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদ –এই মতানুযায়ী ঈশ্বর নিছক শূন্য থেকেই এই জগত সৃষ্টি করেন নি, জড়ের (matter) থেকে তিনি এই জগত সৃষ্টি করেছেন। ঈশ্বরের মতো জড় নিত্য ও অবিনাশী; জগত সৃষ্ট হবার পূর্বেই জড়ের অস্তিত্ব ছিল। এই জড়ের কোনো আকার ছিল না, এই জড় এলোমেলো এবং বিশৃঙখল অবস্থায় ছিল। ঈশ্বর এই জড়োপাদানকে একটা নির্দিষ্ট আকার দিলেন এবং এই বিশৃঙ্খল এলোমেলো উপাদানের মধ্যে শৃঙ্খলা এনে এই সুন্দর জগত সৃষ্টি করলেন। ভারতীয় দর্শনেও আমরা এই জাতীয় সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদের দেখা পাই। বৈশেষিক দার্শনিকদের মতে, ঈশ্বর ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুতের নিত্য পরমাণুগুলির সাহায্যে এই জগত সৃষ্টি করেছেন। যে কোনো সৃষ্টির ক্ষেত্রে দুটি কারণ থাকে –একটি নিমিত্ত কারণ, আর একটি উপাদান। কারণ। জগতসৃষ্টির মূলেও এই দু’প্রকার কারণ ছিল। ঈশ্বর হলেন নিমিত্ত কারণ, জড় হলো উপাদান কারণ।
“পূর্বোক্ত উভয় প্রকার সৃষ্টিবাদে নিম্নলিখিত বৈশিষ্টগুলি পাওয়া যায় —
“অনন্তকাল ধরে ঈশ্বর এই জগত ছাড়া একাকীই ছিলেন। যেহেতু তিনি পূর্ণ, সেহেতু জগতের কোনো প্রয়োজন ছিল না। হয় নিছক শূন্য থেকেই, নতুবা পূর্বস্থিত জড়কেই উপাদানরূপে গ্রহণ করে তিনি এই জগত সৃষ্টি করেছেন। কোনো এক বিশেষ মুহূর্তে খেয়ালবশত ঈশ্বর এই জগত সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টির পর এই জগত ঈশ্বরের পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী চলতে থাকে। কেবলমাত্র প্রয়োজনবোধে অর্থাৎ জাগতিক ব্যাপারে যখন কোনো বিপর্যয় দেখা দেয়, তখনই ঈশ্বর জগতের কাজে হস্তক্ষেপ করেন। ঈশ্বর জগতের অভ্যন্তরে বিরাজ করেন না, জগতের বাহিরেই অবস্থান করেন। ঈশ্বরের সঙ্গে জগতের সম্পর্ক বাহ্য সম্পর্ক (external relation), আন্তর সম্পর্ক (internal relation) নয়।”
উপরোক্ত মতবাদের সমালোচনায় তিনি বলেন —
“পূর্বোক্ত সৃষ্টিবাদ গ্রহণযোগ্য মতবাদ নয়। এই মতবাদ বিজ্ঞানের দ্বারাও সমর্থিত নয়। এই মতবাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগগুলি আনা যেতে পারে —
“প্রথমত এই মতবাদ অনুসারে ঈশ্বর পূর্ণপুরুষ— তার জগতের কোনো প্রয়োজন ছিল না। তবে তিনি এই জগত সৃষ্টি করলেন কেন? কোনো অভাববোধ থেকে এই জগত সৃষ্ট হতে পারে না, কারণ পূর্ণপুরুষের কোনো অভাবের প্রশ্ন ওঠে না। যদি বলা যায়, জীবের উপর করুণাবশত তিনি এই জগত সৃষ্টি করেছেন– তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায়, এরই বা কি প্রয়োজন থাকতে পারে? সৃষ্টিবাদীরা এর কোনো সদুত্তর দেন না।
“দ্বিতীয়ত ঈশ্বর অন্য জগত সৃষ্টি না করে এই জগত সৃষ্টি করলেন কেন? ঈশ্বরের জগতের প্রয়োজন ছিল না –একথা বলাও যুক্তিযুক্ত নয়, কেননা জগতসৃষ্টির মাধ্যমে প্রকাশিত না হলে। জীবনের পক্ষে ঈশ্বরের সত্তাকে অনুভব করা সম্ভব নয়।