লিউকিপ্পাস (খ্রী. পূ. ৪৩০) –সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ে লিউঁকিপ্পাসের মত এইরূপ — “বিশ্ব অনন্ত, ইহার কোনোও অংশ শূন্যতাময়, কোনোও অংশ পরমাণুপূর্ণ। পরমাণুসমূহ শূন্যস্থানে বিক্ষিপ্ত হইলে পরস্পর প্রতিহত হয় এবং তাহাদের মধ্যে ভীষণ সংঘর্ষ চলিতে থাকে। তাহাতে শূন্যসাগরে বিষম আক্ষেপ উপস্থিত হয়। ফলে, এক এক জাতীয় পরমাণু পরস্পর মিলিত হয় এবং তাহাতে তাহাদের এক এক প্রকার আকৃতি গঠিত হইয়া যায়। আপনা-আপনি নিয়তিবশে এই বিক্ষেপ ও মিলন-ব্যাপার সংঘটিত হইতেছে। ইহার সহিত কোনোও দৈবশক্তির সম্বন্ধ নাই।”
সক্রেটিস ও প্লেটো (খ্রী. পূ. ৪৬৯ ও ৪২৯) –সক্রেটিস ও প্লেটো, উভয়েই এথেন্স নগরের অধিবাসী ছিলেন। গ্রীসদেশীয় দার্শনিকগণের মধ্যে সক্রেটিস প্রখ্যাতনামা। তিনি ‘জ্ঞান’কেই শ্রেষ্ঠ বলিয়া স্বীকার করিয়া গিয়াছেন। তাহার মতে, “ন্যায়পরতাই মানুষের ধর্ম।” সুতরাং ঈশ্বরের সৃষ্টিকর্তৃত্বে বা অস্তিত্বে তিনি সন্দিহান ছিলেন। তিনি দেশমান্য দেবতাগণের পূজা করিতেন না। তাহার মতের অনুসরণ করিয়া যুবকগণ বিপথগামী হইতেছে, এই অজুহাতে সক্রেটিস রাজদ্বারে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন। ত্রিশ দিবস কারাগারে আবদ্ধ থাকিয়া তিনি বিষপানে প্রাণত্যাগ করেন। দেববিরোধিতার অপরাধে এরূপ অমানুষিক হত্যাকাণ্ড পাশ্চাত্য দেশে ইহা নূতন নহে। দার্শনিক আনাক্সাগোরাস দেব-দেবীর প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করিতেন বলিয়া তাহার প্রাণদণ্ডের আদেশ হয় এবং তাহার শিষ্য পেরিক্লেসের বাগ্মিতায় বিচারপতি মুগ্ধ হইয়া আনাক্সাগোরাসের প্রাণদণ্ড রহিত করিয়া হেলেস্পন্ট দ্বীপে নির্বাসিত করেন। সেখানে নির্বাসিত থাকিয়া তিনি ৭৩ বৎসর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। দেব-দেবীর অনস্তিত্ব বিষয়ে শিক্ষা প্রচার করিতেন বলিয়া দার্শনিক প্রোটাগোরাসের প্রাণদণ্ড হইয়াছিল।
সক্রেটিসের শিষ্যগণের মধ্যে প্লেটোর নাম সর্বপ্রসিদ্ধ। মুসলমানগণ ইহাকে ‘আফলাতুন’ বলিয়া থাকেন। সৃষ্টি সম্বন্ধে ইহার মতের সারমর্ম এই — পৃথিবী চিরদিন বিদ্যমান আছে; ইহা সেই মঙ্গলময়ের প্রতিরূপ মাত্র। ইহার অন্তর্গত ভূতসমূহ অনন্তকাল হইতেই পরিবর্তনশীল; পরিবর্তন প্রবাহে সৃষ্টিক্রিয়া সংসাধিত হইতেছে।
আরিস্টটল (খ্রী. পূ. ৩৮৪) –গ্রীসের উপনিবেশ স্টেজেরা নামক স্থানে আরিস্টটলের জন্ম হয়। সৃষ্টি প্রকরণ সম্বন্ধে তাঁহার মত এই –“কেবল স্বর্গ ও পৃথিবী বলিয়া নহে; চেতন, অচেতন সমস্ত বস্তুই অনন্তকাল হইতে পৃথিবীতে বিদ্যমান আছে। এই বিশ্ব এক স্বর্গীয় আত্মার প্রতিরূপ। সেই আত্মা কখনও নিশ্চেষ্ট নহেন। তিনি শক্তি ও কার্য স্বরূপ; বিশ্বের গতি, সৃষ্টি এবং আকৃতির মূলে সেই স্বর্গীয় আত্মার প্রভাব চিরবিদ্যমান।” এই প্রসিদ্ধ দার্শনিকের মতে, “এই বিশ্ব আত্মার সৃষ্ট নহে; পরন্তু তাহা (আত্মা) হইতে উৎপন্ন। জাগতিক পদার্থ দশ প্রকার; যথা –দ্রব্য, পরিমাণ, গুণ, সম্বন্ধ, স্থান, সময়, অবস্থা, সামান্য, কার্য ও ভাব।” বলা বাহুল্য, এই কয়েকটি পদার্থের উপরই সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় নির্ভর করিতেছে।
লেবনিজ (খ্রী. অ. ১৬৪৬) –ইনি জর্মন দর্শনের সৃষ্টিকর্তা বলিয়া কথিত হন। তিনি বলেন, “মন ও শরীরের কার্য, দুইটি স্বাধীনভাবে পরিচালিত কলের কার্য বলিয়া মনে করিতে হইবে। সেসকল পূর্বব্যবস্থাপিত একটি নিয়মানুসারে পরিচালিত হইতেছে। ব্যবস্থাপক ঈশ্বরও হইতে পারেন। কিন্তু তিনি নিয়ম করিয়া দিয়া গিয়াছেন মাত্র। এখন যে তিনি কোনো কাজ করাইতেছেন, তাহা বলা যায় না। পক্ষান্তরে হল্যাণ্ডের দার্শনিক স্পিনোজা ঈশ্বরকে ‘সর্বকারণকারণ বলিয়া স্বীকার করিতেন। দার্শনিকদের মধ্যে এরূপ বিপরীত মতবাদ আরও আছে। আরিস্টটল প্রবর্তিত সম্প্রদায়ের মতে, “পৃথিবীর গতি নাই, পৃথিবী নিশ্চল ও সীমাবদ্ধ।” কিন্তু ব্রুনো ঘোষণা করেন, “পৃথিবী ঘূর্ণিত হইতেছে; বিশ্ব অসীম এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অনন্তকাল ধরিয়া পরিবর্তন চলিয়াছে।”[৩]
সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ে পাশ্চাত্যের মাত্র কয়েকজন দার্শনিকের মতবাদসমূহের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হইল। ইহা ভিন্ন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শত শত দার্শনিকের শত শত মতবাদ দৃষ্ট হয়। উহাতে কোথায়ও আছে একাধিক দার্শনিকের মতের মিল, আবার কোথায়ও গরমিল, হয়তোবা বৈপরীত্যও। তথাপি অধিকাংশ দার্শনিকের একটি শেষ সিদ্ধান্ত আছে। তাহা এই — “এক অনাদি, অনন্ত, গরীয়ান ‘সৎ’ নিজেকে নানাভাবে ব্যক্ত করিতেছে– মানুষের দেহে, মনে, সমাজে, তাহার দীর্ঘ ইতিহাসে, জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে, বৃক্ষে, লতায়, পুষ্পে; সুন্দর-অসুন্দর এবং সৎ অসৎ ব্যাপিয়া সে আত্মপ্রকাশ করিতেছে; আর মানুষের মনেও সেই প্রকাশের মহিমা ধ্যান করিবার মতো শক্তিরূপে বিরাজ করিতেছে। এই সৎ এক এবং অদ্বিতীয়; বহুধা ব্যক্ত, কতক ব্যক্ত এবং কতক অব্যক্ত।”
————
[৩. পৃথিবীর ইতিহাস, ৩য় খণ্ড, দুর্গাদাস লাহিড়ী, পৃ. ৫৬–৬৬।]
০৪. সৃষ্টিবাদ ও বিবর্তনবাদ
সৃষ্টিবাদ ও বিবর্তনবাদ
সৃষ্টিতত্ত্ব জানার কৌতূহলটি মানব মনে বহুদিনের পুরাতন। এই কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য মানুষ বহু মতবাদের জন্ম দিয়াছে। তবে সেই সমস্ত মতবাদকে সাধারণত চারিটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যথা –আদিম মত, ধর্মীয় মত, দার্শনিক মত ও বৈজ্ঞানিক মত। এই কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে। তাহার মধ্যে আদিম জাতিদের মত, ধর্মীয় মত ও দার্শনিক মতবাদের কিছু কিছু আলোচনা এযাবত করা হইয়াছে। উহাতে দেখা গিয়াছে যে, আদিম ও ধর্মীয় মতবাদের প্রায় সব ক্ষেত্রেই এক এক জন সৃষ্টিকর্তা ছিলেন এবং তাঁহারা ছিলেন কোথায়ও ঈশ্বর, কোথায়ও দেবতা, কোথায়ও পশু-পাখি, এমনকি কোথায়ওবা পতঙ্গ। সেই সকল সৃষ্টিকর্তাদের স্বরূপ যাহাই হউক না কেন, সকল মতবাদের আসল রূপ একটিই। বর্তমান জগতটিকে আমরা যেরূপ দেখিতে পাইতেছি, ইহা সেই রূপেই সৃষ্টি করা হইয়াছিল এবং যত রকম গাছপালা ও জীব-জানোয়ার দেখিতেছি, সৃষ্টিকর্তা উহার প্রত্যেকটিকে এই রূপেই সৃষ্টি করিয়া পৃথিবীতে ছাড়িয়া দিয়াছিলেন। ইহাদের মধ্যে কাহারও ‘জাতিগত রূপ’-এ কোনো পরিবর্তন বা নূতনত্ব নাই। ইহারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ জাতিগত রূপ ও চরিত্রগত বৈশিষ্ট বজায় রাখিয়া বংশবৃদ্ধি করিতেছে মাত্র। সাধারণত এইরূপ একটি ধারণা সকল ক্ষেত্রেই বিদ্যমান। আর এই রকম ধারণাকে বলা হয় সৃষ্টিবাদ। জড় কিংবা জীবজগতে এক-এর রূপান্তরে বহু’র উৎপত্তি– এইরূপ ধারণাকে বলা হয় অভিব্যক্তিবাদ বা বিবর্তনবাদ।