থেলিস (জন্ম খ্রী. পূ. ৬৪০) –ইনি গ্রীস দেশের আদি দার্শনিক। ইনি বলিতেন, “জলই সংসারের সার-সর্বস্ব। জল হইতেই এই বিশ্বসংসারের সৃষ্টি হইয়াছে; জলেই সংসার লয়প্রাপ্ত হইবে।”
আনাক্সিমান্দর (খ্রী. পূ. ৬১০–৫৪৬) –ইনি দার্শনিক থেলিসের শিষ্য। সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধে ইহার মত –“বিশ্ব অনন্তকাল বিদ্যমান। তাহার অংশবিশেষের পরিবর্তন সাধিত হইতেছে মাত্র। অনন্তকাল হইতে সকল বস্তুর উদ্ভব। অনন্তেই সকল বস্তু বিলীন হইবে।” তাঁহার মতে, জগতের মূল পদার্থ নিত্য, অসীম এবং তাহা নির্দেশ করা যায় না।
পিথাগোরাস (জন্ম খ্রী. পূ. ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগ)– ইতালির স্যামজ দ্বীপের অধিবাসী এই দার্শনিক সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধে বলিতেন, “বিশ্বের কেন্দ্রস্থলে এক অগ্নিপিণ্ড বিদ্যমান আছে। দশটি স্বর্গীয় গ্রহ বা উপগ্রহ তাহার চতুর্দিকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। তদ্বারা শীত, উত্তাপ প্রভৃতির সঞ্চারে সৃষ্টিকার্য সমাহিত হইতেছে। সামঞ্জস্যই জগতের অস্তিত্ব। সেই কেন্দ্রীভূত অগ্নিপিণ্ডই তাপ, আলোক বা প্রাণ স্থানীয়। জীবাত্মা মাত্রই সেই অগ্নিপিণ্ডের বা তেজের অংশবিশেষ। সর্বপ্রাণাধার সেই তেজ বা অগ্নিপিণ্ডই ঈশ্বর। ঈশ্বর প্রথমে অব্যবস্থাপিত জড় পদার্থ সহ বিদ্যমান ছিলেন। তাঁহার শক্তিপ্রভাবে তৎসমুদয় বিচ্ছিন্ন হয়। বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর তিনি পৃথকভাবে অবস্থিত আছেন।”
আত্মার দেহান্তর গ্রহণ পিথাগোরাস স্বীকার করিতেন। ঈশ্বরকে মনঃস্বরূপ বলিয়া তিনি প্রচার করিয়া গিয়াছেন। তিনি বলিতেন, “সংসারে সকলের মধ্যেই তিনি (ঈশ্বর) বিদ্যমান। প্রত্যেক মানুষের আত্মাই তাহার অংশ।” পরবর্তী অনেক দার্শনিক পিথাগোরাসের মত মান্য করিয়াছিলেন এবং কোনো কোনো ধর্মবেত্তাও।
পিথাগোরাসের বিশ্বরূপ ও সৃষ্টিতত্ত্ব আধুনিক সৌরজগত ও সৌরবিজ্ঞানের সহিত বহুলাংশে সাদৃশ্যপূর্ণ।
জেনোফেনস (খ্রী. পূ. ৫৬০–৫৪০) –এশিয়া মাইনরের অন্তর্গত কলফো নগরে দার্শনিক জেনোফেস্ জন্মগ্রহণ করেন। তাহার মতে, “এই বিশ্ব যেভাবে অবস্থিত দেখিতে পাইতেছি, সেইভাবেই চিরদিন বিদ্যমান আছে এবং থাকিবে।” জেনো চারি ভূতের অস্তিত্ব স্বীকার করিতেন। তাহার মতে, “উত্তাপ ও আর্দ্রতা, শৈত্য ও শুষ্কতা –এই চারি ভূতে সংসার উৎপন্ন। মনুষ্য মৃত্তিকা হইতে নির্মিত। চারি ভূতের সংমিশ্রণে তাহার প্রাণশক্তি সঞ্চারিত।” জগতের সৃষ্টি ও স্থিতি বিষয়ে বৌদ্ধরা জেনোর মতানুসারী।
হিরাক্লিটাস (জন্ম খ্রী. পূ. ৫০৩) –ইনি এশিয়া মাইনরের অন্তর্গত ইফেসাস নগরে জন্মগ্রহণ করেন। হিরাক্লিটাসের দার্শনিক গ্রন্থে প্রকাশ, “তেজ (আগুন) হইতেই পৃথিবীর সৃষ্টি; আবার তেজেই বিশ্বের লয়। তেজ বা অগ্নি সূক্ষ, অনন্ত, অপরিবর্তনীয় এবং চির গতিবিশিষ্ট। অগ্নিরই স্থূলতর অংশ বায়ু; বায়ু হইতে জল এবং জল হইতে পৃথিবীর উৎপত্তি। আত্মা বা প্রাণ জ্বলনশীল অথবা বায়বীয় পদার্থ।”
এম্পিডোকলস (খ্রী. পূ. ৪৫০) –ইনি সিসিলি দ্বীপের এগ্রিজেন্টাস নগরের অধিবাসী। ঘঁহার মতে, “বায়ু, জল, অগ্নি, পৃথিবী (মাটি) — এই চারি পদার্থের সংযোগ-বিয়োগেই এই পৃথিবীর সৃষ্টি হইয়াছে। প্রথমে ঐ চারি মূল পদার্থ একরূপ মিশ্রভাবে অবস্থিত থাকে। উহারা পরস্পর ভালোবাসা (আকর্ষণ) সূত্রে আবদ্ধ ছিল। যখন পরস্পরের মধ্যে ঘৃণার (বিকর্ষণের) সঞ্চার হইল, তখনই উহারা বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িল। সেই বিচ্ছেদের ভিন্ন ভিন্ন স্তরে পৃথিব্যাদি বিভিন্ন সামগ্রীর সৃষ্টিক্রিয়া সাধিত হইয়াছে।” বিশ্বসৃষ্টির মৌলিক উপাদান চারিটি, ইহা মুসলিম জগতেও স্বীকৃত। যথা –আব, আতস, খাক, বাত।
আনাক্সীগোরাস (জন্ম খ্রী. পূ. ৫০০) –আইওনিয়ার অন্তর্গত ক্রেজোমিনি নগরে হঁহার জন্ম হয়। সৃষ্টি সম্বন্ধে তাঁহার মত –“আদিতে অনন্তকাল হইতে সকল পদার্থই পরমাণুরূপে বিদ্যমান ছিল। সেই অসংখ্য পরমাণুপুঞ্জ এক অনন্ত শক্তি দ্বারা পরিচালিত হইয়া নানা আকার ধারণ করিতেছে। সেই অনন্ত শক্তির নাম ‘নৌস’। নৌস অবিমিশ্র ও সূক্ষ্ম, অনন্ত শক্তিসম্পন্ন এবং সর্বজ্ঞানাধার। আপনা-আপনি অন্ধ শক্তির দ্বারা পৃথিবীর কোনো বস্তু সৃষ্ট হয় নাই; নৌসই সকল সামগ্রীর সর্ববিধ আকৃতির সংগঠক। আকাশ স্থূল-পদার্থ-নির্মিত –খিলানের ন্যায় অবস্থিত। নক্ষত্রসমূহ এক একটি প্রস্তরপিণ্ড; কোনোরূপ পার্থিব আক্ষেপবশত ঊর্ধে উৎক্ষিপ্ত হইয়া গিয়াছে। আকাশে গিয়া ইথারের অগ্নিসংযোগে তাহারা প্রতিনিয়ত জ্বলিতেছে।” সূর্যকে তিনি প্রকাণ্ড জ্বলন্ত প্রস্তরখণ্ড বলিয়া বিশ্বাস করিতেন। তিনি বলিতেন, “সে প্রস্তরখণ্ড গ্রীসের পেলোপোনিসাস নগর অপেক্ষাও বৃহত্তর।” তাহার মতে, “মনই সকল বস্তুর জনয়িতা; প্রথমে সকলই বিশৃঙ্খল ছিল, মন সকলকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে। মন অনন্ত শক্তিসম্পন্ন। মনই নৌস।”
ডেমক্রিটাস (খ্রী. পূ. ৪৬০)– গ্রেস প্রদেশের অব্দেরা নগরে ডেমক্রিটাস জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষা ও নানাদেশ পর্যটনান্তে দেশে ফিরিয়া একমনে দার্শনিক চিন্তায় কালাতিপাত করিতে পারিবেন বলিয়া তিনি আপনার চক্ষুদ্বয় উৎপাটন করিয়াছিলেন এবং অন্ধ হইয়া একমনে দার্শনিক চিন্তায় নিমগ্ন ছিলেন। সৃষ্টি সম্বন্ধে তিনি বলিয়াছেন, “পরমাণু এবং গতি, এতদুভয়ের উপর সৃষ্টি নির্ভর করিতেছে। কোনো উচ্চ শক্তি ইচ্ছা করিয়া যে পরমাণুসমূহকে একত্র করিতেছে, তাহা নহে; আপনা-আপনিই নৈসর্গিক নিয়মে গতি দ্বারা চালিত হইয়া পরমাণুসমূহ সম্মিলিত ও বিচ্ছিন্ন হইতেছে; আর তাহাতেই সৃষ্টিকার্য সাধিত হইতেছে।” অনেকের বিশ্বাস –ডেমক্রিটাস পাশ্চাত্য দেশে নিরীশ্বরবাদের প্রবর্তন করিয়া যান। ইনি পরমাণুবাদ তত্ত্বের আবিষ্কর্তা বলিয়া প্রসিদ্ধ। আবার কেহ কেহ বলেন যে, পরমাণুবাদ তত্ত্বের আবিষ্কর্তা লিউঁকিগ্লাস।