মনুষ্য –ইহাদের আদিপুরুষ আদম। আদমের সৃষ্টি সম্বন্ধে কথিত হয় যে, আদমকে সৃষ্টির উদ্দেশ্যে আল্লাহ ফেরেশতাদের মতামত জানিতে চাহিলে, “ফেরেশতাদের ন্যায় আদমের বংশধরগণ আল্লাহর অনুগত থাকিবে না” –এই বলিয়া তাহারা আদম সৃষ্টিতে অমত জানায়। তথাপি আল্লাহ আদম সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কিছু মাটি লইবার জন্য এস্রাফিলাদি ফেরেশতাগণকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। তাহারা আদম সৃষ্টির জন্য মাটি চাহিলে, মাটি এই বলিয়া দোহাই দেয় যে, আদম জাতি আল্লাহর অবাধ্য হইবে এবং তাহাদের দ্বারা দোজখ পূর্ণ করা হইবে। সুতরাং মাটি আদমের দেহের উপকরণ হইয়া দোজখের শাস্তি ভোগ করিতে রাজি নহে। ইহা শুনিয়া একে একে তিন ফেরেশতা খালি হাতে ফিরিয়া যায় এবং শেষে আজরাইল ফেরেশতা পৃথিবীতে আসিয়া মাটির দোহাই অগ্রাহ্য করিয়া জোরপূর্বক কিছু মাটি লইয়া যায়। আজরাইল ফেরেশতার প্রভুর আদেশ পালন, কর্তব্যনিষ্ঠা, অনমনীয় মনোবল ইত্যাদি গুণের জন্য আল্লাহ তাহাকে মানুষের জীবন হরণ (জান কবজ) করিবার কাজে নিয়োগ করেন। অতঃপর বিশ্বসৃষ্টির ষষ্ঠ দিনের বিকাল বেলা বৈকালিক উপাসনার পর পবিত্র মক্কার মাটি দ্বারা আল্লাহ আদমের শরীর তৈয়ার ও তাহাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন।
অতঃপর আদমের দেহস্থ খানিকটা অংশ লইয়া হাওয়া নাম্নী একটি নারী তৈয়ার করিয়া উভয়কে থাকিবার জন্য আল্লাহ বেহেশতে স্থান দান করেন। বেহেশতে থাকাকালীন আল্লাহর হুকুম অমান্য করিয়া গন্ধম নামক ফল ভক্ষণের অপরাধে আদম সপরিবারে নির্বাসিত হন পৃথিবীতে। সন্ধীপ নামক স্থানে আদম পতিত হন ও বিবি হাওয়া নিপতিত হন জেদ্দায় এবং বহু বৎসর পরে তাঁহাদের পুনর্মিলন হয় আরাফাত-এ। সেখানে থাকিয়া তাহাদের সন্তান-সন্ততি জন্মিয়াছে ১২০টি এবং তাহাদেরই বংশাবলীতে পৃথিবী মানুষে ভরপুর। আদমের বংশজাত বলিয়া মানুষকে বলা হয় ‘আদমী’ (হিন্দুগণ বলিয়া থাকেন যে, মনুর বংশজাত বলিয়া উহারা মানব’)।
উপরোক্ত ঘটনাবলীর স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ বলা হয় যে, বিবি হাওয়া গন্ধম ফল ছিড়িলে, উহাতে সেই গাছটি ব্যথা পাইয়াছিল ও ছিন্ন বোটা দিয়া কষ ঝরিতেছিল। তাই গন্ধম বৃক্ষ বিবি হাওয়াকে এই বলিয়া অভিশপ্ত করে যে, তাহার দেহ হইতেও প্রতি মাসে একবার কিছু একটা ক্ষরণ হইবে এবং সে সন্তান প্রসবান্তে ব্যথায় কষ্ট পাইবে। বর্তমান মানবীদের ‘মাসিক ঋতু এবং প্রসবান্তে ‘হ্যাতাল ব্যথা’ –উভয়ই নাকি গন্ধম বৃক্ষের অভিশাপের ফল। আরও বলা হয় যে, আদমের বাম পঞ্জরাস্থির দ্বারা বিবি হাওয়াকে নির্মাণ করা হইয়াছিল, সেই জন্য নাকি পুরুষ মানুষের বাম পঞ্জরে একখানা অস্থি কম।
শয়তান— শয়তান পূর্বে ছিল মকরম নামক বেহেসী একজন প্রথম শ্রেণীর ফেরেশতা। মকরম সেখানে খোদাতালার আদেশমতো আদমকে সেজদা না করায় ‘শয়তান’ আখ্যা পাইয়া চিরকাল আদম-বংশকে অসৎকাজে প্ররোচনা দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করিয়া পৃথিবীতে আসে। এবং সে অদ্যাবধি মানুষকে অসৎকাজে প্ররোচনা (দাগা) দিয়া বেড়াইতেছে।
কেহ কেহ বলেন যে, শয়তান উভলিঙ্গ জীব। উহার এক উরুতে পুংলিগ এবং অপর উরুতে স্ত্রীলিগ। উরুদ্বয়ের সম্মিলনেই শয়তানের গর্ভসঞ্চার হয় এবং প্রতি গর্ভে সন্তান জন্মে দশটি করিয়া। উহাদের নাম হয় যথাক্রমে –জলিতন, ওয়াসিন, নফস, আওয়াম, আফাফ, মকার, মসুদ, দাহেম, ওলহান ও বার। ইহারা ক্ষেত্রবিশেষে থাকিয়া প্রত্যেকে বিশেষ বিশেষ দাগাকার্য সম্পন্ন করিয়া থাকে। বিশেষত উহাদের মানুষের মতো মরণ নাই। যেদিন মানব জাতি লয় পাইবে (কেয়ামতের দিন), সেই দিন শয়তানদের মৃত্যু ঘটিবে।
পবিত্র কোরানের প্রসিদ্ধ অনুবাদক ডক্টর সেল অনুসন্ধান করিয়া বলিয়া গিয়াছেন, “স্বর্গদূত সংক্রান্ত অভিব্যক্তিতে মোহাম্মদ (সা.) ইহুদিদিগের মতেরই অনুসরণ করিয়াছেন বলিয়া মনে হয়। এদিকে ইহুদিগণ আবার পারসিকদিগের পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়াছিলেন।” জ্বীন সম্বন্ধে তিনি বলেন, “ইহুদিদিগের মধ্যে শেদিম (Shedim) নামক এক শ্রেণীর দৈত্যের পরিচয় পাওয়া যায়; জ্বীনগণ উহাদেরই রূপান্তর।”
০৩. দার্শনিক মতে সৃষ্টিতত্ত্ব
দার্শনিক মতে সৃষ্টিতত্ত্ব
সভ্যতার উষাকাল হইতেই মানুষ ভাবিত, এই অসংখ্য বৃক্ষ-লতা ও জীবসমাকুল পৃথিবী সৃষ্টি করিল কে? চন্দ্র-সূর্য, আকাশ ও নক্ষত্র সৃষ্টি করিল কে? নিত্য নূতন সৃষ্টি ও পুরাতনকে রক্ষা করে কে?
প্রশ্ন যেমন হইল, তেমন সমাধানও হইল। মানুষের চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী এক জীব সৃষ্টি করিয়াছেন –মানুষ, পশু, পাখি, মাটি-পাথর, আকাশ, বাতাস সবই। উহা রক্ষা ও প্রতিপালন তিনিই করিয়া থাকেন। কেহ বলিল, সৃষ্টিকর্তা এক; আবার কেহ বলিল, অনেক। যাক সেই কথা। তাহার বা তাহাদের নাম রাখা হইল ‘ঈশ্বর’ বা ‘দেবতা।
গেল বেশ কিছুদিন। মানুষের সন্ধানী মন আবার জানিতে চাহিল, ওইসব সৃষ্ট হইল কি দিয়া? আকাশ, বাতাস, মাটি, পানি, রকমারি জীবসমাকুল পৃথিবীর উপাদান কি?
জগত সৃষ্টি কে করিয়াছেন, এই প্রশ্নের সমাধান যত সহজে হইয়া গেল, কি দিয়া সৃষ্ট হইয়াছে, এই প্রশ্নের সমাধান. তত সহজে হইল না। ‘কে’ ও ‘কি দিয়া’, এই উভয় প্রশ্নের সমাধানের চেষ্টা করিয়াছে ‘দর্শন’। কিন্তু সকল দার্শনিক একমত হইতে পারেন নাই। ইহাতে বহু দার্শনিক বহু মতবাদ প্রচার করিয়াছেন এবং বহু দার্শনিক সম্প্রদায়ের উদ্ভব হইয়াছে। কেননা কোনো দার্শনিকই ধর্মজগতের আবহাওয়ার আওতার বাহিরের মানুষ ছিলেন না। তথাপি দার্শনিকগণ সাধারণত দুই শ্রেণীর –ধর্মীয় আওতাভুক্ত ও মুক্ত। এইখানে সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধে পাশ্চাত্য দেশের কয়েকজন দার্শনিকের মতবাদের আলোচনা করিতেছি।