তারা আর তাকে দেবতা বলে না, দেবতাদের তারা প্ৰচণ্ড বিরোধী। তবে তার নাম অভিন্ন নয়, বিভিন্ন। তাঁকে আর দেবতা বলা হয় না, বলা হয়। স্রষ্টা বা বিধাতা। কিন্তু যে-ধর্মগুলো বিশ্বাস করে একদেবতা বা একবিধাতায়, তারা কি নির্দিষ্ট অভিন্ন একটি বিধাতায়ই বিশ্বাস করে? না; তাদের বিশ্বাস অভিন্ন নয়, বিভিন্ন ধর্ম বিশ্বাস করে বিভিন্ন বিধাতায়; ইহুদি বা খ্রিস্টান বা মুসলমানের বা হিন্দুর বা অন্য কোনো ধর্মের বিধাতা অভিন্ন সত্তা নন; তাদের প্রত্যেকের বিধাতার সত্তা ও গুণাবলি বিভিন্ন। ইহুদি যে-বিধাতার আরাধনা করে সিনেগাগে, মুসলমান তার উপাসনা করে না; খ্রিস্টান যার উপাসনা করে, হিন্দু তাঁর পুজো করে না। তাদের প্রত্যেকের বিধাতা ভিন্ন। তাই দেখতে পাই পৃথিবীর ধর্মগুলো একটি-একটি ক’রে বিশ্বাস করছে বেশ কয়েকটি বিধাতায়; আর ওই বিধাতারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। বহুদেবতাবাদ চ’লে গেলেও আজো পৃথিবীকে শাসন করছেন। কয়েকটি বিধাতা, যাদের মধ্যে মিল থাকলেও বিশ্বাসীরা ওই মিলগুলো মানতে অস্বীকার করে। বিশ্বাসীরা কিছুতেই মানবে না যে তাদের বিধাতার ধারণাটি এসেছে অন্য একটি ধর্মের বিধাতার ধারণা থেকে; বরং তারা মনে করে তাদের বিধাতাই একমাত্র বিধাতা, অন্য বিধাতারা মিথ্যে। কিন্তু বিশ্বাসের যে-পরিস্থিতি তাতে দেখা যায় পৃথিবীর মানুষেরা বিশ্বাস করে বেশ কয়েকটি বিধাতায়।
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত যাদের বলেছেন আরণ্যিক নির্বোধ, তারা অজস্র দেবতা উদ্ভাবনা করেছিলো; এবং যুগে যুগে নিজেদের রুচি আর স্বাৰ্থ অনুসারে স্বৰ্গচ্যুত করেছিলো অজস্র দেবতাকে। কোনো দেবতাই অবিনশ্বর নয়; দেবতারা জন্ম নিয়েছে। আর রাজত্ব করেছে তাদের ভক্ত বা উদ্ভাবকদের পরিকল্পনা অনুসারে। মানুষের দেবতা চিন্তায় দুটি প্রবণতা চোখে পড়ে। একটি হচ্ছে : প্রথম তারা কল্পনা করেছিলো দেবী; বোঝা যায় তখন সমাজে প্রধান ছিলো নারীরা; তাই তারা উদ্ভাবন করেছিলো নিজেদেরই লিঙ্গের দেবতা, অর্থাৎ দেবী। পরে যখন প্রধান হয়ে ওঠে। পুরুষ, বন্দী ক’রে ফেলে নারীদের, তখন দেবীদের হটিয়ে তারা উদ্ভাবন করে পুরুষ দেবতা। সমাজে পুরুষতন্ত্রের উত্থানের সাথে আকাশেও উত্থান ঘটে পুরুষতন্ত্রের। দেবতা।চিন্তায় দ্বিতীয় প্রবণতাটি হচ্ছে বহুদেবতার বদলে একদেবতা উদ্ভাবন। একদেবতা বা বিধাতা কি উৎকৃষ্ট বহুদেবতার থেকে? এদের কোনোটি উৎকৃষ্ট নয় অন্যটির থেকে; দুটিই সমান আদিম অপকল্পনার ফল। তবে বহুদেবতা বাদ দিয়ে একদেবতা বা বিধাতা কল্পনা নির্দেশ করে মানুষের প্রকৃতির একটি ভয়ঙ্কর প্রবণতা; মানুষ এতে বহুবচনতা থেকে এগোয় একবচনতার দিকে, তার চিন্তা হয়ে ওঠে। স্বৈরাচারপরায়ণ। একদেবতাবাদ বা বিধাতাবাদ নিয়ন্ত্রণাপরায়ণ, তা মানুষকে দিতে চায় না কোনো স্বাধীনতা; ব্যক্তির জীবনের প্রতিটি তুচ্ছ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে। ব্যক্তির সঙ্গমও স্বাধীন থাকে না, প্রার্থনায়ও স্বাধীনতা থাকে না। বহুদেবতা এতোটা নিয়ন্ত্রণ করে না। ইহুদিরাই প্রথম কল্পনা করেছিলো প্ৰচণ্ড স্বৈরাচারী প্রতিহিংসাপরায়ণ একদেবতা, আর তাদের প্রভাব রয়েছে যে-সব বিধাতাকল্পনায়, তাতে দয়াময়তা নয়, নির্মমতাই বিধাতার প্রধান গুণ। মানুষ কেনো বেশ গণতান্ত্রিক বহুদেবতা ছেড়ে গ্রহণ করলো স্বৈরতান্ত্রিক একদেবতাবাদ বা বিধাতাবাদ? বহুদেবতাবাদ কল্পিত হয়েছিলো মুক্ত সমাজে, যেখানে নিয়ন্ত্রণ প্রধান আনন্দ হয়ে ওঠে নি। সমাজপতিদের, যেখানে মানুষ যাপন করতো তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীন জীবন; আর একদেবতাবাদ বা বিধাতাবাদ কল্পিত হয় স্বৈরাচারপরায়ণ পুরুষপ্রধান পিতৃতান্ত্রিক সমাজে, যেখানে কোনো কিছুই পিতা বা পুরুষের কঠোর মুঠোর বাইরে নয়, তাই কোনো কিছুই বিধাতার নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। পিতৃতন্ত্রের সবচেয়ে শক্তিমান স্বৈরাচারী পিতা বিধাতা।
বিধাতা কেনো হবেন প্রচণ্ড, হিংস্র, ক্রুদ্ধ, প্রতিহিংসাপরায়ণ; কেনো তিনি উত্তেজিত থাকবেন তাঁর সৃষ্টিতে শাস্তি দেয়ার জন্যে? তিনি কেনো উদ্ভাবন করবেন নরকের পর স্তরে স্তরে নরক, এবং তাতে দগ্ধ করবেন তাঁর সৃষ্টিকে? তিনি কেনো হবেন। এতো পীড়নকামী? শান্তি দেয়াই কি তার চরম সুখ? মনোবিজ্ঞান কীভাবে করবে তার মনোবিশ্লেষণ? তাকে কি বিবেচনা করা হবে সুস্থ স্বাভাবিক? মানুষের নির্মমতার কয়েকটি উদাহরণ হচ্ছে কালিগুলা, হিটলার, স্তালিন, ইয়াহিয়া; তিনি কি তাদেরই চূড়ান্ত মহাজাগতিক আদিরূপ? আমরা কি সুখ পাই প্রিয়দের শাস্তি দিয়ে? আমরা কি সারাক্ষণ ব্যগ্র পুত্রকন্যাদের, প্রিয় বেড়াল বা কুকুরটিকে, শাস্তি দেয়ার জন্যে? সারাক্ষণ হিশেবে নিই। তাদের ক্রিয়াকলাপের? আজ থেকে তিন দশক আগের পিতারা সন্তানদের যতোটা শাস্তি দিতো, এখনকার পিতারা তাতোটা দেয় না; দিলে প্রতিবেশীরা তা মেনে নেয় না। বিধাতাকে যারা হিংস্র প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ প্রতিহিংসাপরায়ণ সত্তারূপে কল্পনা করেছে তাদের মানসিক জগত ভরে রাজত্ব করছিলো কোন দুঃস্বপ্ন? হিংস্রতা প্ৰচণ্ডতা প্রতিহিংসাপরায়ণতাই কি দরকার ছিলো তাদের? ইহুদিরা হিংস্ৰ বিধাতার দরকার বোধ করেছিলো প্ৰথম। তাদের দরকার ছিলো চোখের বদলে চোখ, দাতের বদলে দাত; তাদের বিধাতা মিটিয়েছে তাদের অভিলাষ। আদি বাইবেল-এ বলা হয়েছে যে পরাজিত জাতিদের নির্মূল করতে হবে, মেষ আর গাভীও রক্ষা পাবে না। বিধাতাকে হিংস্ররূপে কল্পনা করেছে যে-সমাজ বা যে-প্রবর্তক, তার কাছে হিংস্রতাই মানুষকে দমন করার উপায় ব’লে মনে হয়েছে। আমরা ওই সমাজ ও প্রবর্তকদের মনোবিশ্লেষণ করতে পারি। রাসেল অপ্রিয় প্ৰবন্ধাবলিতে বলেছেন :