ধ্বংস অনিবাৰ্য, তবে এখনো সুদূর। মহাজগতকে যদি ঠিকভাবে বুঝি আমরা, আর বুঝি মহাসমুদ্রের এক কোণে আমাদের ছোট্ট চরটিকে, তাহলে আকাশের দিকে তাকিয়ে অন্ধকারে দেবদেবী আর বিধাতার ভয়ে কেঁপে উঠবো না। আমরা। এখন ভয় পাই, কারণ অন্ধকারে ভয় না পেয়ে উপায় নেই। মানুষের স্বভাব হওয়া উচিত অবিশ্বাস, অবিশ্বাস হচ্ছে আলো; আর বিশ্বাস মানুষকে পরিণত করে জড়বস্তুতে। তবে বিশ্বাস শুরু থেকেই রাজনীতি; সমাজপ্রভুরা বিশ্বাসকে ব্যবহার করে তাদের প্রধান কৌশল ও অস্ত্ররূপে। মহাজগতের উৎপত্তির জন্যে দরকার পড়ে না কোনো বিধাতার, ধ্বংসের জন্যেও পড়ে না; তবে সমাজরাষ্ট্রের ওপর প্রভুত্ব করার জন্যে দরকার পড়ে বিধাতার। তবে বিধাতা স’রে যাবেন, রাজনীতিবিদেরা তাকে বেশি দিন আয়ত্তে রাখতে পারবেন না ।
ধর্ম
আদিম মানুষদের অন্ধ আদিম কল্পনা, আর পরবর্তী অনেকের সুপরিকল্পিত মিথ্যাচার, কখনো কখনো মত্ততা, নানাভাবে বিধিবদ্ধ হয়ে নিয়েছে যে-বিচিত্র রূপ, তাই পরিচিত ধর্ম নামে। বাৰ্ট্যান্ড রাসেল, আমি কেনো খ্রিস্টান নাই বইটিতে, বলেছেন, ‘সব ধর্মই ক্ষতিকর ও অসত্য।’ কোনো অলৌকিক জগত থেকে কেউ ধর্ম পাঠায় নি, যদিও এটা বিশ্বাস করার নির্দেশ দিয়ে ভয় দেখানো হয়; কোনো অলৌকিক জগত নেই, মানুষ নিয়ে কোনো অলৌকিক সত্তার কোনো উদ্বেগ নেই। মহাবিশ্বে মানুষ খুবই ক্ষুদ্র। ধর্ম অলৌকিক নয়—বিধাতার বা দেবদেবীদের প্রণীত নয়; ধর্ম লৌকিক- মানুষের প্রণীত, এবং বেশ সন্ত্রাসবাদী, ব্যাপার। মানুষ উদ্ভাবনশীল; মানুষের অজস্র উদ্ভাবনের একটি, ও সম্ভবত নিকৃষ্টটি, ধর্ম। ধর্মকে শাশ্বত সর্বজনীন মনে করার একটা চাপ রয়েছে; তবে ধর্ম শাশ্বত নয়, সর্বজনীনও নয়। কোনো ধর্ম নেই, যা মানুষের শুরু থেকে চ’লে এসেছে, ও চিরকাল চলবে: কোনো ধর্ম নেই, যাতে বিশ্বাস করে সবাই। অনেক সত্য আছে, যা সবাই শুধু বিশ্বাস নয়, স্বীকার করে; কিন্তু বিশেষ একটি ধর্ম ও তার বিধাতায় বিশ্বাস করে শুধু ওই ধর্মের মানুষ। অন্য ধর্মের মানুষের কাছে তা হাস্যকর ও, অনেক সময়, ঘৃণার বিষয়। চারপাশে ধর্ম দেখে মনে হ’তে পারে যে মানুষ ধর্ম ছাড়া বাঁচতে পারে না; সত্য হচ্ছে ধর্মের মধ্যে মানুষ বেশিক্ষণ বাঁচতে পারে না। মানুষ মৰ্মমূলে ধর্মবিরোধী, মানুষের পক্ষে বেশি ধর্ম সহ্য করা অসম্ভব;—ধাৰ্মিকেরাও যতোটা ধাৰ্মিক তার থেকে অনেক বেশি অধাৰ্মিক। মানুষের সৌভাগ্য মানুষ বেশি ধর্ম সহ্য করতে পারে না, তাই বিকাশ ঘটেছে মানুষের। বেশি ধর্মে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে, ধাৰ্মিক মানুষ অসুস্থ মানুষ। মানুষ যদি আপাদমস্তক-চব্বিশ ঘণ্টা, তিরিশ দিন, বারোমাস—ধাৰ্মিক প্রাণী হতো, আজো তাহলে থাকতো আদিম অবস্থায়। মানুষের মনের আদিম অংশটুকু ধর্ম। ধাৰ্মিক মানুষকে প্রশংসা করার একটা রীতি প্রচলিত রয়েছে; বলা হয় যে প্রকৃত ধাৰ্মিক মানুষ খুব ভালো মানুষ; কিন্তু সত্য তার উল্টো,-প্রকৃত ধাৰ্মিক মানুষ প্রকৃত খারাপ মানুষ। সে অবিকশিত, এবং মানুষের বিকাশের বিরোধী। হিন্দু, ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমান যদি সবাই হতো প্রকৃত হিন্দু, ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমান, তবে তারা আজো বাস করতে পাঁচ থেকে দেড় হাজারর বছর আগের সমাজে। ধর্ম মানুষকে এগিয়ে দেয় নি, ধর্ম থাকা সত্ত্বেও মানুষ এগিয়েছে; কেননা মানুষ কখনোই পুরোপুরি ধাৰ্মিক নয়। মানুষ কখনো ধর্মের বিধান পুরোপুরি মানে নি। ধর্মের কোনো উপকারিতা দেখা যায় নি, কিন্তু অজস্র অপকারিতা সব সময়ই দেখা যায়।
প্রত্যেক ধর্মের রয়েছে দুটি দিক:-ধর্মগুলো নিজেদের দায়িত্ব হিশেবে ব্যাখ্যা করে বিশ্বসৃষ্টির রীতি, এবং তৈরি করে সামাজিক বিধান। ধর্মের বইগুলো বিজ্ঞানের বই নয়, ওগুলো খুবই অবৈজ্ঞানিক। এগুলোতে বিশ্বসৃষ্টির যে-বৰ্ণনা পাওয়া যায়, তা পুরোপুরি ভুল; ওই বর্ণনা বইগুলো রচনাকালের মানুষের বিভ্রান্ত কল্পনামাত্র। বিশেষ এক ধরনের সমাজ প্রতিষ্ঠাই ধর্মপ্রবর্তকদের লক্ষ্য, তাই ধর্ম মূলত আদিম রাজনীতি। মৃত্যুর পর মানুষের পরিণতি বর্ণনা ধর্মের এক প্রিয় বিষয়; এ-এলাকায় ধর্মগুলো মানুষকে লোভের পর লোভ আর ভয়ের পর ভয় দেখায়। মৃত্যুর পর মানুষের পরিণতি সম্পর্কে ধর্মগুলো যা বলে, তা হাস্যকর, যাতে বিশ্বাস করতে পারে শুধু লোভী ও ভীত মানুষ। মানুষ সম্পর্কে খুবই নিম্ন ধারণা পোষণ করে ধর্মগুলো। ধর্মগুলো ধ’রে নিয়েছে যে মানুষ লোভী ও ভীত; তাই তাদের লোভ দেখাতে হবে, এবং রাখতে হবে সন্ত্রস্ত ক’রে। ধর্মগ্রন্থ পড়ার সময় ধাৰ্মিক মানুষ বারবার লোভে পড়ে, আর ভয়ে কেঁপে ওঠে; তাই ধাৰ্মিক মানুষের পক্ষে সুস্থ থাকা সম্ভব নয়, লোভ ও ভয়ের মধ্যে বাস ক’রে তারা হয়ে পড়ে বিকলনগ্ৰস্ত। ধাৰ্মিকেরা খুবই অমানবিক, তারা নিজেদের ধর্ম ও ধর্মের বই ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম ও ধর্মের বইকে মর্যাদা দেয় না। এক ধর্মের ধাৰ্মিক অন্য ধর্মের পবিত্রগ্রন্থ ও গৃহকে অবলীলায় অপমানিত করতে পারে, যা নাস্তিকেরা কখনো করে না। যে-কোনো নির্বোধের পক্ষে ধাৰ্মিক হওয়া সহজ, কিন্তু শুধু জ্ঞানী ও মানবিক ব্যক্তিই হ’তে পারে নাস্তিক। নাস্তিক হত্যা আর ধ্বংস করে না; কিন্তু ধাৰ্মিক সব সময় হত্যা ও ধ্বংসের জন্যে ব্যগ্র থাকে; তারা ইতিহাসের পাতাকে যুগে যুগে রক্তাক্ত করেছে। প্রত্যেক ধর্মে রয়েছে অসংখ্য সন্ত, যারা ঠাণ্ডা মস্তিষ্কের হত্যাকারী। নাস্তিক চায় মানুষের চেতনাকে বদলে দিতে, মানুষকে বিকশিত করতে; আর ধাৰ্মিক চায় মানুষের চেতনাকে নষ্ট করতে, মানুষকে রুদ্ধ করতে। ধার্মিকদের নৈতিকতাবোধ খুবই শোচনীয়।