৮
পরিত্যক্ত! এ-শব্দ ঘণ্টাধ্বনির মতো আমাকে জাগিয়ে
তোমার নিকট থেকে পৌঁছে দেয় নিজেরই কাছে।
বিদায়! কল্পনাও তার খ্যাতি অনুসারে
প্রতারণা করতে পারে না, প্ৰতারক পরী।
বিদায়! বিদায়! তোমার করুণ গান মিশে যাচ্ছে
পাহাড়ের ঢালে; এবং এখন মিশে গেছে
পার্শ্ববতী উপত্যকার উন্মুক্ত ভূমিতে :
এটা কি কল্পনা ছিলো, না কি ছিলো জাগ্ৰত স্বপ্ন?
পালিয়েছে সে-সঙ্গীত:-আমি কি জেগে আছি না কি নিদ্ৰিত?
মহাসমুদ্রে ছোট্ট চর : আমাদের গ্রাম
বিশ্বাসকে আলো ব’লে শেখানোর একটি রীতি রয়েছে, ছেলেবেলায় আমিও তাই শিখেছিলাম; পরে দেখেছি বিশ্বাস আলো নয়, অন্ধকার; আর বিশ্বাসের অন্ধকারে ঢেকে আছে মহাজগত। যদিও মহাজগতের অধিকাংশ এলাকাই অন্ধকার, মহাজাগতিক অনন্ত দূরত্বব্যাপী কোনো নক্ষত্রের আলো নেই, তবু তার কোনো কোনো এলাকা অসংখ্য নক্ষত্রে আলোকিত। কিন্তু বিশ্বাসের জগতটি পুরোপুরি অন্ধকারাচ্ছন্ন। বিশ্বাসের বইগুলো অন্ধকারের বই, ওগুলোর কাজ মানুষের মনকে গভীর অন্ধকারে আবৃত করা। মহাজগত সম্পর্কে খুবই কম জানি আমরা, আর যতোটুকুও জানি, তাও জানতে দেয়া হয় না। গত তিনশো বছরে পশ্চিমে বিজ্ঞান বেশ এগিয়েছে, বের করেছে মহাজগতের অনেক শৃঙ্খলা; তবু অধিকাংশ মানুষ আজো আছে আদিম পর্যায়েই—তারা মানসিকভাবে আদিম। যুক্তির থেকে অন্ধতার বেশি অনুরাগী তারা, সত্যের থেকে তাদের বেশি প্রিয় মিথ্যে। এটা অবশ্য সাধারণ মানুষদের অপরাধ নয়, অপরাধটি অসাধারণদের। ওই অসাধারণ মানুষেরা পাচ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধ’রে দখল ক’রে আছে সমাজ ও রাষ্ট্র। নিজেদের স্বার্থে তারা তৈরি করেছে শাসনব্যবস্থা, মানুষকে ভাগ করেছে নানা বর্ণে ও শ্রেণীতে, তৈরি করেছে। ধর্ম ও নানা ধরনের দেবতা ও বিধাতা, এবং দেবতা ও বিধাতাদের দিয়ে ভীত ক’রে রেখেছে মানুষদের। শাসকদের অনুগত মহাপুরুষেরাও, যাদের অমর ব’লে মান্য করি আমরা, সাহিত্য, দর্শন, ও আরো অজস্র শাস্ত্রে প্রচার করেছে শাসকদেরই বক্তব্য। রাজনীতি ও ধর্ম শুরু থেকেই মানুষের বিকাশের বিরুদ্ধে; এবং আজো তাই। প্রধানত রাজনীতি ও ধর্মের সুবিধাভোগীরা মানুষকে বুঝতে দেয় নি আমরা যেখানে আছি সেটি কী, কী সম্পর্ক আমাদের ওই আকাশ আর তারকাপুঞ্জের সাথে। তারা শুনিয়েছে কাল্পনিক গল্প, ওই গল্পগুলোকে তারা বলেছে ধর্ম, মানুষকে বাধ্য করেছে। ওই গল্পগুলো বিশ্বাস করতে ও মেনে চলতে। তাই বিশ্বাসের অন্ধকারে ঢেকে আছে অজস্র সূর্য, সংখ্যাহীন তারকাপুঞ্জ, আর মহাজগত। পবিত্ৰ ব’লে বিখ্যাত বইগুলোতে আলো বা জ্ঞান নেই, আলো আর জ্ঞান আছে সে-বইগুলোতে, বিশ্বাসীদের চোখে যেগুলো অপবিত্ৰ।
অধিকাংশ মানুষ আজো বাস করে মহাজাগতিক অন্ধকারে। আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা ভাবে স্বৰ্গ আর নরকের কথা; কেঁপে ওঠে নরকের ভয়ে, সুখী হয় স্বর্গের বিলাসের কথা ভেবে। এর সবটাই ঘটেছে পৃথিবী ও মহাজগত সম্পর্কে ভুল ধারণার ফলে। আমাদের গ্রামটিকে ভালোবাসি আমরা, তবে তাকে রহস্যপূর্ণ মনে করি না; কেননা আমরা তার সব কিছু জানি। কিন্তু নদীর অপর পারের গ্রামগুলোকে মনে হয় রহস্যময়, মনে হয় ওখানে এমন সুখ আর ছায়া আছে, যা নেই। আমাদের গ্রামে। তা থাকতে পারে; ওই গ্রামে থাকতে পারে অপূর্ব এক তমালতরু, যা নেই আমাদের গ্রামে; থাকতে পারে এমন স্নিগ্ধ সরোবর, যা নেই আমাদের গ্রামে; থাকতে পারে এমন একটি গর্ত, যা নেই আমাদের গ্রামে। কিন্তু ওই গ্রামেও রহস্যের কিছু নেই, ওই গ্রামীবাসীরা নিজেদের গ্রামকে রহস্যপূর্ণ মনে করে না, যদিও নদীর পারে দাড়িয়ে রহস্যপূর্ণ মনে করে আমাদের গ্রামটিকে। মহাজগতকে যদি জানতাম আমরা, তাহলে বিস্মিত হতাম, কেননা বিস্ময়কর বহু কিছু রয়েছে মহাজগত জুড়ে; কিন্তু এখন যেমন ভয়ের চোখে দেখি, নানা রকম বিধাতা দেখতে পাই দূরে, তেমন কিছু দেখতে পেতাম না। ওই তারা বা সূৰ্যই শুধু নয়, আমরাও মহাজগতের অধিবাসী, আমরাও ঘুরে চলছি মহাজাগতিক গগনে: কিন্তু আমরা কোনো দেবতা দেখি নি, বিধাতা দেখি নি, যদিও এদের কথা দিনরাত শুনতে পাই। বিশ্বাসীরা ভীত আর লোভী মানুষ; অন্ধকারে থাকতেই তাদের আনন্দ।
মহাজগত বা মহাবিশ্ব অনন্ত: আমরা তার একধারে পড়ে আছি। মহাজগতকে বোঝার জন্যে একটি রূপকের সাহায্য নিতে পারি; অনন্ত মহাজগত যেনো এক মহাসমুদ্র, আর ওই মহাসমুদ্রে আমাদের পৃথিবী একটি ছোট্ট চারের মতো। দ্বীপ না ব’লে চর বলতেই আমার ভালো লাগছে। অনন্ত মহাসমুদ্রে আমরা একটি ছোটো চরের, ছোটো গ্রামের, অধিবাসী; এই চারের, এই গ্রামের, নাম আমরা রেখেছি পৃথিবী। এটি তারা নয়, গ্রহ; এটি একটি তারাকে ঘিরে ঘুরছে, তারাটির নাম রেখেছি আমরা সূর্য। এই সূর্যকে ঘিরে যে-এলাকাটুকু, যেখানে ঘুরছে কয়েকটি গ্রহ, তার নাম সৌরজগত। এটি বিশাল এলাকা, কিন্তু মহাজগতের এটি এক ক্ষুদ্র এলাকা। মহাজগত সম্পর্কে আমরা অনেক বেশি জানি পূর্বপুরুষদের থেকে। তাঁরা আকাশ ভরে দেখেছিলেন লাখ লাখ দেবতা, মাঠে ঘাটে নদীতে দিঘিতে দেখেছিলেন দেবদেবী; দেখেছিলেন প্ৰচণ্ড শক্তিশালী বিধাতা, যার ভয়ে রক্ত জ’মে যেতো তাদের, আজো রক্ত জমে যায় অধিকাংশের। এই ভয় এবং বেশখানিক লোভকে বলা হয় ধর্ম। আমাদের পূর্বপুরুষেরা ছোট্ট চারের মতো পৃথিবীটিকেই বুঝে ওঠেন নি; জানেন নি। পৃথিবী কতো বড়ো, তার উত্তরে কী দক্ষিণে কী, কীভাবে আছে পৃথিবী; তাই মহাজগত সম্পর্কে তাদের পক্ষে ধারণা করাই ছিলো অসম্ভব। কিন্তু কল্পনা মানুষের সমান বয়সী। তারাও প্রচুর কল্পনা করেছিলেন যেমন আমরা করি, তাদের অনেক কল্পনা গল্প হিশেবে বেশ চমৎকার; তবে তা গল্পই। তাদের মধ্যে কল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ রীতির বিকাশ ঘটে নি, যাকে বলা হয়।