পালবংশের পতনের পর বাঙলায় সেনবংশ রাজত্ব করে। এরাও প্রতাবশালী রাজা ছিলেন। সেনবংশের তৃতীয় রাজা লক্ষ্মণ সেনের আমলেই বাঙলা মুসলমানদের হাতে চলে যায়। এ ঘটনা ঘটেছিল ত্রয়োদশ শতাব্দীর (১২০৪ খ্রীষ্টাব্দে) শুরুতেই। তখন থেকেই ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম পাদ পর্যন্ত বাঙলাদেশ স্বাধীন সুলতানদের শাসনাধীনে ছিল। পরের পঞ্চাশ (১৫৩৯-১৫৭৬ খ্রীষ্টাব্দ) বছর বাঙলা পাঠানদের অধীনে যায়। তারপর ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে সম্রাট আকবরের (১৫৯৪ খ্রীষ্টাব্দে) আমলে বাঙলা মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর অপরাহ্নে বাঙলা মোগলদের হাত থেকে ইংরেজদের হাতে চলে যায়।
।।পাঁচ।।
বাঙলার ধর্মীয় সাধনার ও লৌকিক জীবনের আচার-ব্যবহারের একটা চিত্র পাঠক পাবেন ‘পশ্চিম বাঙলার লৌকিক জীবন’ ও ‘ধর্মীয় চেতনার যাদুঘর’ নিবন্ধদ্বয়ে। এখান কেবল বাঙলার সমাজবিন্যাস ও প্রথাসমূহের একটা রূপরেখা টানবার চেষ্টা করব। আগেই বলেছি যে, বাঙলায় ব্রাহ্মণ্যধর্ম খুব বিলম্বে প্রবেশ করেছিল। সুতরাং ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুপ্রবেশের পূর্বে বাঙলায় চাতুর্বর্ণ সমাজবিন্যাস ছিল না। প্রথম ছিল কৌমগোষ্ঠিক সমাজ। তারপর যে-সমাজের উদ্ভব হয়েছিল, তাতে জাতিভেদ ছিল না, ছিল পদাধিকারঘটিত বৃত্তিভেদ। এটা আমরা জানতে পারি ‘প্রথম কায়স্থ’, ‘জ্যেষ্ঠ কায়স্থ’, ‘প্রতিবেশী’, ‘কুটুম্ব’ প্রভৃতি নাম থেকে। এ সব নাম আমরা পাই সমকালীন তাম্রপট্ট লিপি থেকে। তারপর পাই বৃত্তিধারী গোষ্ঠীর নাম, যথা ‘নগরশ্রেষ্ঠী’, ‘সার্থবাহ’, ‘ক্ষেত্রকার’, ‘ব্যাপারী’ ইত্যাদি। পরে পালযুগে যখন রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধধর্মের প্রাধান্য ঘটে, তখন বাঙলায় বৃত্তিধারী গোষ্ঠীগুলি আর বৈবাহিক আদান-প্রদানের সংস্থা হিসাবে স্বীকৃত হয় না। তখনই বাঙলার জাতিসমূহ সঙ্করত্ব প্রাপ্ত হয়। সুতরাং পালরাজগণের পর সেনরাজগণের আমলে যখন ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটে তখন বাঙলার সকল জাতিই সঙ্করত্ব দোষে দুষ্ট। সেজন্য বৃহদ্ধর্মপুরাণ-এ ব্রাহ্মণ ছাড়া, বাঙলার আর সকল জাতিকেই সঙ্কর জাতি বলে অভিহিত করা হয়েছিল ও তাদের তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছিল—১) উত্তম সঙ্কর, ২) মধ্যম সঙ্কর ও ৩) অন্ত্যজ। এরপর আর একটা শ্রেণীবিভাগ করা হয়েছিল—‘নবশাখ’ বিভাগ। নবশাখ মানে যাদের হাতে ব্রাহ্মণরা জল গ্রহণ করত। বিবাহের অন্তর্গোষ্ঠী (endogamous) হিসাবে মধ্যযগে যে সকল জাতি বিদ্যমান ছিল, তাদের নাম আমরা মঙ্গলকাব্যসমূহে পাই। এ সকল জাত আজও বিদ্যমান আছে। ময়ূরভট্টের ‘ধর্মপুরাণ’-এ যে তালিকা দেওয়া হয়েছে, তা নীচে উদ্ধৃত করা হয় :
“সদ্গোপ কৈবর্ত আর গোয়ালা তাম্বুলি।
উগ্রক্ষেত্রী কুম্ভকার একাদশ তিলি।।
যোগী ও আশ্বিন তাঁতি মালী মালাকর।
নাপিত রজক দুলে আর শঙ্খধর।।
হাড়ি মুচি ডোম কলু চণ্ডাল প্রভৃতি।
মাজি ও বাগদী মেটে নাহি ভেদজাতি।।
স্বর্ণকার সুবর্ণবনিক্ কর্মকার।
সূত্রধর গন্ধবেনে ধীবর পোদ্দার।।
ক্ষত্রিয় বারুই বৈদ্য পোদ পাকমারা।
পরিল তাম্রের বালা কায়স্থ কেওরা।।”
(বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদ সংস্করণ, পৃ. ৮২)
মধ্যযুগের সমাজ জীবনকে কলুষিত করেছিল তিনটি অপপ্রথা—১) কৌলিন্য, ২) সহমরণ ও ৩) দাসদাসীর হাট। এ সবের বিশদ বিবরণ আমি দিয়েছি আমার “বাঙলার সামাজিক ইতিহাস”-এ। সুতরাং এখানে আর তার পুনরাবৃত্তি করলাম না। ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এ সকল প্রথা বাঙালীসমাজে প্রচলিত ছিল। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ সমাজ-সংস্কারকের প্রচেষ্টার ফলে ইংরেজ সরকার কর্তৃক এগুলি নিবারিত হয়। তারপর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের চেষ্টায় বিধবা-বিবাহ আইনসিদ্ধ হয়। পরে অসবর্ণ বিবাহের জন্য বিশেষ আইন প্রণয়ন হয়। আরও পরে বিবাহের ন্যূনতম বয়সও বর্ধিত করা হয়।