।।তিন।।
বাঙলার আদিম অধিবাসীরা ছিল অস্ট্রিক ভাষাভাষী গোষ্ঠীর লোক। নৃতত্ত্বের ভাষায় এদের প্রাক্-দ্রাবিড় বা আদিঅস্ত্রাল বলা হয়। প্রাচীন সাহিত্যে এদের ‘নিষাদ’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বাঙলার আদিবাসীদের মধ্যে সাঁওতাল, লোধা প্রভৃতি উপজাতিসমূহ এই গোষ্ঠীর লোক। এছাড়া, হিন্দুসমাজের তথাকথিত ‘অন্ত্যজ’ জাতি সমূহও এই গোষ্ঠীরই বংশধর। বাঙলার প্রথম অনুপ্রবেশ করে দ্রাবিড়রা। এরা দ্রাবিড় ভাষার লোক ছিল। বৈদিক সাহিত্যে এদের ‘দস্যু’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এদের অনুসরণে আসে আর্যভাষাভাষী আল্পীয়রা। মনে হয়, এদের একদল এশিয়া মাইনর বা বেলুচিস্তান থেকে পশ্চিম সাগরের উপকূল ধরে অগ্রসর হয়ে, ক্রমশঃ সিন্ধু, কাথিয়াবাড়, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, কুর্গ, কন্নাদ ও তামিলনাড়ু প্রদেশে পৌঁছায় এবং আর একদল পূর্ব উপকূল ধরে বাঙলা ও ওড়িষায় আসে। এরাই মনে হয়, বৈদিক ও বেদোত্তর সাহিত্যে বর্ণিত ‘অসুর’ জাতি। আরও মনে হয়, এদের সকলেই সামাজিক সংগঠন কৌমভিত্তিক ছিল, এবং এই সকল কৌমগোষ্ঠীর নামেই এক একটা জনপদের সৃষ্টি হয়।
বৈদিক আর্যরা বাঙলাদেশের অন্ততঃ দুটি কৌমগোষ্ঠীর নামের সঙ্গে পরিচিত ছিল। একটি হচ্ছে ‘বঙ্গ,’ যাদের ঐতরেয় ব্রাহ্মণে ‘বয়াংসি’ বা পক্ষী জাতীয় বলা হয়েছে। মনে হয় পক্ষী বিশেষ তাদের ‘টটেম’ ছিল। বৈদিক সাহিত্যে দ্বিতীয় যে নামটি আমরা পাই, সেটি হচ্ছে ‘পুণ্ড্র’। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে তাদের ‘দস্যু’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। মনে হয়, তাদের বংশধররা হচ্ছে বর্তমান ‘পোদ’ জাতি। বৈদিক আর্যরা বাঙলাদেশের লোকদের বিদ্বেষপূর্ণ ঘৃণার চক্ষে দেখতেন। এটার কারণ—দুই বিপরীত সংস্কৃতির সংঘাত। বাঙলায় আর্যদের অনুপ্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত, তাদের মনে এই বিদ্বেষ ছিল। (‘বাঙলার লৌকিক জীবন’ নিবন্ধ দেখুন)।
।।চার।।
মহাভারতীয় যুগে আমরা বঙ্গ, কর্বট, সুহ্ম, প্রভৃতি জনপদের নাম পাই। মহাভারতে আরও বলা হয়েছে যে অসুররাজা বলির ক্ষেত্রজ সন্তানসমূহ থেকেই অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পৌন্ড্র, ও সুহ্ম জাতিসমূহের উদ্ভূত হয়েছে।
বৌদ্ধ জাতক গ্রন্থ সমূহ থেকে আমরা বাঙলার দুটি রাষ্ট্রের নাম পাই। একটি হচ্ছে শিবি রাজ্য ও অপরটি হচ্ছে চেত রাজ্য। এ দুটি রাষ্ট্র বুদ্ধদেবের প্রাদুর্ভাবের পূর্বেই বিদ্যমান ছিল। বর্ধমান জেলার অধিকাংশ অঞ্চল নিয়ে শিবি রাজ্য গঠিত ছিল। তার রাজধানী ছিল জেতুত্তর নগরে (বর্তমান মঙ্গলকোটের নিকটে ও টলেমী উল্লিখিত সিব্রিয়াম বা শিবপুরী)। এরই দক্ষিণে ছিল চেত রাজ্য। তার রাজধানী ছিল চেতনগরীতে (বর্তমান ঘাটাল মহকুমার অন্তর্ভূক্ত চেতুয়া পরগণা)। এই উভয় রাজ্যেরই সীমান্ত কলিঙ্গ রাজ্যের সীমানার সঙ্গে এক ছিল। কলিঙ্গ রাজ্য তখন বর্তমান মেদিনীপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
সিংহল দেশের ‘দীপবংশ’ ও ‘মহাবংশ’ নামে দুটি প্রাচীন গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি যে বঙ্গদেশের বঙ্গ নগরে এক রাজার বিজয়সিংহ নামে এক পুত্র দুর্বিনীত আচারের জন্য সাত শত অনুচর সহ বাঙলাদেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে সিংহলে যায়, এবং সিংহল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।
আলেকজাণ্ডারের (৩২৫ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ) ভারত আক্রমণের সময় বাঙলায় গঙ্গারাঢ় নামে এক স্বাধীন রাজ্য ছিল। গঙ্গারাঢ়দের শৌর্যবীর্যের কথা শুনেই আলেকজাণ্ডার বিপাশা নদীর তীর থেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
এর অনতিকাল পরেই বাঙলা তার স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে। কেননা, মহাস্থানগড়ের এক শিলালিপি থেকে আমরা জানতে পারি যে, উত্তর বাঙলা মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, কারণ মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত পুণ্ড্রবর্ধন নগরে এক কর্মচারীকে অধিষ্ঠিত করেছিল। মনে হয় এই সময় থেকেই আর্যসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বাঙলা দেশে ঘটেছিল। ‘মনুসংহিতা’ রচনাকালে (২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকে ২০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে) বাঙলাদেশ আর্যাবর্তের অন্তর্ভুক্ত বলে পরিগণিত হত। কুষাণ সম্রাটগণের মুদ্রাও বাঙলার নানা জায়গায় পাওয়া গিয়েছে। খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতকে বাঙলাদেশ গুপ্তসাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক হয়। কিন্তু ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাঙলাদেশ আবার স্বাধীনতা লাভ করে। এই সময় গোপচন্দ্র, ধর্মাদিত্য ও সমাচারদের নামে তিনজন স্বাধীনরাজা ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধি গ্রহণ করেন। গোপচন্দ্র ওড়িষারও এক অংশ অধিকার করেন। এর অনতিকাল পরে বাঙলাদেশের রাজা শশাঙ্ক (৬০৬-৬৩৭ খ্রীষ্টাব্দ) পশ্চিমে কান্যকুজ্ব ও দক্ষিণে গঞ্জাম পর্যন্ত বিস্তৃত সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হন। এরপর বাঙলাদেশে কিছুকাল অরাজকতা দেখা দেয়। এই অজারকতার হাত থেকে বাঙলাদেশকে রক্ষা করেন পালবংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল (৭৫০-৭৭০) খ্রীষ্টাব্দ)।
অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাবে গোপালের সময় থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর তৃতীয় পাদে গোবিন্দপালের সময় পর্যন্ত পালবংশই বাঙলার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিল। একই রাজবংশের ক্রমাগত চারশো বছর (৭৫০-১১৯৯ খ্রীষ্টাব্দ) রাজত্ব করা ভারতের ইতিহাসে এক অসাধারণ ঘটনা। গোপালের পৌত্র দেবপাল নিজের রাজ্য বিস্তার করেছিলেন দক্ষিণে সমুদ্র পর্যন্ত। দেবপালের পিতা ধর্মপাল দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে গান্ধার পর্যন্ত সমস্ত উত্তর ভারত জয় করেছিলেন। বস্তুতঃ পালরাজগণের রাজত্বকালই বাঙলার ইতিহাসের গৌরবময় যুগ।