যদিও বেদে এসব কাহিনী নেই, তা হলেও বেদে অজাচারের একাধিক দৃষ্টান্ত আছে। প্ৰথমেই ঊষার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ঋগ্বেদের কুড়িটা সুক্তে ঊষা স্তুত হয়েছেন । তিনি প্ৰজাপতির কন্যা, কাঞ্চনবর্ণা ও সূর্যের ভগিনী। তিনি বক্ষদেশ উন্মুক্ত রাখতেন। ব্ৰহ্মার ন্যায় প্রজাপতিও ছিলেন একজন কামুক দেবতা । কৃষ্ণ যজুৰ্বেদের মৈত্ৰায়নিসংহিতা ( ৪।১।২২) অনুযায়ী প্ৰজাপতি নিজ কন্যা ঊষাতে উপগত হয়েছিলেন । ঊষা মৃগীরূপ ধারণ করেছিল । প্ৰজাপতিও মৃগরূপ ধারণ করে তার সঙ্গে সঙ্গম করেছিল । পিতা প্ৰজাপতি চন্দ্রের সঙ্গে ঊষার বিবাহ দেবেন ঠিক করেছিলেন । কিন্তু তার বিবাহের খবর পেয়ে অগ্নি, সূর্য, ইন্দ্র ও আশ্বিনীদ্বয় সকলেই তার পাণিপ্রার্থী হয়ে হাজির হন । প্ৰজাপতি তখন ঘোষণা করেন যে, তাদের মধ্যে অনন্ত আকাশ পথ অনুধাবনে যিনি সমর্থ হবেন, তারই হাতে তিনি ঊষাকে সমৰ্পণ করবেন। একথা শুনে অগ্নি, ইন্দ্র ও সূর্য আজীবন এই অনুধাবনের জন্য চেষ্টা করেন, কিন্তু তাদের সব চেষ্টা ব্যার্থ হয় । একমাত্র অশ্বিনীদ্বয়ই সমর্থ হন । কিন্তু এরা সূর্যের অনুচর বলে, সূর্যের প্রীতিকামনায় ঊষাকে প্ৰতিগ্রহ করেন না । তার ফলে সূৰ্যই ঊষাকে বরণ করে নেন।
৷৷ দুই ।।
অপর এক কাহিনী হচ্ছে। যম-যমীর কাহিনী। ঋগ্বেদ অনুযায়ী তারা বিবস্বান ও সরন্যুর সন্তান ও যমজ ভ্ৰাতা ও ভগিনী । যমী যমের সঙ্গে সঙ্গম আকাঙ্খা করেন, কিন্তু যম তা প্ৰত্যাখ্যান করেন । ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের দশম সুক্তে এ কাহিনীটা আছে । সেখানে যমী যমকে বলছে —‘বিস্তীর্ণ সমূদ্রমধ্যবর্তী এ দ্বীপে এসে এ নির্জন প্রদেশে তোমার সহবাসের জন্য আমি অভিলাষিনী, কারণ গর্ভাবস্থা অবধি তুমি আমার সহচর । বিধাতা মনে মনে চিন্তা করে রেখেছেন যে তোমার ঔরসে আমার গর্ভে আমাদের পিতার এক সুন্দরনপ্তা (নাতি) জন্মিবে।’ যম তার উত্তরে বলছে–‘তোমার গর্ভসহচর তোমার সাথে এ প্ৰকার সম্পর্ক কামনা করে না। যেহেতু তুমি সহোদর ভগিনী, তুমি অগম্যা ।’ যমী তার উত্তরে বলছে—’যদিচ কেবল মানুষের পক্ষে এ প্রকার সংসৰ্গ নিষিদ্ধ, তথাপি দেবতারা এরূপ সংসর্গ ইচ্ছাপূর্বক করে থাকেন। অতএব আমার যেরূপ ইচ্ছা হচ্ছে, তুমিও তদ্রুপ ইচ্ছা কর । তুমি আমার প্রতি অভিলাষযুক্ত হও, এস একস্থানে উভয়ে শয়ন করি । পত্নী যেমন পতির নিকট তদ্রুপ আমি তোমার নিকট নিজ দেহ সমৰ্পণ করে দিই।’ যমের উক্তি – ‘তোমার ভ্রাতার এরূপ অভিলাষ নেই ।’ উত্তরে যমী বলছে– ‘তুমি নিতান্ত দুর্বল পুরুষ দেখছি।’ ( ঋগ্বেদ ১০।১০।৭-১৪)
।।তিন ।।
ইন্দ্র দেবলোকের রাজা । ইন্দ্ৰ ইন্দ্ৰিয়াদোষে দুষ্ট । রামায়ণ অনুযায়ী ইন্দ্ৰ গৌতম ঋষির স্ত্রী অহল্যার সতীত্ব নাশ করেছিলেন । অহল্যা ছিলেন ব্ৰহ্মার মানসী কন্যা ও শতানন্দের জননী ৷ অহল্যার সৌন্দর্যের মধ্যে বিন্দুমাত্র ‘হল’ বা বিরূপতা ছিল না । সেজন্যই ব্ৰহ্মা তার নাম দিয়েছিলেন অহল্যা । তিনি বহুদিন অহল্যাকে সংযমচিত্ত গৌতম ঋষির কাছে রেখেছিলেন । গৌতম যখন তাকে পবিত্র ও নিষ্কলঙ্ক অবস্থায় ব্ৰহ্মার কাছে ফিরিয়ে দেন তখন ব্ৰহ্মা সন্তুষ্ট হয়ে গৌতমের সঙ্গে অহল্যার বিবাহ দেন । এতে ইন্দ্র ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠেন, কেননা ইন্দ্র ভেবেছিলেন, এই অপূর্ব সুন্দরী নারী তারই প্ৰাপ্য। একদিন গৌতম স্নান করবার জন্য আশ্রমের বাহিরে গেলে ইন্দ্ৰ গৌতমের রূপ ধরে অহল্যার কাছে আসেন ও তার সঙ্গম প্রার্থনা করেন । অহল্যা ইন্দ্ৰকে চিনতে পেরেও সেই সময় কামার্তা ছিলেন বলে দুর্মতি বশত তাঁর সঙ্গে সঙ্গমে রত হয়। ইতিমধ্যে গৌতম এসে উপস্থিত হন এবং ক্রুদ্ধ হয়ে ইন্দ্রকে অভিশাপ দেন যে ইন্দ্র নপুংসক হবেন । সঙ্গে সঙ্গে ইন্দ্রের অণ্ড খসে পড়ে । কিন্তু ইন্দ্র দেবতাদের কাছে নিজের দুৰ্দশার কথা বললে, দেবতারা মেষাণ্ড উৎপাটিত করে ইন্দ্রের দেহে সংযুক্ত করেন। (ইন্দ্রের এই দুৰ্গতির কারণ সম্পর্কে আগের অধ্যায় দ্রষ্টব্য)।
ইন্দ্র একবার বৃষণশ্চ রাজার কন্যা মেনা অভিমুখী হয়েছিলেন । পরে মেনাকে প্ৰাপ্তযৌবন দেখে ইন্দ্ৰ স্বয়ং তার সাথে সহবাস অভিলাষ করেছিলেন । ( ঋগ্বেদ ১৷৫২৷১৩ সম্বন্ধে সায়ণ ভাষ্য দেখুন) ।
।। চার ।।
বৈদিকযুগে ইন্দ্র যেমন শ্রেষ্ঠ দেবতা, পৌরাণিক যুগে বিষ্ণু তেমনই সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা। বিষ্ণুও ব্যভিচার দোষ থেকে মুক্ত নন। বিষ্ণুর ব্যভিচার সম্বন্ধে দু’টা কাহিনী বিবৃত আছে। একটা হচ্ছে জলন্ধরের স্ত্রী বৃন্দা সম্বন্ধে আর একটা শঙ্খচূড়ের স্ত্রী তুলসী সম্বন্ধে। প্রথমেই বলছি তুলসীর কথা । তুলসী রাধিকার সহচরী। একদিন গোলোকে কৃষ্ণের সঙ্গে তাকে ক্রীড়ারত দেখে, রাধিকা তুলসীকে অভিশাপ দেন যে সে মানবীরূপে জন্মগ্রহণ করবে । কিন্তু কৃষ্ণ তুলসীকে সান্তনা দিয়ে বলেন, তুমি দুঃখিত হয়ে না, কেননা তপস্যা দ্বারা তুমি আমার এক অংশ পাবে। তুলসী ধৰ্মধ্বজ রাজার স্ত্রী মাধবীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করে ব্ৰহ্মার তপস্যায় রত হন । ব্ৰহ্মা তার তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে, তাকে বর চাইতে বলেন । তুলসী বলে, তিনি নারায়ণকে স্বামীরূপে পেতে চান । ব্ৰহ্মা বলেন, কৃষ্ণের অঙ্গসম্ভুত সুদাম দানবগৃহে শঙ্খচূড় নামে জন্মগ্রহণ করেছে। তুমি তার স্ত্রী হবে, এবং পরে নারায়ণের পাশে বৃক্ষরূপে জন্মগ্রহণ করবে। তোমাকে না হলে নারায়ণের পূজাই হবে না। যথা সময় শঙ্খচূড়ের সঙ্গে তুলসীর বিবাহ হয়। শঙ্খচূড়ের বর ছিল যে তার স্ত্রীর সতীত্ব নষ্ট না হলে, তার মৃত্যু হবে না। শঙ্খচূড়ের অত্যাচার ও উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে দেবতারা ব্ৰহ্মা ও শিবের সঙ্গে নারায়ণের কাছে যায়। নারায়ণ বলেন, শিব শঙ্খচূড়ের সঙ্গে যুদ্ধে রত হলে, তিনি তুলসীর সতীত্ব নষ্ট করবেন। যুদ্ধের সময় নারায়ণ শঙ্খচূড়ের রূপধারণ করে, তুলসীর সতীত্ব নষ্ট করে। তখন শিবের হাতে শঙ্খচূড় নিহত হয় । নারায়ণ ছদ্মবেশে তার সতীত্ব নষ্ট করেছে জানতে পেরে, তুলসী নারায়ণকে অভিশাপ দেয়, ‘আজ থেকে তুমি পাষাণে পরিণত হও!’ সেই থেকে নারায়ণ শিলারূপে অবস্থিত হয়ে সর্বদা তুলসীযুক্ত হয়ে থাকেন । এটা ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের কাহিনী। পদ্মপুরাণের কাহিনী অনুযায়ী তুলসী জলন্ধর নামে এক অসুরের স্ত্রী বৃন্দা। শিবের সঙ্গে জলন্ধরের যুদ্ধ হয়। বৃন্দা স্বামীর প্রাণরক্ষার জন্য বিষ্ণুপূজায় প্ৰবৃত্ত হয়। তখন বিষ্ণু জলন্ধরের রূপ ধারণ করে বৃন্দার সামনে এসে উপস্থিত হন । স্বামীকে অক্ষত দেহে ফিরে আসতে দেখে, বৃন্দা পূজা অসমাপ্ত রেখে উঠে পড়ে । তাতেই জলন্ধরের মৃত্যু হয়। বৃন্দা বিষ্ণুকে অভিশাপ দিতে উদ্যত হলে, বিষ্ণু ভীত হয়ে বৃন্দাকে বলে, তুমি সহমৃতা হও, তোমার ভস্ম থেকে ( অন্য মতে কেশ থেকে ) তুলসী বৃক্ষ উৎপন্ন হবে, এবং তুমি লক্ষ্মীর ন্যায় আমার প্রিয় হবে । তোমা ব্যতীত নারায়ণের পূজা হবে না।