স্বর্গের আর একজন অগ্রসর হচ্ছে পূর্বাচিত্তী । একবার জম্বুদ্বীপের রাজা প্রিয়ব্রতের জ্যেষ্ঠপুত্র অগ্নিধ্রের কোন পুত্র না হওয়ায়, তিনি পুত্ৰকামনায় মন্দার পর্বতে ব্ৰহ্মার তপস্যায় রত হন। ব্ৰহ্মা তার তপস্যায় তুষ্ট হয়ে পূর্বাচিত্তী নামে অপ্সরাাকে তার কাছে পাঠিয়ে দেন। পূর্বচিত্তীর রূপে মুগ্ধ হয়ে অগ্নিধ্র তাকে গান্ধৰ্বমতে বিবাহ করে । এই বিবাহের ফলে অগ্নিধ্রের ঔরসে ও পূর্বাচিত্তীর গর্ভে নয়টি পুত্রসন্তান হয় ।
আরও একজন অপ্সরা হচ্ছে প্রম্লোচ্চা । কণ্ডু মুনির তপস্যা ভঙ্গ করবার জন্য ইন্দ্র প্রম্লোচ্চাকে কণ্ডুমুনির কাছে পাঠিয়ে দেন। কণ্ডু প্ৰণয়াসক্ত হয়ে প্রম্লোচ্চার সঙ্গে দীর্ঘকাল বাস করেন। তাঁর ঔরসে প্রম্লোচ্চার এক কন্যা সন্তান হয়, তার নাম মারিষা । বিষ্ণুপুরাণ অনুযায়ী মারিষার গর্ভে প্ৰজাপতি দক্ষ জন্মগ্রহণ করেন । বরুণ পুত্র পুষ্করের ঔরসে ও প্রম্লোচ্চার গর্ভে মনোরমা নামে এক কন্যা হয় । প্রম্লোচ্চার অনুরোধে প্ৰজাপতি রুচি এঁকে স্ত্রী রূপে গ্ৰহণ করেন। রুচির ঔরসে এঁর গর্ভে রৌচ্যমনুর জন্ম হয় । হেমা নামে আর একজন অপ্সরা ময়দানবকে বিবাহ করে। তাঁর গর্ভে মায়াবী ও দুন্দুভী নামে দুই পুত্ৰ ও মন্দোদরী নামে এক কন্যা জন্মগ্রহণ করে, মন্দোদরী রাবণের স্ত্রী ও মেঘনাদের মাতা ।
অগণিত অপসারদের মধ্যে সকলের নাম আমাদের জানা নেই । যাদের নাম জানা আছে, তাদের কথাই আগে বললাম । তবে অদ্রিকা নামে আর একজন অপ্সরাার নাম আমরা মহাভারতে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসের জন্ম বৃত্তান্তের কাহিনীর মধ্যে পাই । কুরুরাজ চেদিবংশীয় উপরিচর বসু একবার মৃগয়া করতে গিয়ে তঁর রূপবতী স্ত্রী গিরিকাকে স্মরণ করে কামাতুর হয়ে পড়েন। তাতে তাঁর রেতঃস্বলন হয় । স্খলিত শুক্র তিনি এক শ্যেনপক্ষীর সাহায্যে তঁর স্ত্রীর নিকট প্রেরণ করেন । পথে অন্য এক শ্যেনের আক্রমনে উক্ত শুক্র যমুনার জলে পড়ে। সে সময় অদ্রিকা নামে এক অপ্সরা ব্ৰহ্মশাপে মৎস্যরূপ ধারণ করে যমুনার জলে বাস করছিল । সেই অপ্সরাা ওই শুক্র গ্ৰহণ করে গর্ভবতী হয়। তার ফলে তার এক পুত্র ও কন্যা হয়। কন্যা এক ধীবর কর্তৃক পালিত হয় । তার গায়ে মৎস্যের গন্ধ থাকার দরুন তার নাম মৎস্যগন্ধা হয় । তাঁর অপর নাম সত্যবতী। কুমারী অবস্থায় পরাশর মুনির ঔরসে তাঁর গর্ভে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসের জন্ম হয় ।
৷৷ পাঁচ ॥
অপ্সরাাদের সঙ্গে যৌ*সম্পর্ক ছিল গন্ধৰ্বদের । বৈদিকযুগে গন্ধৰ্বরা ছিল এক শ্রেণীর উপদেবতা । কিন্তু যখন তাদের সংখ্যা বেড়ে গেল, স্বৰ্গেই তারা নিম্নশ্রেণীর দেবতা হিসাবে স্থান পেল । সঙ্গীতবিদ্যায় তারা বিশেষ পারদর্শী ছিল। এছাড়া, ওষধি বিষয়েও তারা অভিজ্ঞ ছিল । সেজন্য তাদের স্বর্গের বৈদ্য বলা হত । স্বর্গে তারা অপ্সরাাদের সঙ্গে গায়ক হিসাবে যোগদান করত । অপ্সরাদের সঙ্গে তারা অবাধে মেলামেশা করত। নারী ও পুরুষের অবাধ মেলামেশার ফলে যে বিবাহ হয়, তাকেই গান্ধৰ্ব বিবাহ বলা হত। বিষ্ণুপুরাণ মতে ব্ৰহ্মার কান্তি থেকে তাদের জন্ম হয় । আর হরিবংশ মতে স্বারোচিষ মন্বন্তরে অবিষ্ঠার গর্ভে গন্ধৰ্বরা জন্মগ্রহণ করে । তাদের সমৃদ্ধশালী নগরী ও প্রাসাদ ছিল । এই সকল নগরীর অধিপতি ছিল হা হা, হু হু, চিত্ররথ, হংস, বিশ্ববায়ু, সোমারা, তুম্বুরু, নন্দি প্রভৃতি গন্ধর্বগণ ।
দেবদেবীদের ব্যভিচার
আগেই বলা হয়েছে যে দেবসমাজের পরিমণ্ডলটা মানুষ তার নিজ সমাজের প্রতিচ্ছবিতেই কল্পনা করেছিল । সেজন্য মনুষ্যসমাজে যেমন অজাচার ও ব্যভিচারের প্রচলন ছিল, দেবসমাজেও তাই ছিল । পৌরাণিক যুগে ব্ৰহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর, এই তিন দেবতা সব দেবতার উচ্চে স্থান পেয়েছিল। বেদে কিংবা ব্ৰাহ্মণে কিন্তু ব্ৰহ্মার নাম পাওয়া যায় না। পৌরাণিক যুগে ব্ৰহ্মাই ছিলেন সৃষ্টি কর্তা । বেদে ও ব্ৰাহ্মণে সৃষ্টিকর্তাকে হিরণ্যগৰ্ভ প্ৰজাপতি বলা হয়েছে। তা থেকে মনে হয় ব্ৰহ্মা ছিলেন বৈদিক যুগের প্রজাপতিরই পরবর্তীকালের রূপ। পুরাণে সরস্বতীকে ব্ৰহ্মার স্ত্রী বলা হয়েছে। শতরূপ ব্ৰহ্মার কন্যা । কিন্তু ব্ৰহ্মা নিজ কন্যার রূপে মুগ্ধ হয়ে তার সঙ্গে অজাচারে লিপ্ত হন । এই অজাচারের ফলে শতরূপার গর্ভে স্বায়ভুব মনুর জন্ম হয়। অন্য কাহিনী অনুযায়ী শতরূপ ব্ৰহ্মার স্ত্রী, মনুর মাতা নন । আর এক কাহিনী অনুযায়ী ব্ৰহ্মা নিজেকে দুই অংশে বিভক্ত করেন-নর ও নারী । এদের সঙ্গমের ফলে মনুর জন্ম হয় । আর নারীকে সাবিত্রী বলা হয় । পুরাণে আছে ব্ৰহ্মা প্ৰথম নয়জন মানসপুত্র সৃষ্টি করেন । তারপর এক কন্যা সৃষ্টি করেন । এই কন্যারই নাম শতরূপা । শতরূপ। নানা নামে পরিচিত – শতরূপা, সাবিত্রী, গায়ত্রী, সরস্বতী ও ব্রাহ্মণী । ব্ৰহ্মা এই কন্যার রূপে মুগ্ধ হয়ে একেই বিবাহ করেন। এই কন্যারই গর্ভ হতে স্বায়ভুব মনুর জন্ম হয়। আবার বলা হয়েছে স্বায়ম্ভূব মনু হতে শতরূপার গর্ভে প্রিয়ব্রত ও উত্তানপাদ নামে দুইপুত্র ও কাকুতি ও প্রসূতি নামে দুই কন্যা জন্ম গ্রহণ করে । তাদের পুত্রকন্যা থেকেই মনুষ্যজাতির উদ্ভব হয় । বিভিন্ন কাহিনীগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে অজাচারের মধ্য দিয়েই মনুষ্য সমাজের সৃষ্টি হয়েছিল । মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যেও ব্ৰহ্মাকে কামুক দেবতা হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে। সেখানে ব্ৰহ্মা গোপকন্যার গায়ে গা লাগিয়ে উপবিষ্ট হয়ে আছেন।