পুরুরবা তখন উর্বশীর সন্ধানে দেশবিদেশে ভ্ৰমণ করতে থাকে। একদিন কুরুক্ষেত্রের কাছে এক সরোবরে পুরুরবা চারজন অপ্সরাার সঙ্গে উর্বশীকে স্নান করতে দেখে । পুরুরবা তাকে ফিরে আসতে অনুরোধ করে। উর্বশী বলে-’আমি তোমার সহবাসে গর্ভবতী হয়েছি। তুমি এক বছর পর আমার সঙ্গে দেখা করলে, আমি তোমাকে আমার প্রথম সন্তান উপহার দিব এবং মাত্র একরাত্রি তোমার সঙ্গে বাস করব ।’ এভাবে দীর্ঘ ছয় বছর কাল এক রাত্রির জন্য উর্বশী ও পুরুরবার মিলন ঘটে। তার ফলে আয়ু, বিশ্বায়ু, শতাষ্ণু প্ৰভৃতি নামে তাদের ছয়টি পুত্র জন্ম গ্ৰহণ করে । তারপর উর্বশী পুরুরবাকে জানান যে গন্ধর্বরা পুরুরবাকে যে কোন প্রার্থিত বর দিতে প্ৰস্তুত আছে । পুরুরবা তখন বলেন যে উর্বশীর সঙ্গে তিনি চিরজীবন বাস করতে চান এবং এটাই তার একমাত্র প্রার্থনা । তখন গন্ধৰ্বরা অগ্নিপূর্ণ একপাত্র পুরুরবার সামনে রাখে এবং বলে যে – ‘এই অগ্নিপাত্ৰ গ্ৰহণ করে বেদের নির্দেশানুযায়ী এই অগ্নিকে তিনভাগে ভাগ কর । তারপর উর্বশীতে মনসংযোগ করে আহুতি দাও । তবেই তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হবে ।’ পুরুরবা সেই অনুযায়ী কার্য করলে গন্ধৰ্বলোকে স্থান পান এবং উর্বশীর চিরসঙ্গী ও চিরপ্রেমিক হয়ে সেখানে বাস করতে থাকেন ( শতপথব্ৰাহ্মণ ৩।৪৷১।১১)। উর্বশীর গর্ভে মোট ছয় সন্তান হয়- আয়ু, বিশ্বায়ু, অমাবসু, বলায়ু দৃঢ়ায়ু ও শতায়ু ।
।। তিন ॥
পুরুরবার সঙ্গে উর্বশীর মিলন সম্বন্ধে বেদে আরও এক কাহিনী আছে । একবার আদিত্যযজ্ঞে মিত্র ও বরুণ নিমন্ত্রিত হয়েছিল । সেখানে অপ্সরাা উর্বশীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ায় তাদের রেতঃপাত হয় । রেতের যে ভাগ কুম্ভে পড়ে, তা থেকে বশিষ্ঠ ও অগস্ত্য জন্ম গ্ৰহণ করে । তাতে এই দুই দেবতা ক্রদ্ধ হয়ে উর্বশীকে অভিশাপ দেয় যে তাকে মর্ত্যে নিৰ্বাসিত হতে হবে । সেই কারণেই মর্ত্যে এসে উর্বশী পুরুরবার স্ত্রী হয় ।
উৰ্বশী সম্বন্ধে আরও আখ্যান প্ৰাচীন গ্রন্থে আছে। মহাভারতের বনপর্ব অনুযায়ী মহাদেবকে সন্তুষ্ট করে অর্জুন যখন দিব্যাস্ত্ৰ সংগ্রহের জন্য দেবলোকে গিয়ে পাঁচ বৎসর বাস করেছিলেন, তখন তিনি ইন্দ্রের আদেশে গন্ধৰ্ব চিত্ৰসেনের কাছে নৃত্য-গীত-বাদ্য শিখছিলেন । একদিন
চিত্ৰসেন উর্বশীর কাছে গিয়ে বলল–‘কল্যাণী দেবরাজের আদেশে তােমাকে জানাচ্ছি যে অর্জুন তোমার প্রতি আসক্ত হয়েছেন । তিনি আজ তোমার কাছে আসবেন।’ – উর্বশী নিজেকে সম্মানিত জ্ঞান করে বলল, ‘আমিও তার প্রতি অনুরক্ত । সখা তুমি যাও, আমি অর্জুনের সঙ্গে মিলিত হব।’ তারপর রাত্রিকালে উর্বশী অর্জুনের গৃহে যান । তার আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করলে উর্বশী বলে—‘তুমি যখন দেবালোকে আস, তখন তোমার আগমনের জন্য ইন্দ্ৰ যে আনন্দোৎসবের অনুষ্ঠান করেছিলেন, সে সময় তুমি নাকি অনিমেষনয়নে শুধু আমাকেই দেখেছিলে ।’ তাই দেখে ইন্দ্ৰ চিত্ৰসেনকে আদেশ দিয়েছিলেন আমি যেন তোমার সঙ্গে মিলিত হই । আমিও তোমার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অনঙ্গের বশবর্তী হয়ে তোমার কাছে এসেছি ।’ সে কথা শুনে অর্জুন কান ঢেকে উর্বশীকে বলে—‘ভাগ্যবতী, আপনার কথা আমার শ্রবণযোগ্য নয়, কেননা কুন্তী ও শচীর ন্যায় আপনি আমার গুরুপত্নী তুল্য। আপনি পুরুবংশের জননী ( পুরুরবার ঔরসে উর্বশীর গর্ভে আয়ু জন্মগ্রহণ করে, তারই প্রপৌত্র পুরু ), গুরুর অপেক্ষাও গুরুতম, সেজন্যই উৎফুল্লনয়নে আপনাকে দেখেছিলাম ।’ তখন উর্বশী বলল, ‘আমাকে গুরুস্থানীয়া মনে করা অনুচিৎ, কেননা অপ্সরারা নিয়মাধীন নয়। পুরুবংশের পুত্র বা পৌত্র যে কেউ স্বর্গে এলে আমার সঙ্গে মিলিত হয়। তুমিও আমার বাঞ্ছা পূর্ণ কর।’ অৰ্জুন কর্তৃক প্ৰত্যাখাতা হয়ে উর্বশী ক্ৰোধে অভিভূত হয়ে অর্জুনকে অভিশাপ দেয় —’আমি ইন্দ্রের অনুজ্ঞায় স্বয়ং তোমার গৃহে কামার্ত হয়ে এসেছি, তথাপি তুমি আমাকে গ্ৰহণ করলে না, তুমি সম্মানহীন নপুংসক নর্তকী হয়ে স্ত্রীদের মধ্যে বিচরণ করবে।’ এই বলে উর্বশী নিজ গৃহে চলে যায়। এই অভিশাপের জন্যই অজ্ঞাতবাসের সময় বিরাট রাজার গৃহে অৰ্জুনকে বৃহন্নলা নামে নর্তকীর ছদ্মবেশ ধারণ করে থাকতে হয়েছিল ।
আবার মহাকবি কালিদাসের ‘বিক্রমোর্বিশী’ নাটকে আছে যে একবার কেশী দৈত্য উর্বশীকে হরণ করলে পুরুরবা তার হাত থেকে উর্বশীকে উদ্ধার করেছিল এবং উভয়ে পরস্পরের প্রণয়াসক্ত হয় । স্বৰ্গে অভিনয়কালে ভুলক্রমে পুরুরবার নাম উল্লেখ করে ফেলায় শাপগ্ৰস্ত হয়ে উর্বশী মর্ত্যে পুরুরবার স্ত্রী হয়। পুত্ৰ মুখ দর্শনের শাপমোচন হয় । পরে নারদের বরে উর্বশী ও পুরুরবার মিলন চিরস্থায়ী হয়।
একবার অভিশপ্ত হয়ে উর্বশী ঘোটকী হয়েছিল। তখন রাজা দণ্ডী তাকে গ্ৰহণ করেছিল ।
।। চার ।।
উৰ্বশী ছাড়া আরও অপ্সরা ছিল। আগেই বলেছি যে দেবলোকের বারযোষিতদের সংখ্যা ৬০ কোটি বলে উল্লিখিত হয়েছে । তাদের মধ্যে উল্লেখনীয় হচ্ছে মেনকা, রম্ভা, তিলোত্তমা, ঘৃতাচী, সুকেশী, মঞ্জুঘোষা, অলম্বুষা, বিদ্যুৎপর্না, সুপ্রিয়া, সরসা, পঞ্জিকাস্থলা, বিশ্বাচী প্রভৃতি। বিভিন্ন পুরাণে এদের সৌন্দর্য ও নৃত্যগীত পারদর্শিতার অনেক উল্লেখ আছে। রম্ভা, মেনকা প্ৰভৃতি অপ্সরা ক্ষীরোদসাগর মন্থনের সময়ে উদ্ভূত হয়। একবার রম্ভা কুবেরের পুত্র নলকুবেরের নিকট অভিসার গমনকালে, রাবণ তাকে দেখে কামমুগ্ধ হয় ও বলপূর্বক তাকে ধর্ষণ করে । ধর্ষণের প্রাক্কালে রাবণের উক্তি থেকে আমরা রম্ভার রূপলাবণ্যের পরিচয় পাই । রাবণ বলেছিল—“স্বর্ণকুম্ভ পীনৌ শুভৌ ভীরু নিরন্তরৌ । কস্যেরঃ স্থলসংস্পৰ্শং যস্যেতস্তে কুচাবিমৌ।। সুবৰ্ণচক্ৰ প্ৰতিমং স্বর্ণদামচিতং পৃথু। অধ্যারোক্ষ্যতি কস্তেইদ্য জঘনং স্বৰ্গরূপিণম ||’ ( রামায়ণ উত্তরকাণ্ড ৩১।২৩-২৪ ) । ‘তোমার সুন্দর কুচযুগল স্বর্ণকুম্ভসদৃশ পীন, নিরন্তর ( কুচদ্বয় মধ্যে কোন ব্যবধান নেই ) ; তোমার কুচযুগল কোন পুরুষের বক্ষ স্পর্শ করবে ? তোমার জঘনদ্বয় সুবর্ণচক্ৰ প্ৰতিম, স্বর্ণহারশোভিত স্থূল ; তোমার এই স্বৰ্গরূপী শ্ৰোণিতটে কোন পুরুষ অদ্য আরোহন করবে।’ ‘আমি ধৰ্মানুসারে আপনার পুত্রবধু’, এই কথা বলে রম্ভা রাবণকে প্ৰতিহত করবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাবণ রম্ভাকে শিলাতলে ফেলে উপভোগ করল। রম্ভা রতিশ্রমে কাতরা ও ব্যাকুলা, বেপমানা ও ভীতিগ্ৰস্তা হয়ে নলকুবেরকে একথা জানালে নলকুবের রাবণকে অভিশাপ দেন যে রাবণ যদি কোন স্ত্রীলোকের অনিচ্ছায় তার প্রতি বলপ্ৰয়োগ করে, তাহলে রাবণের মস্তক সপ্তখণ্ডে ভগ্ন হবে । এই জন্যই সীতা রাবণ কর্তৃক, অপহৃত হয়েও নিজের সতীত্ব রক্ষা করেন । রামায়ণের আদিকাণ্ডে ও মহাভারতের অনুশাসন পর্বে রম্ভা সম্বন্ধে আর এক কাহিনী আছে । একবার ইন্দ্র বিশ্বামিত্রের তপোভঙ্গ করবার জন্য অপ্সরা রম্ভাকে পাঠান । কিন্তু বিশ্বামিস্ত্রের শাপে রম্ভা শিলাতে পরিণত হয়ে ১০০ বৎসর অবস্থান করে । স্কন্দপুরাণ অনুযায়ী রম্ভা যখন বিশ্বামিত্রের আশ্রমে শিলারূপে বাস করছিল, তখন অঙ্গারিকা নামে এক রাক্ষসী সেখানে উপদ্রব্য করতে আরম্ভ করে । তখন ওই আশ্রমে তপস্যারত শ্বেতমুনি বায়ব্য অস্ত্রে ওই শিলাখণ্ড যোজনা করে রাক্ষসীর দিকে নিক্ষেপ করে । অস্ত্ৰভয়ে ভীত রাক্ষসী পলায়ন করে কপিতীর্থে এলে তার মস্তকে ওই শিক্ষাখণ্ড পড়ে ও তার মৃত্যু হয়। ওই শিলাখণ্ড কপিতীর্থে নিমগ্ন হলে রম্ভা আবার নিজরূপ ফিরে পায়। স্কন্দপুরাণে রম্ভা সম্বন্ধে আরও দু’টা কাহিনী আছে। একটা কাহিনী অনুযায়ী একবার ইন্দ্ৰসভায় নৃত্যুকালে রম্ভার তালভঙ্গ হয়। তখন ক্রুদ্ধ ইন্দ্রের শাপে স্পন্দনহীন বিকলাঙ্গ হয়ে রম্ভা ভূতলে পতিত হয়। পরে নারদের পরামর্শে রম্ভা শিবের পূজা করে পুনরায় স্বৰ্গে ফিরে যেতে পারে। অপর কাহিনী অনুযায়ী ইন্দ্রের আদেশে রম্ভা জাবালি মুনির তপোভঙ্গ করে । মুনির ঔরসে রম্ভার এক কন্যা জন্মগ্রহণ করে। জাবালি ওই কন্যাকে প্রতিপালন করেন । ওই কন্যার নাম ফলবতী ।