বলপূর্বক নারীধর্ষণের অনেক দৃষ্টান্ত আগে দিয়েছি। এখানে আর একটা দৃষ্টান্ত দিব । রাজা ইক্ষাকুর একশত পুত্র ছিল । কনিষ্ঠের নাম দণ্ড । দণ্ড অতিশয় মূঢ় ও মুর্থ ছিল । রাজা তার আচরণে রুষ্ট হয়ে তাকে বিন্ধ্য ও শৈবাল পর্বতের মধ্যে এক রাজ্য দিলেন । দণ্ড সেখানে মধুমন্ত নামে এক নগর স্থাপন করে শুক্রাচার্যের সাহায্যে রাজত্ব করতে লাগলেন । একদা চৈত্রমাসে মহর্ষি শুক্রাচার্যের আশ্রমে গিয়ে তাঁর অসামান্য রূপবতী কন্যা অরজাকে দেখে কামাতুর হয়ে বলপূর্বক তাকে স্পর্শ করতে যায়। অরজা বলে ‘আমি আমার পিতার অধীনা । যদি আপনি আমার প্রতি আসক্ত হয়ে থাকেন, তবে আপনি আমার পিতার নিকট আমার পাণি প্রার্থনা করুন ।’ দণ্ড কামশরে জর্জরিত হয়ে বলে–‘তোমার জন্য আমার হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে, আমি এক মূহুৰ্তও অপেক্ষা করতে পারছি না।’ এই বলে দণ্ড অরজাকে বাহুযুগল দ্বারা বলপূর্বক ধারণ করে মৈথুনে প্ৰবৃত্ত হয়। শুক্রাচার্য আশ্রমে ফিরে এসে কন্যার কাছে সব কথা শুনে ক্ৰোধে প্ৰজ্জ্বলিত হয়ে দণ্ডকে অভিশাপ দেন যে সাতদিনের মধ্যে প্ৰজাসমেত তার সমস্ত রাজ্য ধূলিসাৎ হবে । বিন্ধ্য ও শৈবল পর্বতের মধ্যবর্তী ভূভাগ দণ্ডরাজ্য দণ্ডের অপরাধে শাপগ্ৰস্ত হয়ে এর নাম হয়েছে ‘দণ্ডকারণ্য’ তৎপর তপস্বীগণ এখানে বাস করেন, সেজন্য এর নাম হয় ‘জনস্থান’
।। চোদ্দ ।।
শিবের বীর্যতেজের কথা রামায়ণের আদিকাণ্ডের ৩৫-৩৭ সর্গে বিবৃত হয়েছে। সেই কাহিনী অনুযায়ী হিমবান পত্নী মেনকার গর্ভে দুই কন্যা রত্ন লাভ করেন। — (১) গঙ্গ ও (২) উমা। দেবগণের অনুরোধে গঙ্গাকে তিনি দেবগণকে প্রদান করেন। তাঁরা গঙ্গাকে নিয়ে প্রস্থান করেন, তারপর হিমবান কনিষ্ঠা কন্যা তপস্বিনী উমাকে রুদ্রহস্তে সমর্পণ করেন। মহাদেব বিবাহান্তে উমার সহিত রতিক্রিয়া করতে আরম্ভ করেন। কিন্তু রতিক্রিয়া করতে করতে দেবপরিমিত শতবর্ষ বিগত হলেও সেই দেবীতে কোন পুত্রোৎপাদন হল না (অর্থাৎ শুক্রক্ষরণ হল না)। তখন তখন পিতামহ দেবগণসহ ‘এই বীর্যে যে পুত্রোৎপাদন হবে, তা কে ধারণ করবে ?’ এরূপ বিচার করে মহাদেবের নিকট গমন করে প্রণিপাতপূর্বক বললেন, ‘দেবাদিদেব ! আপনি আমাদের প্ৰতি প্ৰসন্ন হউন ! এই সকল লোক আপনার তেজধারণে সমর্থ নয় ; আপনি ব্ৰাহ্মতপোযুক্ত হয়ে দেবীর সহিত তপস্যা করে ত্ৰৈলোক্যের মঙ্গলের জন্য তেজধারণ করুন এবং সমস্ত লোক রক্ষা করুন ।’ তখন মহাদেব বললেন, ‘সুরগণ ! আমি উমার সহিত স্বীয় তেজেই তেজধারণ করব, তোমরা ও পৃথিবী সকলেই শান্তিলাভ কর। কিন্তু আমার যে অনুত্তম তেজ স্বস্থান হতে বিচলিত হয়েছে তা কে ধারণ করবে, তা নির্দেশ কর ।’ তখণ দেবতারা বললেন, ‘আপনার যে তেজ ক্ষুব্ধ হয়েছে, পৃথিবী তা ধারণ করবে।’ তারপর মহাদেব বীৰ্যত্যাগ করলেন, এবং সেই বীর্যের তেজে পৃথিবী, কানন ও গিরি পরিব্যাপ্ত হল । তখন দেবগণের অনুরোধে অগ্নিদেব পবনদেবের সঙ্গে মিলিত হয়ে সেই রুদ্র-তেজে প্ৰবেশ করলেন, এবং সেই তেজ অগ্নি কর্তৃক ব্যাপ্ত হয়ে পৰ্বত রূপে পরিণত হ’ল । সেই পর্বতে এক শরবন সৃষ্ট হল । সেই শরবনে কার্তিকের জন্ম হল ।
।। পনেরো ।।
মনে হয়, মহিষমৰ্দিনীর উপাখ্যানের সঙ্গে পাঠকরা পরিচিত । রম্ভ নামে এক দুর্দান্ত অসুর মহাদেবকে তপস্যায় প্রীত করে, মহাদেবের বরে এক ত্ৰিলোক বিজয়ী পুত্ৰ পায় । সেই পুত্ৰই মহিষাসুর। ব্ৰহ্মার বরে সে পুরুষের অবধ্য হয় । মহিষাসুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দেবতারা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হয়। অবধ্য জেনে বিষ্ণু দেবতাদের নিজ নিজ স্ত্রীর সহিত মিলিত হয়ে, সম্মিলিত তেজ থেকে এক অপূর্ব লাবন্যময়ী নারীদেবতা সৃষ্টি করতে বলেন । তাঁরই হাতে মহিষাসুরের মৃত্যু ঘটবে। মহিষাসুরের তিনবার আবির্ভাব ঘটেছিল এবং তিনবারই দেবী ত্ৰিবিধিরূপ ধারণ করে তাকে বধ করেন। প্ৰথমবার দেবী উপচণ্ডী, দ্বিতীয়বারে ভদ্রকালী ও তৃতীয়বারে দূর্গারূপ ধারণ করেন । এ সম্বন্ধে বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্ন বিবরণ আছে।
৷৷ ষোল ।।
এবার দুই দেবতা সূর্য ও বিষ্ণুর সারথিদের সম্বন্ধে কিছু বলব। সূর্যের সারথি অরুণ ও বিষ্ণুর সারথি গরুড় । অরুণ ও গরুড়ের উৎপত্তি মহাভারতের আদিপর্বে বিবৃত আছে। ঋগ্বেদে আছে ব্ৰহ্মার লোম হতে বালখিল্য নামে অঙ্গুষ্ঠ প্ৰমাণ যাট হাজার ঋষির জন্ম হয় । বালখিল্য ঋষিরা যজ্ঞের জন্য কাঠ আনবার জন্য নিযুক্ত হয় । তারা সকলে মিলিতভাবে মাত্র একটি পত্র বহন করে আনবার সময় জলপূৰ্ণ এক গোস্পদের মধ্যে পড়ে যায় । এই দেখে ইন্দ্ৰ তাদের উপহাস করে । বালখিল্য ঋষির ইন্দ্রের চেয়েও বলশালী অপর ইন্দ্ৰ কশ্যপের শরণাপন্ন হয় । কশ্যপ বালখিল্য ঋষিদের বলেন যে ব্ৰহ্মা ইন্দ্ৰকে সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং অপর এক ইন্দ্ৰ সৃষ্টি করলে ব্ৰহ্মার অপমান করা হবে । তবে তাদের মহাযজ্ঞের ফলে ইন্দ্রের পরিবর্তে এক পক্ষিশ্রেষ্ঠ জন্মগ্রহণ করবে। কাশ্যপের স্ত্রী বিনতা ঋতুস্নান করে তাঁর কাছে এলে, তিনি স্ত্রীর মনোবাসনা পূর্ণ করে বলেন যে বালখিল্য ঋষিদের যজ্ঞের ফলে তার গর্ভে দুই বীরপুত্র জন্ম গ্ৰহণ করবে এবং তারা সমস্ত পক্ষীজাতির ওপর ইন্দ্ৰত্ব করবে। এই দুই বীরপুত্রের নামই অরুণ ও গরুড় ।