।। দশ ।।
শিবি রাজার সত্যপরায়ণতার কথা আগেই বলেছি। এখন বলিরাজার সত্যপরায়ণতার কথা কিছু বলি। বলি ছিলেন দৈত্যরাজ, হরিভক্ত প্রহ্লাদের পৌত্র ও বিরোচনের পুত্র। নিজের তপস্যার দ্বারা ও ইন্দ্ৰাদি দেবতাদের পরাস্ত করে বলি ত্ৰিভুবনের অধীশ্বর হন। রাজ্যচু্যত হয়ে দেবগণ বিষ্ণুর শরণাপন্ন হয়। বিষ্ণু বামণরূপে কশ্যপের পুত্র হয়ে জন্মান ও বলির যজ্ঞানুষ্ঠানে ত্রিপাদভূমি প্রার্থনা করেন । বলি সম্মত হন । কিন্তু দান পাওয়া মাত্র বামণ বিশাল আকার ধারণ করে দুইপদ দ্বারা স্বৰ্গ ও মর্ত্য অধিকার করে, নাভি থেকে নির্গত তৃতীয় পদ রাখবার স্থান বলিকে নির্দেশ করতে বলেন । বলি তার নিজের মাথার ওপর তৃতীয় পদ রাখতে বলেন । এমন সময় পিতামহ প্রহ্লাদ সেখানে উপস্থিত হয়ে বিষ্ণুকে বলির বন্ধন মোচন করার প্রার্থনা জানায়। তার প্রার্থনায় কিষ্ণু বলির বন্ধন মোচন করে, ও তার সত্যপরায়ণতার প্ৰশংসা করে ও দেবতাদের দুগ্ধপ্রাপ্য রসাতলে তার স্থান করে দেন ।
।। এগার ।।
হরিশ্চন্দ্র রাজাও তার দান, ধ্যান ও সত্যপরায়ণতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। ঐতরেয়ত্ৰাহ্মণ অনুযায়ী অপুত্ৰক রাজা হরিশ্চন্দ্ৰ পুত্রলাভের জন্য নরমেধ যজ্ঞ করেন। মার্কণ্ডেয়পুরাণ অনুযায়ী রাজা হরিশ্চন্দ্র একদিন মৃগয়ায় বেরিয়ে বনমধ্যে বিশ্বামিত্র মুনির তপস্যার বিঘ্ন ঘটান । তাঁর কৃতকর্মের জন্য বিশ্বামিত্ৰ তার কাছ থেকে দান চাইলেন । বিশ্বামিত্র তার কাছ থেকে দান হিসাবে সোনাদান রাজ্য প্রভৃতি সবই আদায় করে নিলেন । অবশিষ্ট রইল মাত্র তার পরিধেয় বস্ত্র ও স্ত্রী শৈব্যা ও পুত্র রোহিত। কিন্তু বিশ্বামিত্ৰ দক্ষিণা চাইলে, তাঁর আর কিছু না থাকায় তিনি এক ব্ৰাহ্মণের কাছে স্ত্রী শৈব্যা ও পুত্র রোহিতকে বিক্রয় করে দিলেন । পরে তিনি নিজেকেও এক চণ্ডালের কাছে দাসরূপে বিক্রয় করে দিলেন । প্ৰাপ্ত অর্থ তিনি দক্ষিণাস্বরূপ বিশ্বামিত্ৰকে দিলেন । চণ্ডালের দাস রূপে হরিশচন্দ্ৰ শ্মশানে কাজ করতে লাগলেন। এক বছর পরে সর্পাঘাতে রোহিতের মৃত্যু হয় । দাহের জন্য শৈব্যা মৃত পুত্রকে শ্মশানে নিয়ে আসে। সেখানে হরিশ্চন্দ্র ও শৈব্যা পরস্পরকে চিনতে পারে। তখন তাঁরা স্থির করেন, মৃতপুত্রের চিতায় দুজনেই প্ৰাণ বিসর্জন দেবেন। এই সময় দেবতাগণ ও ধর্ম বিশ্বামিত্রের সঙ্গে সেখানে উপস্থিত হন । হরিশচন্দ্ৰকে তাঁরা সহমৃত হতে নিষেধ করেন। তাঁরা তাকে স্বর্গে নিয়ে যেতে চান । হরিশ্চন্দ্ৰ বলে সে তাঁর প্রভু চণ্ডালের বিনা অনুমতিতে স্বর্গে যেতে পারেন না। তখন চণ্ডাল বলে, তিনিই ধর্ম । রোহিত প্ৰাণ ফিরে পায় । তখন হরিশ্চন্দ্র রোহিতকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করে স্বর্গে যান। সেখানে নারদের প্ররোচনায় তিনি আত্মপ্ৰশংসায় রত হন । এর জন্য স্বর্গ থেকে তাঁর পতন ঘটে। কিন্তু পতনের সময় তিনি অনুতপ্ত হওয়ায়, দেবতারা তাঁকে ক্ষমা করেন, কিন্তু তাঁকে অন্তরীক্ষে এক বায়বীয় স্থানে বাস করতে হয়।
।। বার ।।
ত্ৰেতাযুগে স্ত্রী পুরুষ হত, এবং পুরুষ স্ত্রী হত । এই রূপান্তরের কথা রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে বর্ণিত হয়েছে । বাল্হীক দেশে কর্দম রাজার ‘ইল’ নামে এক পুত্র ছিল। একদিন মৃগয়া করতে তিনি কাৰ্তিকের জন্ম স্থানে এসে উপস্থিত হন । সেখানে মহাদেব স্ত্রীরূপ ধারণ করে উমার মনোরঞ্জন করছিলেন । সেখানে সকল প্ৰাণী স্ত্রীত্ব প্ৰাপ্ত হয়েছিল । রাজা ইলও অনুচরবর্গসহ স্ত্রীত্ব প্রাপ্ত হলেন । তখন তিনি মহাদেব ও উমার শরণাপন্ন হন । তাদের প্রসন্ন করাতে তিনি বর পেলেন যে তিনি একমাস পুরুষ হবেন, আবার একমাস স্ত্রী হবেন । প্রথম মাসে রাজা ইল লোকসুন্দরী নারী হয়ে স্ত্রীভাবাপন্ন অনুচরদের সঙ্গে সেই কাননে বেড়াতে লাগলেন। চন্দ্রের পুত্র বুধ সেখানে তপস্যা করছিল। বুধ সেই সুন্দরী ললনাকে দেখে কামবাণে বিদ্ধ হল এবং তাকে বলল ‘আমি ভগবান চন্দ্রের প্রিয় পুত্ৰ, তুমি আমাকে ভজনা কর।’ ‘ভেজস্ব মাং বরারোহে ভক্ত্যা স্নিগ্ধেন চক্ষুসা।’ ( উত্তরকাণ্ড ১০২।৪ ) । তখন বুধ ইলর সহিত রমণে প্ৰবৃত্ত হল । এই ভাবে ইল এক মাস স্ত্রী হয়ে বুধের কামবাসনা পূর্ণ করতেন, এবং একমাস পুরুষ হয়ে ধর্মচর্চায় নিযুক্ত হতেন । এইরূপে আট মাস। গত হলে নবম মাসে ইল পুরুরবা নামে এক পুত্র প্রসব করলেন । পুত্রকে বুধের হতে দিয়ে, ইল অশ্বমেধ যজ্ঞ করল ও মহাদেবকে সন্তুষ্ট করে পুরুষত্ব পেল ।
।। তের ।।
যোগনিরত ব্ৰহ্মার চক্ষু থেকে নিৰ্গত অশ্রুবিন্দু হতে এক বানরের জন্ম হয়। তার নাম ঋক্ষরজা । এক দিন তিনি সুমেরু পর্বতে এক সরোবরতীরে বসে জলমধ্যে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পান, এবং তাকে শত্রু মনে করে তিনি জলে পড়েন ও আবার জল থেকে ওঠেন । অবগাহনের ফলে তিনি এক পরমা সুন্দরী নারীরূপ পান । সেই অনিন্দ্যসুন্দরী বরাঙ্গনাকে দেখে ইন্দ্র ও সূর্য দুজনেই কামবশে পীড়িত হন । ইন্দ্রের বীর্য ঋক্ষরজার বালে ( কেশে ) পতিত হয়, এবং সেই বীর্য থেকে উৎপন্ন পুত্রের নাম হয় বালী, আর সূর্যদেবের বীর্য পতিত হয় ঋক্ষরজার গ্রীবায় এবং সে বীর্য থেকে উৎপন্ন পুত্রের নাম হয় সুগ্ৰীব । বানররূপ ফিরে পেয়ে ঋক্ষরজা। তার দুই পুত্রকে নিয়ে ব্ৰহ্মার কাছে যায়। ব্ৰহ্মা তুষ্ট হয়ে এক দেবদূতের সাহায্যে তাদের কিষ্কিন্ধ্যার রাজপদে অভিষিক্ত করবার জন্য পাঠিয়ে দেন । ব্ৰহ্মার আজ্ঞায় ঋক্ষরজা পৃথিবীর সমস্ত বানরকুলের অধিপতি হন।