।৷ সাত ॥
আগের অনুচ্ছেদে পৃথু রাজার উল্লেখ করা হয়েছে। পৃথু বেণ রাজার পুত্র । বেদে পৃথুর উল্লেখ আছে, বেণ অত্যন্ত প্ৰজাপীড়ক রাজা ছিলেন । তাঁর শাসনকালে একের স্ত্রীতে অপরের উপগমন—এই পশুধৰ্ম প্রচলিত হয়। নিজে পুণ্যহীন হলেও পুত্ৰ পৃথুর পুণ্যের কল্যাণে তাঁর স্বর্গ লাভ ঘটে। ব্ৰহ্মা প্ৰমুখ দেবতারা পৃথুকে পৃথিবীর অধিপতি করেন। বেণের আমলে পৃথিবী খাদ্যশস্য ইত্যাদি দ্রব্য থেকে প্ৰজাবর্গকে বঞ্চিত করছিলেন। পৃথ, শরের সাহায্যে পৃথিবীকে আক্রমণ করে । পৃথিবী গো-রূপ ধারণ করে পালিয়ে যায়। পৃথ, তার পশ্চাদ্ধাবন করে। পলায়নে সক্ষম না হয়ে, পৃথিবী পৃথুর শরণাপন্ন হয় । তখন পৃথ, পৃথিবীকে বলেন- ‘তুমি আমার কন্যা হও, ও প্রজাদের জীবিকার ব্যবস্থা কর।’ পৃথিবী বলে যে এর জন্য তাকে দোহন করতে হবে, কিন্তু বৎস না হলে তার দুগ্ধ নিসৃত হবে না । অতঃপর স্বয়ম্বুব মনুকে বৎস কল্পনা করে, পৃথ, স্বহস্তে গো-রূপ পৃথিবীকে দোহন করে। এই দোহনের ফলে, প্ৰজার অন্নলাভ করে আজও জীবনধারণ করছে। মহাভারত অনুযায়ী পৃথু, পৃথিবীকে দোহন করে সপ্তদশ প্রকার শস্য উৎপাদন করেন। পৃথুর কন্যা বলেই পৃথিবী নামের উৎপত্তি ।
।। আট ।।
পুরূরবা ও উর্বশীর কথা আগেই বলেছি। এঁদের এক পুত্রের নাম আয়ু। আয়ুর পুত্ৰ নহুষ। নহুষের ছয় পুত্র, জ্যেষ্ঠ যযাতি নামে প্রসিদ্ধ। যযাতির কথা পরে বলছি । আগে নহুষের কথা বলে নিই। নহুষের কথা মহাভারতের আদি, বন ও শান্তিপর্বে ও পদ্মপুরাণে আছে। নাহুষ অতি পুণ্যবান ও বীর্যবান রাজা ছিলেন। সাধনা দ্বারা তিনি আত্মসংযম অভ্যাস করেছিলেন । ভোগবিলাসে নিরাসক্ত হয়ে, তিনি নিজেকে পুণ্যকর্মে এমনভাবে আত্মনিয়োগ করেন যে একবার ইন্দ্ৰ ব্ৰহ্মহত্যা ও মিথ্যাচারে বৃত্ৰাসুরকে বধ করে যখন জল মধ্যে আত্মগোপন করেন, তখন দেবতা ও মহৰ্ষিরা নহুষকে দেবরাজ করেন । ইন্দ্ৰত্ব পেয়ে নহুষ অত্যন্ত কামপরায়ণ ও অত্যাচারী হয়ে ওঠেন । সেজন্য মহর্ষিরা তাকে আসনচ্যুত করবার পরিকল্পনা করেন । একদিন মহৰ্ষিরা যখন নহুষকে শিবিকায় বহন করে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন একসময় তাঁরা শ্ৰান্ত হয়ে নহুষকে প্রশ্ন করেন, ‘বিজয়িশ্রেষ্ঠ, ব্রহ্ম যে গোপ্রন (যজ্ঞে গোবধ ) সম্বন্ধে বলেছেন, তা তুমি প্রামাণিক মনে কর কী না ?’ নহুষ মোহ বশে উত্তর দেন, ‘না, ওই মন্ত্র প্রামাণিক নয়।’ ঋষিরা বলেন, ‘তুমি অধর্মে নিরত, তাই ধৰ্ম বোঝ না । প্ৰাচীন মহর্ষিগণ ওই মন্ত্র প্রামাণিক মনে করেন, আমরাও করি ।’ গোবধ অস্বীকার করার দরুণ নহুষ অভিশপ্ত হয়ে ভূতলে পতিত হন। অপর এক কাহিনী অনুযায়ী ইন্দ্ৰত্ব পাবার পর নহুষ ইন্দ্রের স্ত্রী শচীকে স্ত্রীরূপে পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। শচী নহুষকে বলে যে ঋষিবাহিত শিবিকায় যদি নহুষ তাঁর কাছে আসেন, তবেই তিনি নহুষের অনুগামিনী হবেন । শিবিকায় যাবার সময় নহুষ ঋষিদের সঙ্গে মন্ত্র সম্বন্ধে তর্কবিতর্ক ও বিবাদ করতে থাকেন । ওই সময় অগস্ত্য ঋষির মাথায় তাঁর পা ঠেকে । এর ফলে অগস্ত্যের শাপে নহুষ সর্পরূপে বিশাখবনে পতিত হন । নহুষের করুণ প্রার্থনায় অগস্ত্য বলেন যে একদিন যুধিষ্ঠির তঁকে শাপমুক্ত করবেন।
।। নয় ।।
নহুষের ছেলে যযাতির দুই বিয়ে। এক স্ত্রী দেবযানী দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের মেয়ে, আর অপর স্ত্রী শৰ্মিষ্ঠা দৈত্যরাজ বৃষপর্বার মেয়ে । তার মানে ক্ষত্রিয় হয়ে, যযাতি বামুনের মেয়েকেও বিয়ে করেছিল, আবার দৈত্যের মেয়েকেও বিয়ে করেছিল। তবে শুক্রাচাৰ্য যখন দেবযানীর সঙ্গে যযাতির বিয়ে দিয়েছিল, তখন শর্ত করিয়ে নিয়েছিল যে যযাতি শৰ্মিষ্ঠার সঙ্গে সহবাস করতে পারবে না । কিন্তু ঋতুকাল উপস্থিত হলে, শৰ্মিষ্ঠার অনুনয়-বিনয়ে ও দেবযানীর অজ্ঞাতে যযাতি শৰ্মিষ্ঠার গর্ভে এক পুত্র উৎপাদন করেন । দেবযানী পিতা শুক্রাচার্যের কাছে গিয়ে স্বামী ও শমিষ্ঠার বিরুদ্ধে নালিশ করে। শুক্রাচার্য যযাতিকে দুৰ্জয় জরাগ্রস্ত হবার অভিশাপ দেন। তবে যযাতির অনুনয়ে বলেন যে যযাতি অন্যের দেহে নিজের জরা সংক্রামিত করতে পারবে । যযাতি পুত্রদের তার জরা গ্ৰহণ করতে বলেন। দেবযানীর গর্ভজাত দুইপুত্র ও শমিষ্ঠার গর্ভজাত প্ৰথম দুইপুত্র জরা গ্রহণে অস্বীকার করে। মাত্র শৰ্মিষ্ঠার কনিষ্ঠ পুত্র পুরু জরা গ্রহণ করে পিতাকে তার যৌবন দেয়। এক হাজার বৎসর ইন্দ্ৰিয় সম্ভোগের পর যযাতি পুরুকে আবার তার যৌবন ফিরিয়ে দেয় । তারপর কঠোর তপস্যা করে যযাতি স্বর্গ লাভ করে, কিন্তু নিজেকে অতি ধাৰ্মিক মনে করায়, ইন্দ্ৰ তাঁকে স্বর্গভ্ৰষ্ট করে অন্তরীক্ষে ফেলে দেন। যযাতির দৌহিত্ররা মাতামহের এই অবস্থা দেখে তঁদের পুণ্যবলে তাঁকে আবার স্বর্গে পাঠিয়ে দেয়।
যযাতির যে দৌহিত্রদের কথা বললাম, তারা হচ্ছে যযাতির মেয়ে মাধবীর পুত্ৰগণ । মাধবীর উপাখ্যান মহাভারতের উদ্যোগ পর্বে আছে। একবার বিশ্বামিত্রের শিষ্য গালব বিশ্বামিত্ৰকে গুরুদক্ষিণা দিতে চাইলে বিশ্বামিত্র বলেন, তিনি চাঁদের মত শুভ্ৰ এক কন্যা ও আটশত অশ্ব গুরুদক্ষিণা চান । গালব বিপদে পড়ে, রাজা যযাতির কাছে যায় । যযাতি তাঁর মেয়ে মাধবীকে গালবের হাতে দিয়ে বলেন যে অন্যান্য রাজারা এই মেয়ের শুদ্ধস্বরূপ গালবকে আটশত অশ্বদান করবেন । গালব মাধবীকে নিয়ে প্ৰথমে অযোধ্যার রাজা হর্যশ্বের কাছে যান । হর্যশ্ব মাধবীর গর্ভে বংশুমনা নামে এক পুত্র উৎপাদন করে গালবকে দুইশত অশ্ব দেন । এক ব্ৰহ্মজ্ঞ মুনির বরে মাধবীর কুমারীত্ব বজায় থাকে । তারপর গালব যথাক্রমে মাধবীকে কাশীরাজ দিবোদাস ও ভোজরাজ উশীনরের কাছে নিয়ে যায়। তাঁরা মাধবীর গর্ভে যথাক্রমে প্ৰতদািন ও শিবি-কে উৎপাদন করেন ও গালবকে প্ৰত্যেকে দুইশত অশ্ব দেন। পরে আর অশ্ব পাওয়া না যাওয়ায় গালব বিশ্বামিত্ৰকে ছয়শত অশ্ব ও মাধবীকে দান করেন। বিশ্বামিত্রের ঔরসে মাধবীর অষ্টক নামে এক পুত্র হয়। বিশ্বামিত্র তাকেই ধর্ম, অর্থ ও অশ্বগুলি দান করে মাধবীকে গালবের হাতে দিয়ে বনে গমন করেন । গালব মাধবীকে যযাতির হাতে ফিরিয়ে দেন। পরে যযাতি মাধবীর বিবাহের জন্য এক স্বয়ংবরা সভার আয়োজন করেন । কিন্তু মাধবী সকল রাজকে প্রত্যাখ্যান করে বনে গিয়ে ধর্মপালনে রত হয় ।