।। চাের ৷।
এবার আর এক বৈদিক কাহিনী বলব । সত্যকাম ও জবালার কাহিনী। এই কাহিনী ছন্দোগ্য উপনিষদের চতুর্থ প্ৰপাঠকে আছে। একদিন সত্যকাম বিদ্যার্থী হয়ে গৌতম ঋষির আশ্রমে উপস্থিত হয় । গৌতম তার পিতার নাম ও গোত্র জানতে চান । সত্যকাম বলে— ‘আমি জানি না, তবে মার কাছ থেকে জেনে আসি ।’ মা জবালা যৌবনে বহুচারিণী ছিলেন। সেই সময় তাঁর গভে সত্যকামের জন্ম হয় । সেজন্য তিনিও সত্যকামের পিতার নাম জানেন না । সত্যকাম মার কাছে এসে প্রশ্ন করলে, মা বলেন–‘তোমার পিতার নাম আমি জানি না । তুমি মহৰ্ষিকে বল, আমি জবালার পুত্র।’ সত্যকাম ফিরে এসে গৌতমকে সেই কথা বলে। তার সত্যবাদিতায় সন্তুষ্ট হয়ে গৌতম তাকে শিষ্যরূপে গ্ৰহণ করে। গৌতম বলেন– ‘ব্রাহ্মণ, তুমি সত্য হতে ভ্ৰষ্ট হও নি। ব্ৰাহ্মণ ভিন্ন কারুর পক্ষে এরূপ সত্যাচারণ কখনও সম্ভব নয় ।’
।। পাঁচ ।।
শ্বেতকেতুর কাহিনী আছে মহাভারতের আদিপর্বে । একদিন শ্বেতকেতু পিতা উদ্দালকের কাছে বসে থাকার সময় একজন ব্ৰাহ্মণ এসে তার মাকে ধরে নিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে যৌনমিলনে প্ৰবৃত্ত হয় । এই দেখে শ্বেতকেতু ক্রুদ্ধ হয় । কিন্তু উদালক তাকে ক্ৰোধ নিবারণ করতে বলেন,–এই বলে ‘স্ত্রীলোকেরা গাভীদের মত স্বাধীন। সহস্ৰ পুরুষে আসক্ত হলেও তাদের অধৰ্ম হয় না। ইহাই সনাতন ধর্ম।’ সেই থেকে শ্বেতকেতু মনুষ্য সমাজে বিবাহ প্রথার প্রচলন করে এবং বলে যে, স্ত্রী স্বামী ভিন্ন অপর পুরুষে উপগত হবে, সে মহাপাপে লিপ্ত হবে ।
মহাভারতের বনপর্বে রাজর্ষি শিবির কাহিনী আছে । একদিন এক ব্ৰাহ্মণ শিবির কাছে এসে বললেন, ‘আমি অন্নপ্রার্থী’, তোমার পুত্র বৃহদগর্ভকে বধ কর, তার মাংস, আর অন্ন পাক করে আমার প্রতীক্ষায় থাক ।’ শিবি তার পুত্রের পক্কমাংস একটি পাত্রে রেখে তা মাথায় নিয়ে ব্ৰাহ্মণের খোঁজ করতে লাগলেন। একজন তাকে বলল, ‘ব্ৰাহ্মণ ক্রুদ্ধ হয়ে আপনার গৃহ, কোষাগার, আয়ুধাগার, অন্তপুর, অশ্বশালা, হস্তিশালা দগ্ধ করছেন।’ শিবি আবিকৃতমুখে ব্ৰাহ্মণের কাছে গিয়ে বললেন, ‘ভগবন, আপনার অন্ন প্ৰস্তুত হয়েছে, ভোজন করুণ ৷’ ব্ৰাহ্মণ বিস্ময়ে অধোমুখ হয়ে রইলেন । শিবি আবার অনুরোধ করলে ব্ৰাহ্মণ বললেন, ‘তুমিই খাও।’ শিবি অব্যাকুলচিত্তে ব্ৰাহ্মণের আজ্ঞা পালন করতে উদ্যত হলেন । ব্ৰাহ্মণ তখন তাঁর হাত ধরে বললেন, ‘তুমি জিতক্ৰোধ, ব্ৰাহ্মণের জন্য তুমি সবই ত্যাগ করতে পার।’ শিবি দেখলেন, দেবকুমারতুল্য পুতগন্ধান্বিত অলঙ্কারধারী তাঁর পুত্র সম্মুখে রয়েছে। ব্ৰাহ্মণ অন্তর্হিত হলেন । তিনি স্বয়ং বিধাতা, রাজর্ষি শিবিকে পরীক্ষা করতে এসেছিলেন ।
।। ছয়।।
সমুদ্রমন্থনের উপাখ্যান রামায়ণের বালকাণ্ডে, মহাভারতের আদিকাণ্ডে ও পুরাণসমূহে আছে । তবে বিভিন্ন গ্রন্থে কাহিনীটির কিছু তারতম্য আছে। রামায়ণ অনুযায়ী অমৃত পান করে অজয়, অমর ও নিরাময় হবার উদ্দেশ্যে অসুর ও দেবতারা সমুদ্রমন্থনে প্ৰবৃত্ত হয়। তারা মন্দর পর্বতকে মন্থনদণ্ড ও বাসুকীকে মন্থন রাজ্জু করে ক্ষীরোদ সমুদ্র মন্থন করতে থাকে। প্ৰথমে বাসুকী বিষ বমন করে । দেবতারা ভীত হয়ে শিবের কাছে ছুটে যায়। শিব ওই বিষ পান করে নীলকণ্ঠ হন । আবার মন্থন আরম্ভ করলে মন্দর পর্বত পাতালে প্ৰবেশ করে । তখন বিষ্ণু কুৰ্মরূপ ধারণ করে মন্দর পর্বতকে পৃষ্ঠে ধারণ করে সাগরতলে শয়ন করেন । হাজার বছর মন্থনের পর ধন্বন্তরির আবির্ভাব হয় । তারপর ওঠে অসংখ্য অপ্সরাগণ ও বরুণের মেয়ে বারুণী বা সুরা । এরপর ওঠে উচ্চৈশ্ৰবা অশ্ব, ও কৌস্তভমনি। সবশেষে ওঠে অমৃত । অমৃতের অধিকার নিয়ে দেবাসুরে ঘোর সংগ্ৰাম হলো, বিষ্ণু মোহিনীরূপ ধারণ করে, ওই অমৃত হরণ করেন । বহু বৎসর যুদ্ধের পর দেবতারা জয়ী হন ও ইন্দ্ৰ ত্ৰিলোকের অধিকারী হন ।
মহাভারত অনুযায়ী ব্ৰহ্মার আদেশে দেবতা ও অসুরগণ সমুদ্রমন্থনে প্ৰবৃত্ত হন । সমুদ্র থেকে ক্ৰমান্বয়ে চন্দ্ৰদেব ও ঘৃত হস্তে লক্ষ্মী, সুরাদেবী, উচ্চৈশ্ৰবা ও কৌস্তভমনি ওঠে। সবশেষে অমৃতভাণ্ড হাতে ধন্বন্তরি ও পরে গজরাজ ঐরাবত ওঠে। কৌস্তভমনি নারায়ণ এবং উচ্চৈশ্ৰবা ও ঐরাবত ইন্দ্র গ্রহণ করেন। এর পরে ওঠে কালকূট বিষ । মহাদেব তা পান করে নীলকণ্ঠ হন । অমৃত ও লক্ষ্মীর অধিকার নিয়ে দেবাসুরের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ হয় । নারায়ণ মোহিনীরূপ ধারণ করে, অসুরদের মোহিত করেন । তারপর দেবগণ নারায়ণের হাত থেকে ওই অমৃত গ্ৰহণ করে পান করে । এই সময় রাহু নামে এক দানব দেবতার ছদ্মবেশে অমৃতের কিছু অংশ পান করে। কিন্তু সে গলাধঃকরণ করবার আগেই নারায়ণ সুদৰ্শন চক্র দ্বারা তার কণ্ঠচ্ছেদ করেন ।
যদিও বায়ু ও মৎস্য পুরাণে সমুদ্রমন্থনের উপাখ্যানটা অনুরূপ কাঠামোর ভিত্তিতে রচিত, তা হলেও কোন কোন পুরাণ অনুযায়ী পৃথুরাজার উপদেশে ধরীত্রীকে গাভীরূপ করে, তা থেকে অমৃত উৎপন্ন করে । তারপর দুর্বাসার অভিশাপে ওই অমৃত সমুদ্রগর্ভে পতিত হয় । দেবতারা তখন বিষ্ণুর শরণাপন্ন হয়। তখন বিষ্ণু নিজে কুৰ্মরূপ ধারণ করে মন্দর পর্বতকে পৃষ্ঠে ধারণ করলে দেবতারা বাসুকীকে মন্থনরজ্জ্বরূপে ব্যবহার করে সমুদ্রমন্থন করে অমৃত উদ্ধার করে ।