মনু ও শতরূপার কন্যা প্ৰসূতি, প্ৰজাপতি দক্ষের ভার্যা হন । দক্ষ ও প্ৰসূতির সতী নামে এক কন্যা হয় । দক্ষ শিবের সঙ্গে তার বিবাহ দেন । কিন্তু শিব কোনদিন তাকে যথোচিত সম্মান দেখাতে পারেন নি মনে করে, দক্ষ শিবের ওপর খুব বিরূপ হন। দক্ষ এক মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান করে, সকলকে নিমন্ত্রণ করেন, কিন্তু শিব ও সতীকে নিমন্ত্রণ করেন না । সতী এই যজ্ঞে যাবার জন্য ব্যগ্র হয়ে পড়েন । শিব বাধা দেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সতী পিতৃগৃহে যান। সেখানে যজ্ঞস্থলে পিতার মুখে শিবনিন্দা শুনে, সতী পিতার সম্মুখেই দেহত্যাগ করেন। শিব খবর পেয়ে তার অনুচরদের নিয়ে যজ্ঞস্থলে এসে উপস্থিত হন । দক্ষযজ্ঞ তিনি পণ্ড করে দেন ও দক্ষের মুগুচ্ছেদ করে। দক্ষপিতা ব্ৰহ্মার অনুরোধে শিব দক্ষকে প্ৰাণদান করেন বটে, কিন্তু তার নিজ মুণ্ডের বদলে ছাগমুণ্ড দেন। তারপর শিব সতীর শোকে কাতর হয়ে, সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে প্ৰলয় নাচন শুরু করেন । সৃষ্টি ধ্বংস হবার উপক্রম দেখে, বিষ্ণু নিজ চক্রদ্বারা সতীর দেহ খণ্ড বিখণ্ড করে দেন। যে যে জায়গায় সতীর দেহাংশ পড়ে, পরবর্তীকালে তা মহাপীঠ নামে খ্যাত হয় । এই ভাবে একান্ন মহাপীঠের উৎপত্তি হয় ।
মনুর উল্লেখ আগেই করেছি। ব্ৰহ্মার দেহ থেকে উদ্ভূত বলে এর নাম স্বয়ম্ভুব মনু । শতরূপার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। এদেরই পুত্রকন্যা থেকে মানব জাতির বিস্তার হয় । সত্য, ত্ৰেতা, দ্বাপর ও কলি-এই চার যুগে চতুৰ্দশ মনু জন্মগ্রহণ করেন। এক এক মনুর অধিকার কালকে ‘মন্বন্তর’ বলা হয় ৷ এক মন্বন্তর শেষ হলে, দেবতা ও মনুপুত্ররা বিলুপ্ত হন । আবার নূতন দেবতা ও মানুষের সৃষ্টি হয় ।
।। দুই ॥
দক্ষ রাজার অন্যতম কন্যা অদিতি হতে কশ্যপের ঔরসে বিবস্বানের জন্ম হয়। স্ত্রী সংজ্ঞার গর্ভে বিবস্বানের বৈবস্বত মনু নামে এক পুত্র হয় । বৈবস্বত মনু বদরিকাশ্রমে তপস্যা শুরু করেন। একদিন এক ক্ষুদ্র মৎস্য এসে বৈবস্বত মনুকে বলে ‘আপনি আমাকে বলবান মৎস্যদের হাত থেকে রক্ষা করুন । মনু তাকে এক জালার মধ্যে রাখেন । মাছটি বড় হলে তাকে এক পুষ্করিণীতে রাখেন। তারপর আরও বড় হলে নদীতে ছেড়ে দেন । নদীতেও তার স্থান সন্ধুলান না হওয়ায়, তাকে সমুদ্রে স্থান দেন। একদিন এই মৎস্য মনুকে বলে–‘এখন প্ৰলয়কাল আসন্ন, সবই জলে ডুবে যাবে। আপনি শক্ত রজ্জ্বযুক্ত একখানা নৌকায় সপ্তর্ষিদের নিয়ে বসুন। আমি শৃঙ্গদ্বারা আপনাকে পৰ্বতশৃঙ্গে নিয়ে যাব।’ এইভাবে মনু ও বেদদ্রষ্টা ঋষিরা রক্ষা পান। প্লাবনের পর মানুষের পালনীয় আচার ব্যবহার ও ক্রিয়া কলাপের যথাকর্তব্য নির্ধারণ করে, মনু একখানা সংহিতা প্ৰণয়ণ করেন । সেটাই হচ্ছে মনুসংহিতা ।
পৃথিবীতে দুই রাজবংশ সৃষ্টি হয়—চন্দ্রবংশ ও সূর্যবংশ । চন্দ্রবংশের দুই শাখা–পুরুবংশ ও যদুবংশ । পুরুবংশের এক বিখ্যাত রাজা হচ্ছেন দুষ্মন্ত । একদিন মৃগয়া করতে গিয়ে শ্রান্ত হয়ে তিনি মালিনী নদীর তীরে কন্বমুনির আশ্রমে এসে উপস্থিত হন । সেখানে কন্বমুনির পালিত কন্যা শকুন্তলার সঙ্গে তার প্রণয় হয়। গন্ধৰ্বমতে তিনি শকুন্তলাকে বিবাহ করেন। তঁদের এক বলশালী পুত্র হয়। এই পুত্রের নাম ভরত। ভারতের নাম থেকেই আমাদের দেশের নাম ভারতবর্ষ হয়েছে। ভারতবর্ষ জম্বুদ্বীপের এক অংশ। জম্বুদ্বীপ পৃথিবীর সপ্তদ্বীপের অন্যতম। বাকী ছয়টি দ্বীপ হচ্ছে-প্লক্ষ, শাল্মলী, কুশ, শাক ও পুষ্কর।
।। তিন ।।
দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার উল্লেখ বৈদিক সাহিত্যে আছে । বৈদিক সাহিত্যে আরও আছে পুরূরবা ও উর্বশীর কথা । শতপথব্রাহ্মণ অনুযায়ী একবার চন্দ্ৰ বৃহস্পতির স্ত্রী তারাকে হরণ করে নিয়ে যায়। তারার গর্ভে চন্দ্রের এক পুত্র হয়। এই পুত্রের নাম বুধ । বুধের সঙ্গে ইলার বিবাহ হয়। ইলার গর্ভে বুধের পুরূরবা নামে এক পুত্র হয়। একবার ইন্দ্ৰসভায় রাজা পুন্ধর বা আহুত হন। সেখানে তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে উৰ্বশী নাচতে নাচতে তার দিকে তাকায় । এতে উর্বশীর তালভঙ্গ হয় । ফলে, ইন্দ্রের শাপে উৰ্বশীকে মর্ত্যে এসে বাস করতে হয় । মর্ত্যে কয়েকটি শর্তে উৰ্বশীর সঙ্গে পুরূরবার মিলন হয়। শর্তগুলি হচ্ছে(১) উর্বশীর সামনে পুরস্কারবা কোনদিন বিবস্ত্র হবেন না, (২) পুরূরবা দিনে তিনবার উর্বশীকে আলিঙ্গন করতে পারবেন। কিন্তু তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সঙ্গম করতে পারবেন না, ও (৩) উৰ্বশী বিছানায় দুটি মেষ নিয়ে শয়ন করবে এবং কেউ ওই মেষ হরণ করতে পারবে না । এইভাবে উর্বশী ও পুরূরবা বহুবৎসর পরম সুখে বসবাস করে। এদিকে স্বগের গন্ধৰ্বোরা উর্বশীকে স্বর্গে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায় । একদিন বিশ্ববসু নামে এক গন্ধৰ্ব উর্বশীর মেষ দুটি হরণ করে । উৰ্বশী কেঁদে উঠলে, পুরূরবা বিবস্ত্র অবস্থাতেই মেষ দুটি উদ্ধারের জন্য বিশ্ববসুর পিছনে ছুটে যান। সেই সময় আকস্মিক বজ্রপাতের বিদ্যুতালোকে উর্বশী পুরূরিবাকে বিবস্ত্র দেখে তাকে ত্যাগ করে চলে যান । পুরূরবা উর্বশীর সন্ধানে দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ান। একদিন কুরুক্ষেত্রের কাছে চারজন অপসারীর সঙ্গে উর্বশীকে স্নানরতা দেখে, তাকে ফিরে যাবার জন্য কান্নাকাটি করেন । অনেক অনুনয়-বিনয়ের পর উর্বশী এক শর্তে রাজী হন । প্ৰতি বৎসর মাত্র একদিন এসে তিনি পুরূরবার সঙ্গে মিলিত হবেন, এবং তাতেই তঁদের পুত্রসন্তান হবে। এইভাবে মিলিত হয়ে তাঁদের পাঁচটি সন্তান হয়। তারপর উর্বশী পুরূরবাকে জানান যে স্বগের গন্ধৰ্বরা তাকে যে কোন বর দিতে প্ৰস্তুত । পুরূরবা উর্বশীর সঙ্গে চিরজীবন যাপন করতে চান । গন্ধর্বরা পুন্ধরবাকে গন্ধৰ্বলোকে স্থান দেয়। এইভাবে পুন্ধর বা উর্বশীর চিরসঙ্গী হয়ে থাকেন।