শিব অনার্য দেবতা। তার প্রতিরূপ আমরা প্রাকবৈদিক সিন্ধু সভ্যতায় পাই । পৌরাণিক যুগে তিনি বৈদিক রুদ্রের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যান । তিনি সংহারকর্তা, সেজন্য তাঁকে মহাকাল বলা হয় । তবে সংহারের পর তিনি নূতন করে আবার জীব সৃষ্টি করেন। সেজন্য তিনি লিঙ্গরূপে পূজিত হন। তিনি প্ৰথমে দক্ষ রাজার কন্যা সতীকে বিবাহ করেছিলেন, পরে হিমালয় রাজার কন্যা হৈমবতী বা পাৰ্বতীকে । তাঁদের পুত্ৰ কাৰ্তিক দেবতাদের সেনাপতি । তাদের অপর পুত্ৰ গণেশ ও কন্যাদ্ধয় লক্ষ্মী ও সরস্বতী । বৃষভ শিবের বাহন, নন্দী ও ভূঙ্গী তার দুই অনুচর। কুবের তার ধনরক্ষক। কৈলাস তাঁর নিবাস ।
পৌরাণিক যুগের দেবতামণ্ডলীর বৈশিষ্ট্য স্ত্রী দেবতাগণের প্রাধান্য । বৈদিক দেবতাগণের স্ত্রী ছিল বটে, কিন্তু দেবতামণ্ডলীতে তাদের কোন আধিপত্য ছিল না । কিন্তু পৌরাণিক যুগে স্ত্রী দেবতাগণই হন পুরুষদেবতাগণের শক্তির উৎস। শিবজায়া দুৰ্গা এগিয়ে আসেন ‘দেবী’ হিসাবে দেবতা মণ্ডলীতে সৰ্বোচ্চ স্থান অধিকার করতে। তাঁর আঁচল ধরে আসেন অনার্য সমাজের সেই সমস্ত স্ত্রী দেবতা ( যথা শীতলা, মনসা, ষষ্ঠী ইত্যাদি ) যাঁরা আগে লুকিয়ে ছিলেন গাছপালায়, ঝোপজঙ্গলে ও পর্বত-কন্দরে ।
।। চার ।।
এবার আমাদের আলোচনা করা যাক দেবতাদের নিবাসস্থল সম্বন্ধে। তার মানে স্বর্গ বা দেবলোক কোথায় ছিল । আগেই বলেছি যে ঋগ্বেদে ‘স্বর্গ”-এর কোন কথা নেই। পুরাণেই স্বর্গের কথা আছে, এবং সেটাকেই দেবতাদের নিবাসস্থল বলা হয়েছে । কিন্তু এ স্বর্গটা কোথায় ? স্বাগটা আকাশের দিকে, না পৃথিবীতে ? স্বর্গ সম্বন্ধে পুরাণ থেকে যে সকল তথ্য সংগ্ৰহ করা যেতে পারে, সে গুলিই আমি প্রথম এখানে স্থাপন করছি। পুরাণ মতে সুমেরু পর্বতে বিশ্বদেব ও মরুদগণ বাস করতেন । এর শিখরেই ছিল বরুণালয় । ইন্দ্রের আলয় ও রাজধানী অমরাবতীও অবস্থিত ছিল সুমেরু পর্বতে । আমরাবতীর ভিতর দিয়ে প্রবাহিত ছিল অলকানন্দ নদী । সুতরাং সুমেরু পৰ্বত ও অলকানন্দার অবস্থান যদি আমরা নির্ণয় করতে পারি, তা হলে দেবতাদের বাসভূমি দেবলোকের আমরা হদিশ পাব।
বদরিকাশ্রমের পর যে পার্বত্য ভূভাগ অবস্থিত, তাকে বলা হত হৈমবতবৰ্ষ । বদরিকাশ্রমের ঠিক পরেই যে পৰ্বতশ্রেণী ছিল, তার নাম পুরাণে নৈষধ পর্বত। এর পশ্চিমাংশে ছিল হেমকূট পৰ্বতশ্রেণী, আর উত্তরে ক্রমান্বয়ে গন্ধমাদন ( মন্দর ), সুমেরু এবং সর্বশেষ নীল পর্বত । হেমকূট পৰ্বতশ্রেণীর পরেই ছিল কৈলাস পর্বত, তারপর মৈনাক পৰ্বত । এর পররর্তী অঞ্চলে দুটি সমৃদ্ধশালী দেশ ছিল—একটি কেতুমাল ও অপরটি উত্তরকুরু। এই অঞ্চলকে বলা হত হরিবর্ষ। সুমেরু পর্বতের পাশে ছিল ভদ্রাশ্ব, কেতুমাল, জম্ব এবং উত্তর কুরু । কেদারনাথ তীৰ্থ তিনদিকে সুমেরু পর্বতদ্বারা বেষ্টিত ছিল।
এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে তিব্বত দেশের উত্তর ও চীন দেশের পশ্চিমস্থ পর্বতশ্রেণীকেই সুমেরু পর্বত বলা হত । অলকানন্দা গঙ্গোত্রীর কাছে গঙ্গার চারধারার মধ্যে একটি । অমরাবতীর মধ্য দিয়েই অলকানন্দ প্ৰবাহিত হত, এবং এর দক্ষিণ তীরেই বন্দ্রিনাথ তীর্থ অবস্থিত। গঙ্গোত্রীর ভৌগলিক অবস্থান হচ্ছে ৩০°৫৯ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৭৮°৫৯ উত্তর-পূর্ব দ্রাঘিমায়। এর উচ্চতা ৩৪৪১ মিটার। বন্দ্রিনাথ অঞ্চলের চৌখাম্বা (উচ্চতা ৭,৬৪৬ মিটার) শিখর হতে উদ্ভূত গঙ্গোত্রী হিমবাহের উত্তর পশ্চিমে যে স্থান হতে পূর্ব হিমবাহ গলে গঙ্গা নদীরূপে প্ৰকাশিত হত, সেই স্থানটিই গঙ্গোত্রী নামে খ্যাত । এখান হতেই গঙ্গার অপর উৎসমুখ অলকানন্দ প্রবাহিত । ইহা ভারতের অন্যতম দীর্ঘ হিমবাহ। এই হিমবাহের নিকটেই কেদারনাথ শৃঙ্গ ( উচ্চতা ৬৯৪০ মিটার ) ও এর বামদিকে শিবলিঙ্গ পর্বতমালা । কেদারনাথ তীৰ্থ ( উচ্চতা ৩,৫২৫ মিটার ) চামোলি জেলার উখিমঠ মহকুমায় অবস্থিত। হৃষীকেশ হতে বাসে ১৭৯ কিলোমিটার নেমে কুণ্ডচটি। সেখান থেকে হাঁটাপথে ৫১ কিলোমিটার দূরে ত্রিযুগীনারায়ণ । ত্রিযুগীনারায়ণ হয়ে কেদারনাথ তীর্থে যেতে হয়।
কৈলাস পর্বত মহাদেব ও কুবেরের বাসস্থান। কৈলাসের উচ্চতা ৬৭১৪ মিটার। লিঙ্গাকৃতি এই শিখরটি দক্ষিণ-পশ্চিম তিব্বতে, লাসা হতে কাংরিম পোচে । মহাভারতে (৬।৭।৩৯) কৈলাসকে হেমকুট বলা হয়েছে। কৈলাসের ২৬ কিলোমিটার দক্ষিণে মানসসরোবর। এই মানস সরোবরের উত্তর তীরস্থ পর্বতেই ইন্দ্রের সঙ্গে বৃত্রের একশত বৎসর ধরে যুদ্ধ চলেছিল।
উপরের আলোচনার প্রেক্ষিতেই আমি কতগুলো জায়গার অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমা দিচ্ছি। এ থেকেই দেবলোকের ও কৈলাসের অবস্থান বুঝতে পারা যাবে।
কেদারনাথ ৩০°৪৪’ উত্তর অক্ষাংশ ৭৯°৬৩ পূর্ব দ্রাঘিমা ।
গঙ্গোত্ৰী ৩০°৫৬ উত্তর অক্ষাংশ ৭৯°০২ পূর্ব দ্রাঘিমা ।
বদ্রিনাথ ৩০°০০ উত্তর অক্ষাংশ ৭৯°৩০ পূর্ব দ্রাঘিমা ।
মানস সরোবর ২৬°১৩ উত্তর অক্ষাংশ ৯০°৩৮ পূর্ব দ্রাঘিমা ।
মানস সরোবরের ২৬ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে কৈলাস ।
এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে দেবলোক বা স্বর্গ অন্তরীক্ষে কোন জায়গায় নয়। ইহজগতে হিমালয়ের উত্তরাংশে । এটা অন্য কয়েকটি কাহিনীর দ্বারাও সমর্থিত। মহাভারতের মহাপ্ৰস্থনিক পর্ব অনুযায়ী যুধিষ্ঠির হিমালয়েরই অপর প্রান্তে অবস্থিত ‘স্বর্গে’ গিয়েছিলেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের মনসামঙ্গল কাব্যসমূহ অনুযায়ীও বেহুলা তার মৃত স্বামীকে বাঁচাবার জন্য নদীপথে গিয়ে নেতা ধোবানীর সাহায্যে স্বর্গে গিয়েছিল । সুতরাং এই কাহিনী অনুযায়ী স্বর্গ ইহলোকেরই কোন জায়গায় অবস্থিত ছিল, নদীপথে যেখানে যাওয়া যেত। তা ছাড়া, স্বর্গের অপ্সরারা উত্তর ভারতে হিমালয়ের সানুদেশের কোন না কোন সরোবরে প্রায়ই স্নান করতে আসত । পুরুরবা যখন উর্বশীর সন্ধানে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, তখন তিনি কুরুক্ষেত্রের কাছে চারজন অপ্সরার সঙ্গে উর্বশীকে স্নান করতে দেখেছিলেন ।
পৌরানিক উপাখ্যান
পুরাণসমূহের পঞ্চলক্ষ্মণের মধ্যে এক লক্ষণ হচ্ছে সর্গ । সৰ্গ মানে সৃষ্টি । সব পুরাণেই সৃষ্টি প্রকরণ বর্ণিত হয়েছে। এই বর্ণনা অনুযায়ী ব্ৰহ্মা প্ৰথমে সনৎকুমার, সনন্দ, সনক, সনাতন ও বিভু, এই পাঁচ ঋষিগণকে সৃষ্টি করেন। কিন্তু তাঁরা ঊর্ধ্বরেতা থাকায় প্ৰজাসৃষ্টি হল না। তখন ব্ৰহ্মা নিজেকে দুইভাগে বিভক্ত করেন। তাঁর এক অংশ পুরুষ ও অপর অংশ স্ত্রী হল। তিনি পুরুষের নাম দিলেন মনু, আর স্ত্রীর নাম দিলেন শতরূপা । তারা পরস্পর বিবাহিত হয়ে ব্ৰহ্মাকে জিজ্ঞাসা করল–‘পিতঃ কোন কর্মের দ্বারা আমরা আপনার যথোচিত সেবা করব ?’ ব্ৰহ্মা বললেন–‘তোমরা মৈথন কর্মদ্বারা প্ৰজা উৎপাদন কর । তাতেই আমার তুষ্টি।’ তখন থেকে মৈথন কর্মের প্রবর্তন হল ।