যদি সূক্তসংখ্যার দিক দিয়ে বিচার করা হয়, তা হলে বলতে হবে যে ইন্দ্ৰই ছিলেন ঋগ্বেদের যুগে আর্যদের প্রধান দেবতা। ঋগ্বেদের মোট সূক্তসংখ্যা হচ্ছে ১০১৭। তার মধ্যে ন্যূনাধিক ২৫০ সূক্ত তার উদ্দেশ্যে নিবেদিত । মূলতঃ নৈসৰ্গিক দেবতা হলেও তিনি মনুষ্যরূপে কল্পিত। তিনি যোদ্ধাশ্রেষ্ঠ । আর্যদের তিনি রক্ষক। তিনি আর্যদের শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করেন । তিনি দুটি হরিৎবৰ্ণ অশ্বদ্বারা পরিচালিত স্বর্ণরথে আরোহণ করেন । তিনি সোমরস পান করতে ভালবাসেন । ঋগ্বেদের বর্ণনা অনুযায়ী তার প্রধান কৃতিত্ব তিনি বৃত্ৰকে সংহার করে মেঘ হতে বারিবর্ষণের পথ উন্মুক্ত করেছিলেন, তিনি শত্রুদের দুর্গ সমন্বিত নগরগুলি ধ্বংস করে তাদের বিনাশ সাধন করেছিলেন, এবং বিশ্বস্থিতির জন্য তিনি কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন ।
ঋগ্বেদে অগ্নির উদ্দেশ্যে প্ৰায় ২০০ সূক্ত আছে। সুতরাং ইন্দ্রের পরেই অগ্নি আর্যদের দ্বিতীয় প্রধান দেবতা ছিল । যদিও অরণীর সাহায্যে তিনি উৎপন্ন, তা হলেও মনুষ্যরূপে তিনি কল্পিত । তিনি যজ্ঞের ঋত্বিক, পুরোহিত ও হোতা । অগ্নিই দেবতাদের যজ্ঞে আনয়ন করেন । তাঁর নানারূপ । তিনি কখনও জাতিবেদ্য, কখনও রক্ষোহা, কখনও দ্রবিনোদ, কখনও তমুনপাদ, কখনও নরাশংস, কখনও অপানেপৎ, এবং কখনও মাতরিস্বন । ঘূত ও কাষ্ঠ তাঁর আহার্য । হব্য তাঁর পানীয় ।
ঋগ্বেদে সূর্যকেও মনুষ্যরূপে কল্পনা করা হয়েছে । তিনি হরিৎবর্ণের সাতটি বেগবান অশ্ববাহিত রথে চলাফেরা করেন । বিশ্বভুবন এবং সমস্ত প্ৰাণিবর্গ সূর্যের আশ্রিত । তিনি মনুষ্য ও পশুর রোগ নিরাময় করেন ।
পুষ্য রথিশ্রেষ্ঠ। তিনিই সূর্যের হিরন্ময় রথচক্ৰ পরিচালনা করেন। রাত্রি তাঁর পত্নী ৷ ঊষা তার ভগিনী ।
ঋগ্বেদে আরও অনেক দেবতার উল্লেখ আছে। তাদের মধ্যে বিষ্ণু, যম, বৃহস্পতি ও সোম-এর নাম করা যেতে পারে। ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের ১৫ সূক্তে বলা হয়েছে যে, বিষ্ণু তিন পদক্ষেপে সমগ্র ভুবনে অবস্থিতি করেন । বিষ্ণু ঋতুর নিয়ামক দেবতা ।
যম পিতৃলোকের রাজা । দু’টি কুকুর নিয়ে তিনি পিতৃলোকের দ্বারে পাহার দেন । ।
বৃহস্পতি মন্ত্র উৎপাদন করেন। বৃহস্পতি প্ৰভূত প্রজ্ঞাবান । তিনি শক্ৰদের অভিভূত করেন ও তাদের নগরসকল বিদীর্ণ করেন । তার মানে তিনি ইন্দ্রের অনুরূপ আচরণ করেন ।
সোম পার্বত্য অঞ্চলের লতাবিশেষ। সোমলতাকে ধুয়ে, পাথরে পিষে, তার রস বের করে দুধ বা দধির সঙ্গে ব্যবহার করা হত। সোম ইন্দ্রের শক্তিবৰ্দ্ধন করত। দেবতাদের ও আর্যদের এটা একটা প্রিয় পানীয় ছিল । নবম মণ্ডলের সবকটি সূক্তই সোমের উদ্দেশ্যে রচিত । সপ্তম মণ্ডলের ১০৪ সূক্তে ও দশম মণ্ডলের ৮৫ সূক্তে সোমকে দ্যুস্থানের দেবতাও বলা হয়েছে ।
ঋগ্নেদের আর একজন বড় দেবতা হচ্ছেন বরুণ । বহুস্থলে মিত্র ও বরুণ একত্রে মিত্ৰাবারুণ নামে উল্লিখিত হয়েছেন । মিত্র ছিলেন আলোকের দেবতা, আর বরুণ আবরণকারী দেবতা । আর্যরা আকাশকে সমুদ্রের সঙ্গে কল্পনা করে জলময় মনে করতেন । এইজন্য ঋগ্বেদে আকাশ ও সমুদ্রের মিলন রেখাতে বরুণের অবস্থিতি কল্পনা করা । হয়েছে। বরুণ সূর্যের গমনের পথ বিস্তার করেন । ইনি বৃষ্টির দ্বারা পৃথিবী, অন্তরীক্ষ ও স্বর্গকে আদ্র করেন। এক কথায় বরুণ জলের দেবতা ৷
।। তিন ।।
বৈদিক দেবতামণ্ডলী পশ্চাদপটে হটে যান পৌরাণিক যুগে । লোকে আর ইন্দ্রকে প্রধান দেবতা হিসাবে পূজা করে না । পৌরাণিক যুগের তিন প্রধান দেবতা হচ্ছেন ব্ৰহ্মা, বিষ্ণু, ও মহেশ্বর। ইন্দ্ৰ এই তিন শক্তির অধীন, তিনি অপর দেবতাদের ওপর কর্তৃত্ত্ব করেন বলে, পৌরাণিক কাহিনী সমূহে তাকে দেবরাজ বলা হয়েছে। তাছাড়া, বৈদিক দেবতাদের নিয়ে পৌরাণিক যুগে বহু কাহিনী রচিত হয়েছিল।
পৌরাণিক যুগের তিন দেবতার মধ্যে ব্ৰহ্মা হচ্ছেন স্রষ্টা, বৈদিক যুগের হিরণ্যগৰ্ভ প্রজাপতির সামিল। বিষ্ণু হচ্ছেন রক্ষক, আর শিব সংহারকার্তা ।
পৃথিবীতে একবার মহাপ্ৰলয় ঘটেছিল। ওই মহাপ্রলয়ের শেষে জগৎ যখন অন্ধকারময় ছিল, তখন বিরাট মহাপুরুষ পরম ব্ৰহ্ম নিজের তেজে সেই অন্ধকার দূর করে জলের সৃষ্টি করেন। সেই জলে তিনি সৃষ্টির বীজ নিক্ষেপ করেন। ওই বীজ সুবৰ্ণময় অণ্ডে পরিণত হয়। অণ্ড মধ্যে ওই বিরাট মহাপুরুষ স্বয়ং ব্ৰহ্মা রূপে অবস্থান করতে থাকেন। তারপর ওই অণ্ড দুভাগে বিভক্ত হলে, একভাগ আকাশে ও অপর ভাগ পৃথিবীতে পরিণত হয়। এরপর ব্ৰহ্মা, মরীচি, অত্ৰি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্ৰতু, বশিষ্ট, ভৃগু, দক্ষ ও নারদ, এই দশজন প্ৰজাপতিকে মন থেকে উৎপন্ন করেন । এই সকল প্ৰজাপতি থেকে সকল প্ৰাণীর উদ্ভব হয় ।
ব্ৰহ্মা চতুর্ভূজ, চতুরানন ও রক্তবর্ণ। হংস তার বাহন। সরস্বতী তাঁর স্ত্রী । দেবসেনা ও দৈত্যসেনা তাঁর দুই কন্যা ।
শ্ৰীমদ্ভাগবত অনুযায়ী পঞ্চম (রৈবত ) মন্বন্তরে বিষ্ণু শুক্রের ও তাঁর স্ত্রী বৈকুণ্ঠার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। তার স্ত্রী লক্ষ্মীর ইচ্ছায় তিনি তাঁর নিবাস বৈকুণ্ঠলোক নির্মাণ করেন। পৌরাণিক যুগে বিষ্ণুর অবতারবাদের সৃষ্টি হয়। এই অবতারবাদের সাহায্যে তিনি রাম ও কৃষ্ণ থেকে অভিন্ন হন। গরুড় বিষ্ণুর বাহন।