স্থানে স্থানে অসংগতি থাকলেও পুরাণগুলির ঐতিহাসিক মূল্য যথেষ্ট ।
দেবলোকের পরিচিতি
গোড়াতেই দেবলোকের একটা পরিচিতি দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। সংক্ষেপে, দেবতারা যেখানে বাস করতেন, সেটাই দেবলোক । পরবর্তীকালে আমরা দেবলোককে ‘স্বৰ্গ’ আখ্যা দিয়েছি । কিন্তু হিন্দুর সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থে ঋগ্বেদে দেবতাদের আবাসস্থল হিসাবে ‘স্বৰ্গ’-এর কোন উল্লেখ নেই। বস্তুতঃ যুগে যুগে দেবলোকের অবস্থান ও তার বাসিন্দাদের নামধাম ও চরিত্র পালটে গেছে। ঋগ্বেদের যুগে দেবতাদের বাসস্থান ছিল তিন জায়গায়। পৃথিবীতে, অন্তরীক্ষে ও দ্যুস্থানে। পৃথিবীর দেবতাদের মধ্যে ছিলেন অগ্নি, সোম, পৃথিবী, অপ্ ও সরস্বতী । অন্তরীক্ষের দেবতাদের মধ্যে ছিলেন ইন্দ্ৰ, পর্জন্য ও রুদ্র, আর দ্যুস্থানের দেবতাদের মধ্যে ছিলেন সূৰ্য, সবিতা, পুষা, বরুণ, দ্যু, অশ্বিণীদ্বয়, ঊষা, রাত্রি, যম ও বৃহস্পতি । পরবর্তী কালে শিব ও কুবেরের বাসস্থান ছিল কৈলাসে। আর অন্যান্য সব দেবতাদের নিবাস ছিল স্বৰ্গে। দেবতা ছাড়া, স্বর্গে আরও বিচরণ করত গন্ধৰ্ব, অপ্সরা, যক্ষ, কিন্নর ইত্যাদি।
পরবর্তীকালে স্বর্গলোকটা আকাশের দিকে বা নভোমণ্ডলের কোন জায়গায় ছিল বলে মনে করা হত। এই কল্পনায় বশীভূত হয়েই জার্মান লেখক এরিখ ফন দানিকেন ও তাঁর অনুগামী ইংরেজ লেখক আর. কে. জি. টেমপাল এক মতবাদ খাড়া করেছেন যে নভোমণ্ডলের অন্য গ্ৰহ থেকেই দেবতারা মর্ত্যে এসেছিলেন । ওই মতবাদের পিছনে যে কোন যুক্তি নেই, তা আমি ১৯৭৬ খ্ৰীষ্টাব্দের ২১ নভেম্বর তারিখের ‘সানডে’ পত্রিকায় লিখেছিলাম। তাঁরা বলেছিলেন যে ‘সিরিয়াস’ ( Sirius ) নামক নক্ষত্র থেকে আফ্রিকার জাতিবিশেষ মর্ত্যে অবতরণ করেছিল । তারই প্ৰতিবাদে আমি লিখেছিলাম–বস্তুতঃ যতক্ষণ না দানিকেন বা তাঁর অনুগামীরা প্ৰমাণ করতে পারছেন যে, যে গ্ৰহ থেকে দেবতারা মর্ত্যলোকে এসেছিলেন সে গ্রহের তাপমাত্রা ও আবহাওয়ার অন্যান্য লক্ষণ মানুষের প্রাণ ধারণের পক্ষে অনুকুল, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁদের মতবাদের কোন বৈজ্ঞানিক মূল্য নেই। বস্তুতঃ হিন্দুর দেবতাদের যে ভাবে বিবর্তন ঘটেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতেও দানিকেনের মতবাদ গ্ৰহণ করা চলে না। ঋগ্বেদের যুগে আর্যদের দেবতাসমূহ ছিল হয় নৈসর্গিক ঘটনার প্রতীক আর তা নয়তো পার্থিব কোন পদার্থ বা বস্তু-বিশেষ যার দ্বারা আর্যরা উপকৃত হতেন । পরে রূপকের সাহায্যে তাদের মানুষের রূপ ও চারিত্রিক গুণাগুণ দেওয়া হয়েছিল । এরই অতি বিস্তারণ করা হয়েছিল পৌরানিক যুগে নানাবিধ কাহিনীর দ্বারা । তার মানে, তারা অন্য গ্রহ থেকে আসেনি। মর্ত্যলোকের মানুষেরই তারা কল্পনাপ্রসূত। পরের অনুচ্ছেদে আমি হিন্দুর দেবতাদের বিবর্তন সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করছি ।
।। দুই ।।
দেবতাদের সম্বন্ধে নিরুক্তকার যাস্ক বলেছেন- “দেবো দানাদ বা দীপনাদ বা দ্যোতমদ বা দ্যুস্থানো ভবতীতি বা ।’ তার মানে যিনি দান করেন তিনি দেবতা, যিনি দীপ্ত হন বা দ্যোতিত হন তিনি দেবতা, এবং যিনি দ্যুস্থানে থাকেন তিনিও দেবতা । ঋগ্বেদে যে কোন বিষয়বস্তুকেও দেবতা বলা হয়েছে, যদি তাদের মধ্যে বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাবার বা বৈষয়িক ঋদ্ধি বৃদ্ধির কোন শক্তির প্রকাশ দেখা যেত । সোমলতাকেও দেবতা বলা হয়েছে, মণ্ডুককেও দেবতা বলা হয়েছে, আবার সরস্বতী নদীকেও দেবতা বলা হয়েছে । তা ছাড়া, ঋগ্বেদের আৰ্যদের যে সব বড় বড় দেবতা ছিলেন, সে সব দেবতা প্ৰকৃতির মধ্যে নৈসৰ্গিক ঘটনারই প্ৰকাশ মাত্র । বস্তুতঃ ঋগ্বেদের আর্যরা ছিলেন প্ৰকৃতির সৌন্দর্যের উপাসক। যে সকল নৈসর্গিক ঘটনা বা পার্থিব বস্তু তাদের বৈষয়িক জীবনচর্যার সহায়ক ছিল, তাঁদেরই তারা দেবতা আখ্যা দিয়েছিলেন । তারপর রূপকের সাহায্যে তাঁদের মনুষ্য আকৃতি দেয়া হয়েছিল। তার মানে মূলতঃ দেবতারা যাই হন না, পরে তাদের মানুষের রূপ ও গুণাগুণ দেওয়া হয়েছিল ।
পরবর্তীকালে হিন্দুরা তেত্ৰিশ কোটি দেবতার কল্পনা করেছিল। কিন্তু ঋগ্বেদে উল্লিখিত হয়েছে যে দেবতার সংখ্যা মাত্র ৩৩টি । ঋগ্বেদের সাতটি সূক্তে ৩৩টি দেবতার উল্লেখ আছে, যদিও তারা কোন কোন দেবতা, তা বলা হয়নি। আবার দুটি সূক্তে ৩৩৩৯ দেবতার কথা বলা হয়েছে । পণ্ডিতরা বলেন যে ৩৩ সংখ্যার মধ্যে ক্রমান্বয়ে একটি এবং দুটি শূন্য দিয়ে, পরে যোগ করে, এই সংখ্যাটি তৈরী করা হয়েছিল, যথা : ৩৩+ ৩০৩ + ৩০০৩ = ৩৩৩৯ । মনে হয় পৌরাণিক যুগে এই সংখ্যাটাকেই বর্দ্ধিত করে তেত্ৰিশ কোটিতে দাঁড় করানো হয়েছিল। তবে নিরুক্তকার যাস্কের মতে গোড়ায় আৰ্যদের মাত্র তিনটি দেবতা ছিল । তাঁরা হচ্ছেন অগ্নি পৃথিবীর দেবতা, বায়ু ও ইন্দ্র অন্তরীক্ষের দেবতা ও সূর্য দ্যুলোকের দেবতা ।
ঋগ্বেদের দেবতাদের মধ্যে ইন্দ্ৰই হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ দেবতা । প্ৰজাপতির ন্যায় ইন্দ্ৰ স্বয়ম্ভু দেবতা নন। ত্বষ্টা তাঁর পিতা, অদিতি তাঁর মাতা । স্বাভাবিকভাবে মায়ের গর্ভদ্বার দিয়ে তিনি নির্গত হন নি। তিনি মায়ের পেট বিদীর্ণ করে, পেটের পাশ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন । তার অস্ত্ৰ বজ্র। বজ্র তিনি পেয়েছিলেন উশনা বা শুক্রদেবের কাছ থেকে । বেদে অবশ্য শুক্রের নাম নেই | উশনা একবার মহাদেবের পেটের ভিতরে চলে গিয়েছিলেন, তারপর মহাদেবের বীর্যদ্বার (শিশ্নমূখ) দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন বলেই, তাঁর নাম শুক্র ।