উনিশ শতকে জীবানন্দ বিদ্যাসাগরই প্রথম পুরাণগুলি মুদ্রিত করেন । পরে বঙ্গবাসী প্রেস বঙ্গানুবাদ সহ পুরাণগুলি প্ৰকাশ করে। বর্তমানে বোম্বাইয়ের বেঙ্গকটেশ্বর প্রেস ও কলকাতার আর্যশাস্ত্ৰ কাৰ্য্যালয় পুরাণগুলি আবার প্রকাশ করছে ।
সত্ত্ব, তম ও রজাগুণ অনুসারে পুরাণগুলিকে তিনভাগে ভাগ করা হয় । বিষ্ণু, নারদ, ভাগবত, গরুড়, পদ্ম ও বরাহ সত্ত্বগুণ বিশিষ্ট পুরাণ । মৎস্য, কুৰ্ম, লিঙ্গ, স্কন্দ ও অগ্নি তমোগুণ বিশিষ্ট পুরাণ। আর ব্রহ্মা, ব্ৰহ্মাণ্ড, ব্ৰহ্মবৈবর্ত, মার্কণ্ডেয়, ভবিষ্য ও বামন রজ গুণ বিশিষ্ট পুরাণ ।
পুরাণগুলির মধ্যে অগ্নিপুরাণে এত প্রকীর্ণ বিষয়ের সমাবেশ আছে যে একে একখানা বিশ্বকোষ বলা যেতে পারে । এতে আছে প্ৰতিমালক্ষ্মণ, রত্নপরীক্ষা, মন্দির প্রতিষ্ঠা, বাস্তুণাস্ত্র, হস্তী ও অশ্বাচিকিৎসা আয়ুৰ্বেদ, নাটক, অভিনয়, রসাদি নিরূপণ, অলঙ্কার, বিচার, ব্যাকরণ ও অভিধান । এতে বিষ্ণু, লিঙ্গ, দুর্গা, গণেশ, সূর্য প্রভৃতি দেবতার পূজা, তান্ত্রিক অনুষ্ঠান, দেবতার মূর্তি নিৰ্মাণ ও প্রতিষ্ঠা, বিবাহানুষ্ঠান, অন্তেষ্টিপদ্ধতি প্ৰভৃতির কথা ছাড়া, মৃত্যু ও জন্মান্তরবাদ, সৃষ্টিতত্ত্ব, ভূগোল, বংশানুকীর্তন প্ৰভৃতি বিশুদ্ধ পৌরাণিক বিষয়েরও বিবরণ আছে । আরও যে সব বিষয় এতে আলোচিত হয়েছে, তার মধ্যে আছে জ্যোতিষ শাকুন বিদ্যা, গৃহনির্মাণ, রাজনীতি, যুদ্ধ বিদ্যা, চিকিৎসা, ছন্দ, কাব্য ইত্যাদি । অনুরুপভাবে বিশ্বকোষের সামিল হচ্ছে স্কন্দপুরাণ । আগেই বলেছি যে এতে ৮১৮০ ০ শ্লোক আছে। এতে স্কন্দ বা শড়াননের ঘটনাবলী বিবৃত হয়েছে। ব্ৰহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, কাশী, আবন্তী, নাগর ও প্রভাস এই সাত খণ্ডে বিভক্ত। এই পুরাণখনি যে অতি আধুনিক পুরাণ সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই, কেননা সত্যনারায়ণের ব্রত কথাও এতে আছে।
ব্ৰহ্মপুরাণকে আদিপুরাণ বলা হয়। তার কারণ হিন্দুর বিশ্বাস এই পুরাণই প্রথম রচিত হয়েছিল। এই পুরাণে সৃষ্টিতত্ত্ব, দেবতা ও অসুরগণের জন্ম, সূর্য ও চন্দ্ৰ বংশের বিবরণ, বিশ্ববৰ্ণনা, দ্বীপ ও বর্ষ, স্বর্গ, নরক ও পাতালদির বিবরণ, শ্ৰীকৃষ্ণের জীবন চরিত ও যোগশাস্ত্রের ব্যাখ্যা আছে। আবার অনেকের মতে ব্ৰহ্মপুরাণ নয়, আদিপুরাণ হচ্ছে বায়ুপুরাণ। বানভট্ট এই আদি পুরানের উল্লেখ করেছেন । গয়াশ্রাদ্ধ ও গয়ামাহাত্ম্য এই পুরাণের অন্তৰ্গত । বায়ুপুরাণের চারটি পাদ যথা প্রক্রিয়া, অনুষঙ্গ, উপোদখাত ও উপসংহার।
পুরাণসমূহের পঞ্চলক্ষণ বিশুদ্ধভাবে দেখতে পাওয়া যায় বিষ্ণুপুরাণে । সাহেবরা এর ঐতিহাসিক মূল্যও স্বীকার করেছেন । এটা পঞ্চরাত্র বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অন্যতম মূল গ্ৰন্থ । আচার্য রামানুজও এর প্রামাণ্য স্বীকার করেছেন । এটা ছয়ভাগে বিভক্ত, যথা (১) বিষ্ণু ও লক্ষ্মীর উৎপত্তি, ধ্রুব চরিত্র, প্ৰহলাদ চরিত্র ইত্যাদি আখ্যান, (২) পৃথিবী, সপ্তদ্বীপ, সপ্তসমুদ্র ; (৩) ব্যাস কর্তৃক বেদবিভাগ, শাখা বিভাগ, আশ্রম ধর্ম ইত্যাদি ; (৪) সূর্য ও চন্দ্ৰবংশ এবং রাজবংশের বর্ণনা , (৫) কৃষ্ণচরিত্র, বৃন্দাবন লীলা, রাসলীলা ইত্যাদি ; (৬) বিষ্ণুভক্তি, যোগ ও মুক্তির কথা ।
অন্যান্য পুরাণে অন্যান্য দেবতার মহাত্ম্য বিবৃত হয়েছে। পদ্মপুরাণ বৈষ্ণবপুরাণ | পদ্মপুরাণে ৫৫,০০০ শ্লোক আছে । পাঁচখণ্ডে এই পুরাণ বিভক্ত, যথা সৃষ্টিখণ্ড, ভূমিখণ্ড, স্বৰ্গখণ্ড, পাতালখণ্ড ও উত্তরখণ্ড । এতে যে সব বিষয় বিবৃত হয়েছে, তা হচ্ছে–সৃষ্টির আদিক্রম, তারকাসুরের উপাখ্যান, গো মাহাত্ম্য, বৃত্ৰবধ, পৃথুচরিত, বেণুরাজার উপাখ্যান, নহুষ ও যযাতির কাহিনী, ব্রহ্মখণ্ডের উৎপত্তি, কুরুক্ষেত্রাদি তীর্থ বিবরণ, কাশী, গয়া, প্ৰয়াগ প্ৰভৃতির মাহাত্ম্য কীর্তন, কর্মযোগ নিরুপণ, অগস্তাদি ঋষির আগমন, রাবণোপাখ্যান, জগন্নাথের বিবরণ, কৃষ্ণের নিত্যলীলা কথন, দধীচির উপাখ্যান, শিব মাহাত্ম্য, ব্ৰতমাহাত্ম্য, নৃসিংহ উৎপত্তি, জম্বুদ্বীপের অন্তর্গত তীৰ্থসমূহের মাহাত্মা, ভাগবত মাহাত্ম্য, অবতারাদির বিবরণ ইত্যাদি ।
নারদপুরাণে শিব ও বিষ্ণু মাহাত্ম্য, বৈষ্ণব ধর্ম ও বৈষ্ণব আচরণ, ও তীর্থপ্রসঙ্গ আছে। ভবিষ্যপুরাণে সূর্য পূজার বিস্তৃত ইতিহাস আছে । ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণ কৃষ্ণলীলাত্মক । লিঙ্গপুরাণ শৈবপুরাণ। বরাহ বৈষ্ণবপুরাণ। বামুনপুরাণে শিব ও বিষ্ণুর উভয়েরই মাহাত্ম্য বিবৃত হয়েছে। মার্কণ্ডেয় পু্রাণে সুপ্ৰসিদ্ধ দেবীমাহাত্ম্য বা সপ্তশতী চণ্ডীর স্তোত্র আছে । তা ছাড়া, এতে আছে বশিষ্ট ও বিশ্বামিত্রের কলহ, দুর্গ কথা, শ্ৰীকৃষ্ণের বাল্যাবস্থা কথন, হরিশ্চন্দ্রের উপাখ্যান, মদালসার উপাখ্যান, রুদ্রাদি সৃষ্টি, মার্কণ্ডের জন্ম, ইক্ষাকুচরিত, রামচন্দ্রের উপাখ্যান, পুরূরিবার উপাখ্যান ইত্যাদি। গরুড়পুরাণ বৈষ্ণবপুরাণ। কুর্ম ও ব্ৰহ্মাণ্ড প্রাচীন পুরাণ । মৎস্যপুরাণে সমুদয় পুরাণের একটা অনুক্রমনী দেওয়া আছে। উপপুরাণগুলির মধ্যে দেবীভাগবত শক্তিগণের কাছে মহাপুরাণ হিসাবে পরিগণিত হয়। বর্তমান দুর্গাপূজা কালিকাপুরাণ অনুযায়ী হয় । সমুদয় উপপুরাণের মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে বিষ্ণুধর্মোত্তরপুরাণ। এর প্রথম খণ্ডে সৃষ্টি প্রকরণ, বংশ তালিকা ও উপাখ্যানাদির সঙ্গে কাশ্মীর ও গান্ধার দেশের ভৌগলিক বিবরণ আছে । দ্বিতীয় খণ্ডে নীতি ও ধর্মশাস্ত্র, আয়ুৰ্বেদ ও জ্যোতিষ, তৃতীয় খণ্ডে ব্যাকরণ, অভিধান, ছন্দ, অলঙ্কার, নৃত্যগীত, স্থাপত্য, প্ৰতিমানির্মাণ ও চিত্রকলার কথা ব্যাখ্যাত আছে ।