কৃষ্ণ যজুৰ্বেদ বা তৈক্তিরীয় ব্রাহ্মণ তিনভাগে বিভক্ত। এর দশটি অধ্যায় বা প্রপাঠক আছে। তার মধ্যে সপ্তম, অষ্টম ও নবম প্রপাঠককে তৈত্তিরীয় উপনিষদ বলা হয়, আর শুক্ল যজুর্বেদের বিস্তীর্ণ ব্ৰাহ্মণের নাম শতপথব্রাহ্মণ । মাধ্যান্দিন শাখার শতপথব্রাহ্মণ ১৪টি কাণ্ডে ও ১০০টি অধ্যায়ে বিভক্ত । সেজন্যই একে শতপথব্রাহ্মণ বলা হয়। ১৪টি কাণ্ডের মধ্যে নয়টি খুব প্ৰাচীন । দশমটিতে অগ্নিরহস্য ও একাদশে অগ্নিচয়নের কথা আছে । ত্রয়োদশে অশ্বমেধ ও নরমেধ-এর কথা আছে । এই কাণ্ডে দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার পুত্র ভরত, ভারতদিগের রাজা সাত্রোজিত ও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কাশীরাজ ধৃতরাষ্ট্র, পরীক্ষিতের পুত্র জনমেজয় ও তাঁর ভ্ৰাতা ভীমসেন, উগ্ৰসেন ও শ্রুতসেন প্ৰভৃতি রাজাদের কথা আছে । শতপথব্রাহ্মণের চতুৰ্দশ কাণ্ডকে আরণ্যক বলা হয়। এরই শেষের ছয় অধ্যায় বৃহদারণ্যক উপনিষদ। এতে আলোচিত হয়েছে সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টি, গার্গ্য, বালাকি ও কাশীর রাজা অজাতশত্রুর কথা, বিদেহরাজ জনকের কথা, গাৰ্গ বাচক নবীর কথা, যাজ্ঞবল্ক্য ও মৈত্রেয়ীর কথা, উদ্যালক আরুণির কথা, ও পরম ব্ৰহ্ম, পরমাত্মা, ব্ৰহ্ম ও প্ৰজাপতি, বেদত্ৰয় ও গায়ত্রী সম্বন্ধে ।
অথর্ববেদের ব্ৰাহ্মণের নাম গোপথ ব্ৰাহ্মণ । এতে এগারটি অধ্যায় বা প্ৰপাঠক আছে । শতপথব্ৰাহ্মণে যে সকল উপাখ্যান বিবৃত হয়েছে, তা গোপথব্ৰাহ্মণেও দেখতে পাওয়া যায় ।
আগেই বলেছি যে উপনিষদগুলি হচ্ছে দার্শনিক গ্রন্থ । এগুলি প্ৰধানত পরমব্রহ্মের আলোচনাতেই পরিপূর্ণ। অথর্ববেদের উপনিষদগুলি নানারূপ সাম্প্রদায়িক বিতর্কে পরিপূর্ণ। উপনিষদগুলির এক সময় সংখ্যা ছিল অনেক । তবে বর্তমানে ১২টি উপনিষদই প্ৰধান বলে গণ্য হয় । এগুলি হচ্ছে –(১) ঋগ্বেদের কৌষীতকী ও ঐতরেয়, (২) সামবেদের ছন্দোগ্য ও কেন, (৩) কৃষ্ণ যজুর্বেদের তৈত্তিরীয়, কঠ ও শ্বেতাশ্বতর, (৪) শুক্ল যজুর্বেদের বৃহদারণ্যক ও ঈশা, ও (৫) অথর্ববেদের প্রশ্ন, মুণ্ডক ও মাণ্ডুক্য ।
।। সাত ।।
আগেই বলেছি যে বেদকে শ্রুতি বলা হয় । তার কারণ বেদ গোড়ায় মুখে মুখে উচ্চারিত হত। পরেকার সাহিত্য সূত্রাকারে রচিত হয়েছিল । সূত্র সমূহের অন্যতম হচ্ছে পাণিনীয় জগৎ বিখ্যাত ব্যাকরণ সূত্র । আচার ব্যবহার ও রীতিনীতির জন্য রচিত হয়েছিল ধর্ম সূত্রসমূহ।
এই সময় আৰ্যসভ্যতার বিরুদ্ধে এক অবরোধ গঠন করেন। গৌতম বুদ্ধ। বুদ্ধপ্রবর্তিত ও প্রচারিত ধর্ম ভারতের সাংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক বিপ্লব ঘটায়। মোটামুটিভাবে এই বিপ্লব গুপ্তসম্রাটগণের অভ্যুদয় কাল ( খ্ৰীষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দী) পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই বিপ্লবের প্রকোপে ব্যয়সাধ্য যজ্ঞের আড়ম্বর ও অনুষ্ঠানসমূহ ক্রমশ হ্রাস পায় । গুপ্তসম্রাটগণের আমলে ব্ৰাহ্মণ্যধর্মের পূর্ণপ্রতিষ্ঠা হয়, কিন্তু ব্যায়সাপেক্ষ যাগযজ্ঞাদির পরিবর্তে স্বল্পখরচে কৃত পূজাদির প্রবর্তন হয়। এই সময় লৌকিক দেবতাসমূহ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। তাদের মাহাত্ম্য কীর্তিত হয় পুৰাণসমূহে ।
।। আট ।।
বেদোত্তর যুগের প্রাচীন সাহিত্য হচ্ছে পুরাণসমূহ । পুরাণসমূহে আছে ইতিহাস, কাহিনী, উপকথা ও বিভিন্ন দেবতাদের কথা । যদিও এগুলি বেদোত্তর যুগে রচিত হয়েছিল, তাহলেও এরূপ চিন্তা করবার যথেষ্ট কারণ আছে যে পৌরাণিক কাহিনীসমূহ, অতি প্ৰাচীনকালের। পুরাভবম্ ইতি পুরাণম্ –এই বচন থেকেও এটা সমর্থিত হয়।
পুরাণগুলি সংখ্যায় বহু ৷ তবে তাদের মধ্যে আঠারটি পুরাণকে মহাপুরাণ বলা হয়। বিষ্ণুপুরাণ অনুযায়ী এই আঠারটি মহাপুরাণ হচ্ছে – (১) ব্ৰহ্ম, (২) পদ্ম, (৩) বিষ্ণু, (৪) শিব, (৬) ভাগবত, (৬) নারদ, (৭) মার্কণ্ডেয়, (৮) অগ্নি, (৯) ভবিষ্য, (১০) ব্ৰহ্মবৈবর্ত, (১১) লিঙ্গ, (১২) বরাহ, (১) স্কন্দ. (১৪) বামণ, (১৫) কুৰ্ম, (১৬), মৎস্য, (১৭) গরুড় ও (১৮) ব্ৰহ্মাণ্ড । উপপুরাণগুলির মধ্যে প্রধান হচ্ছে- (১) দেবীভাগবত, (২) কালিকাপুরাণ ও (৩) বিষ্ণুধর্মেত্তিরপুরাণ । মহাপুরাণগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে স্কন্দপুরাণ। এতে ৮১,৮০০ শ্লোক আছে। এটা মহাভারতের চেয়েও বড়। আর উপপুরাণগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে বিষ্ণুধর্মোত্তরপুরাণ ।
অমরকোষ অনুযায়ী পুরাণগুলি পঞ্চলক্ষণযুক্ত। এই লক্ষণগুলি যথাক্রমে – (১) সৰ্গ ( সৃষ্টি ), (২) প্ৰতিসৰ্গা ( প্ৰলয়ের পর নবসৃষ্টি ), (৩) বংশ ( দেবতা ও ঋষিগণের বংশতালিকা ), (৪) মন্বন্তর ( চতুৰ্দশ মনুর শাসন বিবরণ ) ও (৫) বংশানুচরিত ( রাজগণের বংশাবলী ) । তবে ভাগবত ও ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণের লক্ষণ দশটি-যথা (১) সৰ্গ, (১) বিসর্গ, (৩) বৃত্তি, (৪) রক্ষা, (৫) অন্তর, (৬) বংশ, (৭) বংশানুচরিত, (৮) সংস্থা, (৯) হেতু ও (১০) অপাশ্রয়। মৎস্যপুরাণে একাদশ লক্ষণের কথা বলা হয়েছে । সেখানে বলা হয়েছে যে প্ৰাগোক্ত পঞ্চলক্ষণ ছাড়া পুরাণের আরও লক্ষণ হচ্ছে–(৬) ভূবন বিস্তার, (৭) দানধৰ্মবিধি, (৮) শ্ৰাদ্ধকল্প, (৯) বৰ্ণাশ্রম বিভাগ, (১০) ইষ্টাপূর্ত ও (১১) দেবতা প্রতিষ্ঠা ।
সমস্ত পুরাণগুলিকেই বেদব্যাসের রচিত বলা হয়। এদের প্রবক্তা হচ্ছেন লোমহর্ষণ পুত্ৰ উগ্রশবা । উগ্রশবা এর প্রচার করেন নৈমিষারণ্যে ! মহাভারতের ন্যায় পুরাণগুলিকে ‘জয়’ নামে অভিহিত করা হয়।