সামবেদের তেরটি শাখা আছে। তার মধ্যে কৌথুমী শাখাই প্ৰসিদ্ধ। এটা উত্তরভারতে প্রচলিত। দক্ষিণ ভারতে প্রচলিত শাখার নাম হচ্ছে রানায়নী শাখা ।
।। চার ।।
যজ্ঞের মন্ত্রকে ‘যজুস’ ( যজ+উসি) বলা হয়। যে বেদে এরূপ মন্ত্র আছে, তাকে যজুৰ্বেদ বলা হয়। এরূপ মন্ত্রের উচ্চারণে কোন চরণ বা অবসান থাকত না । সেজন্য যজুৰ্বেদকে গদ্যগ্ৰন্থ বলা হয়। যজুর্মন্ত্র অধ্বর্য়ু নামক ঋষ্ণিকের দ্বারা অনুঃচ্চস্বরে উচ্চারিত হত ।
যজুর্বেদের দুইভাগ— কৃষ্ণ ও শুক্ল । এই দুইভাগ সম্বন্ধে একটা উপাখ্যান আছে। প্রথমে বেদব্যাস বৈশাম্পয়নকে যজুৰ্বেদ শিক্ষা দেন । তারপর বৈশাম্পয়ন যাজ্ঞবল্ক্যকে এটা অধ্যায়ন করান । কোন কারণে বৈশাম্পায়ন যাজ্ঞবল্ক্যের ওপর রুষ্ট হয়ে, তাকে অধীত বিদ্যা ত্যাগ করতে বলেন । যাজ্ঞবল্ক্য বমন করে তার অধীত বিদ্যা ত্যাগ করে । তখন বৈশাম্পয়নের অন্য শিষ্যরা তিত্তিরিপক্ষী হয়ে ওই বমনকৃত যজুর্মন্ত্র ভক্ষণ করে । তাদের মলিন বুদ্ধির জন্য এই যজুর্মন্ত্র কৃষ্ণ হয়ে যায় । সে জন্য এর নাম কৃষ্ণ যজুৰ্বেদ বা তৈত্তিরীয় সংহিতা আখ্যা হয়। অনেকে মনে করেন যে শুক্ল যজুৰ্বেদ কুরু-পঞ্চাল দেশে ও কৃষ্ণ যজুৰ্বেদ মিথিলায় প্রচলিত ছিল। সামবেদের ন্যায় যজুর্বেদও যজ্ঞীয় সাহিত্য।
যজুর্বেদের বিভাগগুলি ক্রিয়ামূলক । এর ভিন্ন ভিন্ন অধ্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন যজ্ঞক্রিয়ার মন্ত্র ও বিধান আছে । এই সকল বৈদিক যজ্ঞক্রিয়ার অন্তর্ভূক্ত হচ্ছে –দৰ্শযাগ, পিণ্ডাপিতৃযজ্ঞ, অগ্নিহোত্ৰ, অগ্নিষ্টোম, রাজসূয়, সৌত্রামনী, অগ্নিচয়ণ, অশ্বমেধ, পুরুরমেধ, সর্বমেধ, ও পিতৃমেধ । যজ্ঞে মন্ত্রগুলি বিশুদ্ধভাবে উচ্চারিত হবার জন্য যে নিয়মগুলি প্ৰণীত হয়েছিল, তা থেকে ‘দেববিদ্যা’, ‘ব্রহ্মবিদ্যা’ ও ব্যাকরণের উৎপত্তি হয় । এবং যজ্ঞ সম্পাদনের জন্য যে চিতি তৈরী করা হত, তার নিয়মগুলি থেকে জ্যামিতি শাস্ত্রের উদ্ভব হয় । শুক্র যজুর্বেদের চতুর্দশ অধ্যায়টি উপনিষদ । একে ঈশা উপনিষদ বলা হয় ।
।। পাঁচ ।।
অথর্ববেদ পরে রচিত হয়েছিল। এর ক্রিয়াকলাপাদি ঋক, সাম ও যজুর্বেদের যজ্ঞক্রিয়াদি থেকে পৃথক । সেজন্য মনে হয় আদিতে ঋক, সাম ও যজু –এই তিন বেদ ছিল । কেননা, ঐতরেয় ব্ৰাহ্মণ ( ৫।৩২)। শতপথব্রাহ্মণ ( ১৷৬।৭৷১৩ ) বৃহদারণ্যক উপনিষদ ( ১।৫।৫ ), ও ছান্দোগ্য উপনিষদ (৩।১৭৷১) প্ৰভৃতি প্ৰাচীন গ্রন্থের অনেক স্থলে মাত্র ঋক, সাম ও যজুবেদের উল্লেখ আছে। প্রাচীন ধর্মসূত্রগুলিতে ও মনুসংহিতাতেও তিনটি বেদেরই উল্লেখ আছে। সেজন্য ঋক, সাম ও যজুৰ্বেদকে ত্রয়ী বলা হয় । অথর্ববেদ পরবর্তী কালের সংযোজন । এতে ঐহিক ফলপ্রদ, শত্রুমারণাদির উপযোগী ক্রিয়াকলাপের মন্ত্রসমূহ আছে। এগুলি সোম যজ্ঞাদিতে অব্যবহার্য । সেজন্যই এর নাম অথর্ব ।
অথর্ববেদ ২০ কাণ্ডে বিভক্ত । এর সুক্ত সংখ্যা প্ৰথম কাণ্ডে ৩৫, দ্বিতীয় কাণ্ডে ৩৬, তৃতীয় কাণ্ডে ৩১, চতুর্থ কাণ্ডে ৪০, পঞ্চম কাণ্ডে ৩১, ষষ্ঠ কাণ্ডে ১৪২, সপ্তম কাণ্ডে ১১৮, অষ্টম কাণ্ডে ১০, নবম কাণ্ডে ১০, দশম কাণ্ডে ১০, একাদশ কাণ্ডে ১০, দ্বাদশ কাণ্ডে ৫, ত্ৰয়োদশ কাণ্ডে 8, চতুৰ্দশ কাণ্ডে ২, পঞ্চদশ কাণ্ডে ১৮, ষোড়শ কাণ্ডে ৯, সপ্তদশ কাণ্ডে ১, অষ্টাদশ কাণ্ডে ৪, উনবিংশ কাণ্ডে ৭১ ও বিংশ কাণ্ডে ১৪৩, উনবিংশ কাণ্ডটি হচ্ছে অন্যান্য কাণ্ডের পরিশিষ্ট । আর বিংশ কাণ্ডটি ঋগ্বেদ থেকে উদ্ধত সূক্তে পরিপূর্ণ। এই উদ্ধৃতিসমূহ অধিকাংশই ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের সূক্ত । অথর্ববেদের অধিকাংশ অংশই পদ্য, তবে কিছু অংশ গদ্য আছে ।
।। ছয় ।।
এ পর্যন্ত যে বৈদিক সাহিত্যের কথা বলা হল, তাকে সংহিতা বলা হয় । এ ছাড়া, বেদের আরও তিনটা ভাগ আছে যথা (১) ব্ৰাহ্মণ, (২) আরণ্যক, ও (২) উপনিষদ । ব্ৰাহ্মণগ্রন্থগুলির মধ্যে সন্নিবিষ্ট বিষয়বস্তু সমূহ হচ্ছে মন্ত্রের অর্থমীমাংসা, যজ্ঞের অনুষ্ঠান সম্বন্ধে বিস্তীর্ণ বিবরণ ও নানা বিষয়ক উপাখ্যান। ঋগ্বেদের দুইটা প্ৰধান ব্ৰাহ্মণ হচ্ছে- ১) শাঙ্খায়ণ বা কৌষীতকী, ও (২) ঐতরেয় । ব্ৰাহ্মণের যে অংশ অরণ্যে পাঠ করা হত, তাকে ‘আরণ্যক’ বলা হত । শাঙ্খায়ণ বা কৌষীতকী আরণ্যক ১৫টি অধ্যায়ে বিভক্ত। এর তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ অধ্যায়কে কৌষীতকী উপনিষদ বলা হয়। ঐতরেয় ব্ৰাহ্মণে ৪০টি অধ্যায় আছে। এর প্রায় সমগ্ৰ অংশই সোমাযজ্ঞের বিবরণে পূর্ণ। শেষের দশটি অধ্যায়কে অপেক্ষাকৃত আধুনিক মনে করা হয়। এই অংশে ইক্ষাকুবংশীয় রাজা হরিশ্চন্দ্রের কথা আছে । একেবারে শেষের তিনটি অধ্যায়ে কিছু কিছু ঐতিহাসিক বিবরণ আছে, যেমন প্রাচ্যে বিদেহ প্ৰভৃতি জাতিদিগের সাম্রাজ্য, দক্ষিণে ভোজরাজ্য, পশ্চিমে নীচ্য ও অপাচ্য রাজ্য, ও উত্তরে উত্তর কুরু ও উত্তর মদ্রদিগের রাজ্য ও মধ্যদেশে কুরুপঞ্চালদিগের রাজ্য প্রভৃতির উল্লেখ আছে। এ ছাড়া, পরিক্ষীত পুত্ৰ জনমেজয়, মনুপুত্র শার্যার্ত, উগ্ৰসেন পুত্ৰ যুধাংশ্রেষ্ঠি, বিজবন পুত্ৰ সুদাস, দুষ্মন্ত পুত্র ভরত প্ৰভৃতি অনেক রাজার নাম আছে ।
সামবেদের দুটি প্রধান ব্ৰাহ্মণ হচ্ছে তাণ্ড্য ও ষড়বিংশ । আসলে সামবেদীয় ( কৌসুমী শাখার ) ব্ৰাহ্মণ ৪০ ভাগে বিভক্ত। তার মধ্যে ২৫ ভাগকে তাণ্ড্য বা পঞ্চবিংশ, ৫ ভাগকে ষড়বিংশ, দুইভাগকে মন্ত্রব্ৰাহ্মণ ও ৮ ভাগকে ছান্দোগ্য উপনিষদ বলা হয় । তাণ্ড্য ব্ৰাহ্মণে সোমাযজ্ঞের বিবরণ, ব্রাত্যস্তোমে ব্রাত্যদিগের বিবরণ, নৈমিষারণ্যের যজ্ঞ ও কুরুক্ষেত্রের উল্লেখ আছে। এতে কোশলরাজ পর আত্মার ও বিদেহরাজ নামী সাপ্যের উল্লেখও পাওয়া যায়। ষড়বিংশ ব্ৰাহ্মণে অনেক প্রকার প্রায়শ্চিত্ত বিধান ও দুৰ্দৈব, পীড়া, শস্যনাশ, ভূমিকম্প প্রভৃতি বিপদখণ্ডণ উপযোগী অনুষ্ঠানের কথা আছে। এখানে বলা প্ৰয়োজন যে পঞ্চবিংশ ব্ৰাহ্মণ ও ষড়বিংশ ব্ৰাহ্মণে যে সকল যজ্ঞের বিবরণ আছে, তাদের শ্রৌতযজ্ঞ বলা হয় । মন্ত্রব্রাহ্মণে গৃহস্থের অনুষ্ঠেয় গৃহাক্রিয়ার বিবরণ পাওয়া যায় । ছন্দোগ্য উপনিষদে ওঁ শব্দ, উদ্গীথ, সাম ও পরমব্ৰহ্ম প্ৰভৃতি বিষয়ের আলোচনা পাওয়া যায় । এ ছাড়া, দেবকীনন্দন শ্ৰীকৃষ্ণ, সত্যকাম জাবাল, শ্বেতকেতু আরুনেয়, অশ্বপতি কৈকেয়, শ্বেতকেতুর পিতা উদ্দালক, আরুনি, সনৎকুমার, নারদ প্রভৃতির কথা আছে ।