।। দুই ।।
ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলি দশটি মণ্ডলে বিভক্ত বলে, ঋগ্বেদকে ‘দশতরী’ বলা হয় । তবে এখন আমরা যাকে ঋগ্বেদ বলি, তা ছাড়া আরও ঋক সংহিতা ছিল। বর্তমান ঋগ্বেদ সংহিতা যে শাখার অন্তর্ভুক্ত, তাকে ‘শাকল’ শাখা বলা হয়। পতঞ্জলি তাঁর মহাভাষ্যে এরূপ একুশটি শাখার উল্লেখ করেছেন ( ‘একবিংশতিধা বার্হ্বচ্যম’ ) । তবে বাকী শাখার সূক্তগুলি লুপ্ত হয়ে গেছে। এখন মাত্র ‘শাকল’ শাখার সূক্তগুলিই জীবিত ।
উপরে যে দশটি মণ্ডলের কথা বলেছি, সে দশটি মণ্ডল ‘শাকল’ শাখার ঋকসংহিতার । এই দশটি মণ্ডলের সূক্ত-বিন্যাস একই রকমের নয়। প্রথম ও দশম মণ্ডলের প্রতিটির সূক্ত সংখ্যা হচ্ছে ১৯১। বাকী মণ্ডলগুলির সূক্ত সংখ্যা যথাক্রমে—দ্বিতীয় মণ্ডলের ৪৩, তৃতীয় মণ্ডলের ৬২, চতুর্থ মণ্ডলের ৫৮, পঞ্চম মণ্ডলের ৮৭, ষষ্ঠ মণ্ডলের ৭৫, সপ্তম মণ্ডলের ১০৭, অষ্টম মণ্ডলের ৯২ ও নবম মণ্ডলের ১১৪ । আগেই বলেছি যে মোট সূক্ত সংখ্যা হচ্ছে ১০১৭ ৷ শাকল শাখার বিভিন্ন সংস্করণের অষ্টম মণ্ডলে (৮।৪৯-৫৯ ) এগারটি সূক্তকে ‘বালখিল্য’সূক্ত বলা হয় । এই এগারটি সূক্ত নিয়ে মোট সূক্ত সংখ্যা হচ্ছে ১০২৮ । সংখ্যার বিসংগতি ছাড়া মণ্ডলগুলির আরও এক বৈশিষ্ট্য আছে । দ্বিতীয় থেকে সপ্তম মণ্ডল পর্যন্ত সূক্তগুলি এক-একজন বিশেষ ঋষি বা তাদের বংশধরগণের রচিত। যথাক্রমে এই ঋষিগণ হচ্ছেন- গৃৎসমদ, বিশ্বামিত্র, বামদেব, অত্রি, ভরদ্বাজ ও বশিষ্ট । এই ছয়টি মণ্ডল একএকজন বিশেষ ঋষি বা তাঁদের বংশধরগণের রচিত বলে সাহেবরা এগুলিকে ‘ফ্যামিলি বুকস্’ বলেন । অষ্টম মণ্ডলটি প্রধানত কম্বগোত্রীয় ঋষিগণ কর্তৃক দৃষ্ট ‘প্রগাথ’ মন্ত্রের সংকলন, আর নবম মণ্ডলটি নানা ঋষিগণ রচিত ‘পবমান-সোম’-এর উদ্দেশ্যে রচিত মন্ত্রসমূহের সমষ্টি । প্ৰথম ও দশম মণ্ডলের স্তোত্রগুলি নানা ঋষির রচিত, এবং এগুলি অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের সংযোজন বলে পণ্ডিতগণ মনে করেন ।
ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলি সাধারণতঃ গায়ত্রী ( ২৪ অক্ষর ), উষ্ণিহ ( ২৮ অক্ষর), অনুষ্টুপ (৩২ অক্ষর , বৃহতী ( ৩৬ অক্ষর ), পঙক্তি ( ৪০ অক্ষর ), ত্ৰিষ্টুপ ( ৪৪ অক্ষর ), জগতী ( ৪৮ অক্ষর)–এই সাতটি ছন্দে রচিত ।
ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলি পরবর্তীকালের সংস্কৃত ভাষায় রচিত নয়। এগুলি আদি আৰ্যভাষায় রচিত । এর বিশেষ নাম হচ্ছে বৈদিক ভাষা । ঋগ্বেদে এমন অনেক শব্দ আছে ( যথা বিশেষ্য পদ ও ক্রিয়াপদ ) যা পরবর্তীকালের সংস্কৃত ভাষায় দেখতে পাওয়া যায় না । তা ছাড়া, পরবর্তীকালে শব্দের মূল আদিম অর্থও পরিবর্তিত হয়েছে। তার জন্য ঋক মন্ত্রগুলির প্রকৃত অর্থ নির্ণয় করা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। এই অর্থ নির্ণয়ের সমস্যা যাস্ক-কেও বিব্রত করেছিল। তাঁর ‘নিরুক্ত’ এর সাক্ষ্য বহন করে । সাম্প্রতিককালে ইরাণীয়, হিত্তি ও অন্যান্য আর্যভাষার সাহায্যে আমরা একটা মোটামুটি সন্তোষজনক অর্থ নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছি। বৈদিক ভাষার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল ইরাণীয় ভাষার । ইরাণীয় ‘আবেস্তা’র অনেক মন্ত্র ধ্বনিপরিবর্তনের সাহায্যে ঋকমন্ত্রে রূপান্তরিত করাও সম্ভবপর হয়েছে ।
যাস্ক ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলিকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করেছেন-(১) পরোক্ষকৃত, (২) প্ৰত্যক্ষকৃত, ও (৩) আধ্যাত্মিক । দেবতাকে যেখানে পরোক্ষভাবে স্তুত করা হয়েছে ও ক্রিয়াপদ প্রথম পুরুষে ব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলিই হচ্ছে পরোক্ষাকৃত মন্ত্র । আর দেবতাকে যেখানে প্ৰত্যক্ষভাবে আহ্বান করা হয়েছে, সেগুলি হচ্ছে প্ৰত্যক্ষাকৃত মন্ত্র । আর যেখানে কোন ঋষি, দেবতার সঙ্গে তদাত্মাপ্রাপ্ত হয়ে উত্তমপুরুষের ক্রিয়াপদের সাহায্যে আত্মস্তুতিতে প্ৰবৃত্ত হয়েছেন, সেগুলি আধ্যাত্মিক মন্ত্র। তবে আধ্যাত্মিক মন্ত্রের সংখ্যা খুবই কম। অবশ্য, এর ব্যতিক্রমও আছে । যেমন দশম মণ্ডলের ৯৫ সূক্তে পুরূরবা ও উর্বশীর কথোপকথন । একে সংবাদ-সূক্ত বলা হয়। অনেক সময় লৌকিক বিষয়বস্তুরও অবতারণা করা হয়েছে । এই শ্রেণীর সূক্তগুলিকে ‘অক্ষসূত্র’ বলা হয় । আবার কোন কোন জায়গায় গম্ভীর দার্শনিকতত্বের অবতারণা করা হয়েছে ; যেমন নাসদীয় মুক্ত ) ( ১০৷১২৯ ) ও পুরুষসূক্ত ( ১০।৯০ ) । আবার, কোন কোন জায়গায় অথর্বন মন্ত্রের ন্যায় শাপ, অভিশাপ ইত্যাদিও দেখা যায় ।
সমস্ত ঋগ্ধেদখানা বিশ্লেষণ করে পণ্ডিতমহল এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে মন্ত্রগুলি কোন এক বিশেষ সময়ে রচিত হয় নি। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ও কয়েক শতাব্দী ধরে মন্ত্রগুলি রচিত হয়েছিল । এমন কি ঋগ্বেদের মধ্যে এমন অনেক মন্ত্র আছে, যা আৰ্যদের ভারতে আগমনের পূর্বকালের রচিত। দেবতামণ্ডলীর গঠন দেখেও তাই মনে হয়। এ সম্বন্ধে আমি অন্যত্র বিশদ আলোচনা করেছি, সে কারণে এখানে আর তার পুনরাবৃত্তি করছি না । ( লেখকের ‘ডিনামিকস্ অভ্ সিনথেসিস ইন হিন্দু কালচার’ দেখুন)।
।। তিন ।।
সামবেদের নামকরণ করা হয়েছে ‘সামন’ শব্দ থেকে । ‘সামন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে দেবতার স্তুতির উদ্দেশ্যে গান । তার মানে, সামবেদ হচ্ছে গানের সংকলন বা গানের জন্য ব্যবহৃত ঋকমন্ত্রই সাম । এক কথায়, যজ্ঞ সম্পাদনের জন্য যে সকল ঋক উচ্চারিত না হয়ে, গীত হত, তাদের সমষ্টিই হচ্ছে সামবেদ । ঐতরেয়ব্ৰাহ্মণ অনুযায়ী উদ্গাতা, প্ৰস্তোতা ও প্ৰতিহর্তা—এই তিনজন ঋত্বিকে মিলে সামগান করত ।