ভুবনেশ্বরে এক সময় ৭০০ মন্দির ছিল। সত্তর বছর আগেও আমি তিন-চারশ মন্দির দেখেছি। এখানেও মৈথুন মূর্তির ছড়াছড়ি । তবে রাজা রানী মন্দিরের মৈথুন মূতিগুলি হচ্ছে সবচেয়ে দুঃসাহসিক ধরণের ।
কোনারক পরিত্যক্ত মন্দির । এখানে ক্যামেরা নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ নয়। সেজন্যই আমরা কোনারকের রমনমূর্তিগুলির সহিত বেশী পরিচিত। অনুরূপভাবে আমরা পরিচিত খাজুরাহোর মন্দিরের রমণ বিলাস মূর্তিগুলির সঙ্গে । এখানেও বহু দুঃসাহসিক ধরনের রমন মূৰ্তি আছে। খাজুরাহােতেও এক সময় অগণিত মন্দির ছিল। তাদের মধ্যে এখনও গোটা পঁচিশ বিদ্যমান । নাগর রীতিতে গঠিত মন্দিরের এখানেই চরম পরাকাষ্ঠা প্ৰদৰ্শিত হয়েছিল। মূল দেবতার মন্দিরকে অবলম্বন করে এখানে ৬৪ যোগিনীর মন্দিরও রচিত হয়েছিল । এ থেকেই এগুলির তান্ত্রিক উৎপত্তি প্ৰকাশ পায় ।
।। সাত ।।
একটা প্রশ্ন এখানে খুব স্বাভাবিকভাবে উঠতে পারে । ভারতীয় স্থাপত্য ও ভাস্কর্য তো খুব সুপ্রাচীন। তবে আগেকার যুগের ভাস্কর্যে মিথন মূর্তি না দেখিয়ে, হঠাৎ দশম একাদশ শতাব্দীর মন্দিরগুলিতে তার প্রথম আবির্ভাব ঘটল কেন ? মিথন মূর্তিগুলি যদি তান্ত্রিক ধর্মের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট হয়, তা হলে এর ব্যাখ্যা খুবই সহজ । তান্ত্রিক সাধনসদৃশ ধৰ্মপদ্ধতি পূর্ব ভারতের জনগণের মধ্যে প্ৰাক-বৈদিক কাল হতে প্রচলিত ছিল । এর সাধন পদ্ধতি অতি গূঢ় বলে, এটা সুপ্ত অবস্থায় গোপনভাবে গুরুশিষ্য পরম্পরায় লুক্কায়িত ছিল। জনপ্রিয়তা লাভের জন্য বৌদ্ধ মহাযানীদের মধ্যেই তান্ত্রিক ক্রিয়াকাণ্ডের অনুপ্ৰবেশ ঘটে। এর ফলে বজ্ৰযান নামে এক নূতন যানের সৃষ্টি হয়। বজ্রযানকে সহজযান বা সহজিয়া ধৰ্মও বলা হত । যাঁরা সহজপথে যান, তাদের আর জন্মমৃত্যুর আবর্তের মধ্যে ফিরে আসতে হয় না। এই বৌদ্ধ চিন্তাধারাই আমরা চর্যাপদ-সমূহের মধ্যে লক্ষ্য করি। দেহই হচ্ছে এ সাধনার অবলম্বন ৷ দেহভাণ্ডই হচ্ছে ক্ষুদ্রাকৃতি ব্ৰহ্মাণ্ড । মহাসুখের মধ্যে চিত্তের নিঃশেষ নিমজ্জনই হল পরম নির্বাণ । বৌদ্ধরা যখন তন্ত্রের গূহ্যসাধন পদ্ধতি প্ৰকাশ করে দিল, হিন্দুরা তখন আর চুপ করে বসে রইল না। তারাও এই লোকায়ত গৃহসাধনা সম্বন্ধে গ্ৰন্থরচনায় প্ৰবৃত্ত হল। পালরাজগণের পৃষ্ঠপোষকতায় ও সিদ্ধাচার্যদের সক্রিয় প্রভাবেই বৌদ্ধ বজ্রযান ধৰ্ম জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। সে জন্যই পালরাজগণের পূর্বের মন্দির ভাস্কর্যে আমরা মিথুন মূর্তির অভাব দেখি ।
।। আট ।।
অনেকে বলেন যে মাত্র রমণমূর্তিগুলির মাধ্যমেই যে সৃষ্টিতত্ত্ব (Cosmic principle ) বুঝানো হয়েছে, তা নয়। মন্দিরগুলোও স্ত্রী-পুরুষ রমণের প্রতীক । এসন্মন্ধে হেগেলই প্রথম মতবাদ প্রকাশ করেন যে শিখর বিশিষ্ট মন্দিরগুলো হচ্ছে পুংলিঙ্গের প্রতীক। তঁাকে সমর্থন করেন হারবাট রীড । আমার সহাধ্যায়ী বন্ধুবর প্রয়াত অধ্যাপক নির্মলকুমার বসু মন্দির নির্মাণ সন্মন্ধে ওড়িয়া ভাষায় রচিত শিল্পশাস্ত্ৰ সমূহ গভীর ভাবে অধ্যয়ন করেছিলেন। তারই ফলশ্রুতি হচ্ছে তার ‘ক্যাননস্ অভ্ ওড়িশান আরকিটেকচার’ । তিনিও ওই একই মত পোষণ করেন। ওড়িশার মন্দিরগুলির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে ‘রেখা।’ রীতিতে গঠিত একটি মূল শিখর মন্দিরের সামনের দিকে সংযুক্ত করা হয় ‘ভদ্র’ রীতিতে গঠিত আর একটি মন্দির, যেন গাঁটছড়া বাঁধা হয়েছে নববধূর শাড়ীর সঙ্গে বরের বসনের। শিল্পশাস্ত্রে বলা হয়েছে যে ‘রেখ’ পুরুষ, ‘ভদ্র’ নারী। তাদের সংযোগ যৌনসঙ্গমের প্রতীক । যে অলিন্দপথ ভদ্রাকে রেখ-এর জঙ্ঘার সঙ্গে সংযুক্ত করছে তা হচ্ছে স্ত্রীযোনির প্রতীক। এখানে স্মরণীয় যে মূল মন্দিরের প্রধানতম অংশকে ‘গৰ্ভ’ বলা হয় ।
এই আলোচনার পর এই কথাই বলতে চাই যে মন্দির গাত্রের মৈথুনমূতিগুলি অশ্লীল মানসিকতার পরিচায়ক নয়। রূপের পূজারী শিল্পী মন্দিরগাত্রে এসকল মূর্তি গঠন করে যে মাত্র সৃষ্টিতত্ত্বই বুঝাতে চেয়েছেন তা নয় ; জীবনরসের প্রবাহ ঢেলে স্বৰ্গ-মর্ত্য একসূত্ৰে গ্ৰন্থণাও করে গেছেন ।
বেদ-পুরাণ এর ইতিবৃত্ত
এই পুস্তকের প্রবন্ধসমূহ বেদ-পুরাণের ভিত্তিতে রচিত। সেজন্য পাঠকদের বেদ পুরাণ সম্বন্ধে একটা ধারণা থাকা উচিৎ। সেই কারণে বেদ-পুরাণ সম্বন্ধে এখানে কিছু বলছি। নিষ্ঠাবান হিন্দুসমাজের কাছে বেদ-পুরাণ অপেক্ষা পবিত্র জিনিষ আর কিছু নেই। পুরাণগুলি পরে লেখা হয়েছিল, বেদই সকলের আগে রচিত। কিন্তু হিন্দুদের বিশ্বাস বেদ রচিত গ্ৰন্থ নয়, ঋষিগণ কর্তৃক দৃষ্ট বা শ্রুত । সেজন্য বেদকে শ্রুতি বলা হয় । সে যাই হোক, বেদই হচ্ছে মানবজাতির সবচেয়ে প্রাচীন গ্ৰন্থ। মোক্ষমূলর (Maximuller ) তাঁর ঋগ্বেদের অনুবাদের প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় বলেছেন যে বেদ হচ্ছে–“the most ancient books in the library of mankind.”
বেদ সংখ্যায় চারটি — ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুৰ্বেদ ও অথর্ববেদ । এদের মধ্যে ঋগ্বেদই প্ৰধান ও সবচেয়ে প্ৰাচীন । ঋগ্বেদ দশটি মণ্ডলে বিভক্ত । প্রত্যেক মণ্ডলে অনেকগুলি করে সূক্ত আছে। প্রতি সূক্ত আবার অনেকগুলি ঋক বা মন্ত্র নিয়ে রচিত । প্ৰতি সূক্ত হচ্ছে এক বা একাধিক দেবতার উদ্দেশ্যে রচিত স্তুতি ।