।। তিন ।।
যৌন মিলনের মাধ্যমে সৃষ্টিকে সংরক্ষিত করবার জন্য আমরা ঋগ্বেদের ঋষিদের পরম ব্যাকুলতা লক্ষ্য করি। এই মিলনে যারা ব্যাঘাত ঘটায় তাদের বিনাশ সম্বন্ধে ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ১৬২ সূক্তে বলা হয়েছে—“যে তোমার যোনি আক্রমণ করে, অগ্নি তাকে বিনাশ করুন। পুরুষের শুক্র সঞ্চারকালেই হােক অথবা গৰ্ভমধ্যে আন্দোলিত হবার কালেই হােক অথবা ভূমিষ্ঠ হবার সময় হােক, তোমার গর্ভকে যে নষ্ট করে বা নষ্ট করতে ইচ্ছা করে, তাকে আমরা এখান হতে দূরীভূত করলাম। গর্ভ নষ্ট করবার জন্য যে তোমার দুই উরু বিশ্লেষিত করে দেয়, অথবা যে ওই উদ্দেশ্যে স্ত্রী-পুরুষের মধ্যস্থলে শয়ন করে অথবা যে যোনির মধ্যে বিপতিক পুরুষ শুক্ৰকে লেহন করে, তাকে এখান হতে দূরীভূত করলাম।” ( ঋগ্বেদ ১।১৬২৷১-৬ )।
বিংশ শতাব্দীর উন্নত নাসিকা বিশিষ্ট মানসিকতার দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে যারা কপটভানের সঙ্গে মন্দির গাত্রের মিথন মূর্তি বা দৃশ্যগুলিকে অশ্লীল বলে ঘোষণা করেন, তাদের মনে রাখা উচিৎ যে তাদের পিতামাতার এই অশ্লীল কৰ্মদ্বারাই তারা ইহজগতের মুখ দেখতে পেয়েছেন । হিন্দুর সবচেয়ে প্রাচীন গ্ৰন্থ ঋগ্বেদে এ সম্বন্ধে কোন কপটতার ভান নেই। প্ৰথম মণ্ডলের ১৬৪ সূক্তে বলা হয়েছে–‘মাতা পৃথিবী বৃষ্টির জন্য পিতা দ্যুলোককে কৰ্মদ্বারা ভজনা করেন । তার পূর্বেই পিতা মনে মনে এর সাথে সঙ্গত হয়েছিলেন এবং বিবিধ শস্য উৎপাদন হেতু পরস্পর পরস্পরের কথাবার্তা বলেছিলেন । (ঋগ্বেদ ১।১৬৪।৮) । বস্তুতঃ মৈথুন ক্রিয়াটা হিন্দুদের ধর্মচিন্তায় biology-র এক পরম সত্যের অভিব্যক্তি । সেজন্য প্ৰাচীন ঋষিরা কথায় কথায় মৈথুনক্রিয়ার কথা বলতে লজ্জা বা সঙ্কোচ বোধ করতেন না । যেমন, বৃহদারণ্যক উপনিষদে অরণীর সাহায্যে অগ্নি উৎপাদন মিথুন ক্রিয়ার সঙ্গে তুলিত হয়েছে। (৬।৪।২২) । বস্তুতঃ দেবায়তনে মিথুন মূর্তি প্ৰদৰ্শন যদি অশ্লীল ব্যাপার হয়, তা হলে তার চেয়ে কতগুণ অশ্লীল ছিল অশ্বমেধ যজ্ঞে সর্বসমক্ষে প্ৰধান রাজমহিষীর অশ্বের সঙ্গে মৈথােন ক্রিয়ায় রত হওয়া বা প্ৰধান পুরোহিতের সঙ্গে সঙ্গত হওয়া ?
।। চার ।।
খুব যুক্তিযুক্ত কারণে অনেকে অনুমান করেছেন যে মন্দির গাত্রের এই সকল মিথন মূর্তির সঙ্গে তান্ত্রিক ধর্মের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বা প্রভাব ছিল। সকলেরই জানা আছে যে নারী সঙ্গমই তান্ত্রিক সাধনার ভিত্তি । বস্তুতঃ তন্ত্রগ্রন্থসমূহে বলা হয়েছে যে মৈথন ছাড়া কুলপূজা হয় না । তান্ত্রিক সাধনায় মৈথুন কামমাৰ্গ নয়, জ্ঞানমােগ । তন্ত্ৰমতে নারীর দুই স্বরূপ কামিনী ও জননী–একই। গোড়াতে প্ৰকৃতি কামিনী, সৃষ্টিতে সম্ভোগার্থে তার সার্থকতা । তারপর যখন সৃষ্টি হয়ে গেল, সেই সৃষ্ট জীবের অসহায় ও দুর্বল অবস্থায় তার লালন পালন ও বৃদ্ধির জন্যই তো জননী ভাব ! তান্ত্রিক সাধনায় রাত্রিকালে সাধক ‘আমি শিব’” ( ‘ধ্যাত্বা শিবোহমত্তি’ ) এইরূপে ভাবতে ভাবতে নগ্ন অবস্থায় নগ্ন রমণী রমন করত ( ‘ততো নগ্নাং স্ক্রিয়াং নগ্নং রমণ ক্লেদ যুতোহপিাবা” ) রাত্রির তৃতীয় প্রহর পর্যন্ত নিজ সাধন কার্যে লিপ্ত থাকে। কুলানির্বতন্ত্র অনুযায়ী এই সাধন প্রক্রিয়া কি, তা এখানে উদ্ধত মূল শ্লোক থেকে বুঝা যাবে।
‘আলিঙ্গনং চুম্বনঞ্চ চ স্তনয়োমর্দন স্তথা।
দর্শনং স্পৰ্শনং যোনিৰ্বিকাশে লিঙ্গঘর্ষণম্।’
( লেখকের ‘হিন্দুসভ্যতার নৃতাত্ত্বিক ভাষা’ গ্রন্থের পৃষ্ঠা ৭১-৮৩ দেখুন ) ৷
।। পাঁচ ।।
পুরীর জগন্নাথের মন্দিরে আমরা তান্ত্রিক প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্য করি। এই মন্দিরের তান্ত্রিক শক্তি হচ্ছেন বিমলা । বিমলা অধিষ্ঠিতা আছেন মাটির তলায় এক মন্দিরে । জগন্নাথ মন্দিরের চত্বর থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে সেখানে যেতে হয় । জগন্নাথের উপাসনা বৈষ্ণব তন্ত্রমতে হয় । আরাধনার সময় পঞ্চ-’ম’কারের বিকল্প হিসাবে মৎস্যের পরিবর্তে হিঙ্গুমিশ্ৰিত সবজী, মাংসের পরিবর্তে ‘আদাপচেদি’, মদ্যের পরিবর্তে কাংস্য-পাত্রে নারিকেলের জল, মুদ্রার পরিবর্তে ‘কান্তি’ (গোধূমচূর্ণ ও শর্করা মিশ্রিত দ্রব্য) ও মৈথুনের পরিবর্তে দেবদাসীর নৃত্য ও অপরিজাতা ফুল উৎসর্গ করা হয়। আসল আমিষ দ্রব্য পুরীর মন্দিরে কখনও প্রবেশ করানো হয় না। কিন্তু বৎসরে একদিন এর ব্যতিক্রম করা হয়। সেদিনটা হচ্ছে মহাষ্টমীর দিন। মাত্র মহাষ্টমীর দিন পুরীর মন্দিরে বিমলার ভোগ রন্ধনের জন্য মৎস্য ব্যবহার করা হয়। যাঁরা মহাষ্টমীর দিন বিমলার ভোগ খেয়েছেন, তঁরা জানেন এটা মাছের পোলাও বিশেষ ।
আমি আগের এক অধ্যায়ে প্রাচীন ভারতে সহােদরা বিবাহের উল্লেখ করেছি। পুরীর মন্দিরে জগন্নাথ সুভদ্রা-বলরাম বিগ্রহত্রয়ের সমাবেশ তারই ইঙ্গিত করে। এই সম্পর্কে আগে উদ্ধৃত কুলচূড়ামণি তন্ত্রের উক্তি স্মরণীয়। সেখানে বলা হয়েছে যে সাধনার সময় যদি অপর নারী পাওয়া না যায়, তা’হলে নিজের কন্যা, নিজের কনিষ্ঠা বা জ্যেষ্ঠ ভগিনী, মাতুলানী, বা বিমাতাকে নিয়ে কুলপূজা করবে।
।। ছয় ।।
পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে যে সব দুঃসাহসিক নারী-পুরুষ মৈথুনের মূর্তি আছে (মন্দিরের ভিতর ক্যামেরা নিয়ে যেতে দেওয়া হয় না বলে ) সে সব মূর্তির ছবি এখনও ছাপা হয় নি। সে গুলো দেখলেই বুঝতে পারা যাবে যে এক সময় শ্ৰীক্ষেত্র তান্ত্রিক সাধনারই এক পীঠস্থান ছিল । তবে পুরীর মন্দিরের মৈথুন মূর্তিগুলি সম্বন্ধে একটি বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটেছে। সত্তর বছর আগে ওই মূর্তিগুলি আমি যখন প্ৰথম দেখি, তখন ওগুলো নানা রঙে রঞ্জিত ছিল । আজ আর ওগুলোর সে রূপ নেই। শালীনতা রক্ষার খাতিরে ওগুলোকে কলিচুন দিয়ে আবৃত করা হয়েছে ।