বাৎসায়নের ‘কা*সূত্র’ই অবশ্য যৌ*সম্ভোগ সম্পর্কিত শেষ গ্রন্থ নয়। তবে বাৎসায়নের কা*সূত্রেই আছে শেষ কথা । কেননা, বাৎসায়নের পরে যাঁরা কা*শাস্ত্ৰ সম্বন্ধে বই লিখেছিলেন, তাঁরা সবাই বাৎসায়নের ‘কা*সূত্রে’র ওপরই নিজেদের রচনাসমূহ ভিত্তি করেছিলেন । যদিও বাৎসায়নের পরবর্তী লেখকগণ বাৎসায়নের উপরই নির্ভর করেছেন, তা হলেও তাঁরা মৈথুন-ভঙ্গীর (coital postures ) অনেক কাল্পনিক বিবরণ দিয়েছেন । গণনা করে দেখা গিয়েছে যে এ সকল ভঙ্গীর মোট সংখ্যা হচ্ছে ৭২৯ ।
কা*শাস্ত্ৰ সম্বন্ধে পরবর্তীকালে যে অগণিত গ্ৰন্থ লেখা হয়েছিল, তার মধ্যে উল্লেখের দাবী রাখে (১) খ্ৰীষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর শেষে বা নবম শতাব্দীর গোড়াতে কাশ্মীররাজ জয়াপীড়ের মন্ত্রী দামোদর গুপ্তের ‘কুট্টনীমত‘, (২) খ্ৰীষ্টীয় দশম বা একাদশ শতাব্দীতে বৌদ্ধভিক্ষু পদ্মশ্ৰীজ্ঞান রচিত ‘নাগরসর্বস্ব‘, ( ৩) একাদশ শতাব্দীতে রচিত মহাকবি ক্ষেমেন্দ্রের বাৎসায়ন কা*সূত্রের পদ্য অনুবাদ ও ‘সময়মাতৃকা’ নামে বে*শ্যাদের সম্পর্কে একখানা বই, (৪) দ্বাদশ শতাব্দীতে কোক্কোক রচিত ‘রতিরহস্য’, এর অন্যূন চারখানা টীকা আছে, তার মধ্যে কাঞ্চীনাথের টীকাই প্ৰসিদ্ধ, (৫) চতুৰ্দশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মিথিলার জ্যোতিরীশ্বর কবিশেখর রচিত ‘পঞ্চ সায়ক’, (৬) পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষে বা ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে জৌনপুরের কল্যাণমল্লর ‘অনঙ্গরঙ্গ’, এখানা ফার্সী, উর্দু, ইংরাজী, ফরাসী ও জার্মান ভাষায় অনুদিত হয়েছে ; (৭) ষোড়শ শতাব্দীতে বিজয়নগরের রাজা ইম্মাদি প্ৰৌঢ়দেবরায়ের ‘রতিরত্নদীপিকা’, (৮) সপ্তদশ শতাব্দীতে বিকানীরের রাজা অনুপসিংহের সভাকবি ব্যাসজনার্দনের ‘কা/মাগ্রাবোধ’ । এ ছাড়া, এ সময় আরও রচিত হয়েছিল অনন্তের ‘কা/মসমূহ’, রুদ্রের ‘স্মরদীপিকা’ হরিহরের ‘শৃঙ্গারদীপিকা’ ও জনৈক জয়দেবের ‘রতিমঞ্জরী’ । অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সভাপণ্ডিত ভারতচন্দ্ৰ ‘রাসমঞ্জুরী’ নামে একখানা কা/মশাস্ত্ৰ বিষয়ক গ্ৰন্থ বাংলা পদ্যে রচনা করেন ।
বাৎসায়নের ‘কা*সূত্ৰ’ নাগরিক সমাজের জন্য লিখিত হয়েছিল । নাগরিক সমাজের লোকেরা কিভাবে তাদের যৌ*জীবনকে সুখময় করে তুলত তারই পরিচয় বইখানাতে পাওয়া যায়। যত রকম পদ্ধতিতে (coital postures ) মানুষ রতিক্রিয়ায় প্রবৃত্ত হতে পারে তার পরিচয় বাৎসায়নের বইয়ে আছে । বাৎসায়ন একটা বিশেষ রকম পদ্ধতিতে রমণের নাম দিয়েছেন ‘ইন্দ্ৰানিক রতি’ । সেখানে বলা হয়েছে যে ইন্দ্ৰানী শচী এই বিশেষ পদ্ধতিতে রতিক্রিয়া করতে ভালবাসতেন । সেজন্যই এর নাম ‘ইন্দ্রানিক রতি’ ।
হিন্দুমন্দিরে মিথুনমূর্তি
ভারতের বিভিন্ন স্থানে মন্দিরগাত্রে কামকলার অনেক নিদর্শন আছে । বহু স্থানে ( যেমন ভুবনেশ্বরের রাজারাণী মন্দিরে) এমন অনেক দুঃসাহসিক ধরণের রমণমূর্তি আছে, যেগুলো দেখলে মনে হবে যে প্ৰাচীনকালের হিন্দুরা মৈথুনক্রিয়ার কৌশলে বিশেষ রকমের acrobats ছিলেন । মৈথুনক্রিয়ার এসকল পদ্ধতি বাৎসায়নের ‘কামসূত্র’-এও বর্ণিত হয়েছে । সুতরাং এগুলো কামকলার যে অসম্ভব বা অবাস্তব পদ্ধতি তা নয় ।
মন্দিরগাত্রে এরূপ খোদিত কামকলার প্রদর্শনে রত নরনারীর মূর্তির কথা উঠলেই আমরা কোনারক, পুরী, ভুবনেশ্বর, খাজুরাহো প্রভৃতি স্থানের মন্দিরের উল্লেখ করে থাকি । কিন্তু এই শ্রেণীর ভাস্কর্যের সংস্থান এত সঙ্কীর্ণ ভৌগলিক গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় । এরকম মূর্তি মহারাষ্ট্রের ইলোরার শৈলমন্দিরে, মহীশূরের হলেবিদে অবস্থিত হরশৈলেশ্বরের মন্দিরে, পশ্চিম, মধ্য ও প্রাচ্য ভারতের বহু স্থানের মন্দিরে লক্ষ্য করা যায় । ১৯২৬ খ্ৰীষ্টাব্দে বারাণসীর দশাশ্বমেধ ঘাটের ওপর অবস্থিত এক নেপালী মন্দিরেও আমি এরূপ ভাস্কৰ্য লক্ষ্য করেছিলাম। বাঙলার মন্দিরের পোড়ামাটির অলংকরণেও এর নিদর্শনের প্রতুলতা কম নয়। এক হাওড়া জেলারই দশটা মন্দিরে মৈথুন অলংকরণ আছে। চব্বিশ পরগণারও অনেকগুলি মন্দিরে আছে। বস্তুতঃ বাঙলার মন্দিরে মিথন দৃশ্যের অলংকরণ অতি প্রাচীন । পাহাড়পুরে অবস্থিত পালযুগের মন্দিরসমূহের মিথবুনমূতিগুলি দেখলেই এটা বুঝতে পারা যায় ।
।। দুই ।।
স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে যে দেবতার মন্দিরে মিথন দৃশ্যের বিদ্যমানতার কারণ কি ? এটা বিংশশতাব্দীর শেষপাদের দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে আমরা বুঝতে পারব না। আপাতদৃষ্টিতে মূর্তি বা দৃশ্যগুলির মধ্যে আমরা অশ্লীলতারই গন্ধ পাব ; কিন্তু ঋগ্বেদ থেকে আরম্ভ করে। পরবর্তীকালের সাহিত্য পড়লে আমরা বুঝতে পারব যে হিন্দুর কাছে সৃষ্টিই ছিল সবচেয়ে বড় ধর্ম । যে কর্মের মাধ্যমে যে ধর্ম পালিত হত, মিথন মূর্তিগুলি তারই সজীব প্রতীক মাত্র। প্রজাপতি ব্ৰহ্মাই প্ৰথম প্রজা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। তাঁর অন্তরের মধ্যেই ছিল সৃজন শক্তির উৎস। সেজন্যই তিনি দ্বিধাগ্ৰস্থ হয়ে গিয়েছিলেন সেই সুপ্ত শক্তিকে সঙ্গিনী হিসাবে পাবার জন্য। এক কথায় পুরুষ প্ৰকৃতির সঙ্গে মিলিত হতে চেয়েছিলেন। ইহজগতে নারী ও পুরুষের মিলন, সেই বৃহত্তম মিলনেরই প্রতীক। এই মিলনের মধ্যেই আছে সৃষ্টি, কামনার নিবৃত্তি ও সুখ দুঃখের বন্ধন থেকে মুক্তি । ( বৃহদারণ্যক উপনিষদ ১।৪।৪-৮) ।