।। দুই ।।
যদিও পুরাণে একমাত্র কণ্ডুকেই ‘মৈথুন দক্ষ’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল তা হলেও প্ৰাচীনকালে আরও অনেকেই এই অভীধার দাবী রাখতেন। আমরা আগেই দেখেছি যে অগস্ত্য মুনি যখন লোপামুদ্রাকে স্ত্রীরূপে গ্ৰহণ করেছিলেন, তখন তিনি লোপামুদ্রাকে সম্বোধন করে বলেছিলেন “প্রিয়ে! তোমার অভিলাষ আমাকে বল, তুমি আমার দ্বারা কতগুলি সন্তানের জননী হতে চাও, একটি, না একশত, না এক সহস্ৰ ?” আমরা আবার দেখছি পুরু যখন পিতা যযাতির জরা গ্ৰহণ করে পিতাকে যৌবন দিয়েছিল তখন যযাতি এক হাজার বৎসর ইন্দ্ৰীয় সম্ভোগের পর পুনরায় পুত্র পুরুকে তার যৌবন ফিরিয়ে দিয়েছিল।
শ্ৰীকৃষ্ণের ষোল হাজার স্ত্রীর কথাও তো শুনেছেন ? তবে যা শুনেছেন, তার মধ্যে একটু ভুল আছে। সংখ্যাটা ষোল হাজার নয়। পুরাণ অনুযায়ী ষোল হাজার একশত। এ সম্মন্ধে লোকের আরও একটা ভুল বিশ্বাস আছে। লোকের ধারণা এরা সব গোপবালা ছিল। তা নয় । সকলেই নানাদেশ থেকে অপহৃত (abducted ) মেয়ে ছিল। (‘তাঃ কন্যা নরকেণাসন সর্বতে যা সমাহৃতাঃ”, বিষ্ণুপুরাণ ৫।৩১৷১৪ ) । পুরাণে লিখিত আছে যে একই সময়ে পৃথক পৃথক ভাবে গোবিন্দ সেই সকল কন্যার ধর্মানুসারে বিধি অনুযায়ী পাণিগ্রহণ করেছিলেন, যাতে সেই সকল কন্যাগণ প্ৰত্যেকে মনে করেছিল যে শ্ৰীকৃষ্ণ মাত্র তাকেই বিবাহ করলেন । তা ছাড়া, প্ৰতিরাত্রেই তিনি তাঁদের প্রত্যেকের ঘরে গমনপূর্বক বাস করতেন । ( “নিশাসু চ জগৎস্রষ্টা তাসাং গেহেষু কেশবঃ” )
।। তিন ।।
প্ৰাচীনকালের এ সকল ব্যক্তির কথা পড়লে মনে হবে যে তারা সব যৌন শক্তিধর বা Sexual athlete ছিলেন। মৈথুন ধর্মটাই সেকালের সনাতন ধর্ম ছিল । কেননা মনু ও শতরূপা যখন ব্ৰহ্মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল–“পিতঃ কোন কর্মের দ্বারা আমরা আপনার যথোচিত সেবা করব ?” ব্ৰহ্মা বলেছিলেন—“তোমরা মৈথুন কর্মদ্বারা প্ৰজা উৎপাদন কর। তাতেই আমার তুষ্টি।” পরবর্তীকালে এটাই “পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভাৰ্যা”–এই বচনে প্ৰকাশ পেয়েছিল। এটাই বায়োলজির পরম সত্য ।
হিন্দুদের কা/মশাস্ত্ৰ
যৌ*মিলন নিয়ে অনুশীলন ভারতে অতি প্ৰাচীনকাল থেকে অনুসৃত হয়েছে। এরূপ অনুশীলনমূলক গ্রন্থগুলিকে কা/মশাস্ত্র বলা হত । রতিসম্ভোগের প্রয়োজনীয়তার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের ১৭৯ সুক্তে ! তবে কা/মশাস্ত্ৰ সম্বন্ধে অনুশীলনেরও উল্লেখ পাওয়া যায় বৃহদারণ্যক উপনিষদে (৬।২৷১২-১৩ ; ৬।৪।২-২৮ )। সেখানে খোলাখুলিভাবে বলা হয়েছে যে রমণের সময় যদি নারীর কামোদ্রেক করাতে চাও, তা হলে যোনির ওষ্ঠপৃষ্ঠ জিহবা দ্বারা লেহন করবে । (৬।৪।৯) । পরবর্তীকালে বাৎসায়নের কা*সূত্রই প্রসিদ্ধি লাভ করে। কিন্তু বাৎসায়নের উক্তি থেকে আমরা বুঝতে পারি যে বাৎসায়নের পূর্বে বহু আচাৰ্যই এ সম্বন্ধে অনুশীলন করেছিলেন। বাৎসায়ন বলেছেন– ‘প্রজাপতি প্ৰজা সৃষ্টি করবার পর, তাদের রক্ষার জন্য ত্ৰিবর্গ (ধর্ম, অর্থ, কা/ম ) সাধনের জন্য লক্ষ অধ্যায়ে এক শাস্ত্র উপদেশ দেন । তারই একাংশ অবলম্বন করে স্বায়ম্ভুব মনু ধর্মশাস্ত্র রচনা করেন । আর এক অংশ অবলম্বন করে বৃহস্পতি অর্থশাস্ত্র রচনা করেন । অন্য এক অংশ অবলম্বন করে মহাদেবের অনুচর নন্দী এক হাজার অধ্যায়ে কা/মশাস্ত্র রচনা করেন। পরে উদ্দালক পুত্র শ্বেতকেতু তাকে ৫০০ অধ্যায়ে সংক্ষেপিত করেন । তারপর পাঞ্চালাদেশীয় আচাৰ্য বাভ্রব্য আরও সংক্ষিপ্ত একটা গ্রন্থ রচনা করেন । এতে সাতটা অধিকরণ ও ১৫৯ অধ্যায় ছিল । পরে এক একটা অধিকরণ নিয়ে এক একজন আচাৰ্য বিভিন্ন বিষয়ে কা/মশাস্ত্র রচনা করেন । যথা, দত্তকাচাৰ্য পাটলিপুত্রের বারযোষিতদের নিয়ে বৈশিক অধিকরণ রচনা করেন, গোর্নদীয় ভাৰ্যাধিকারিক, গোনিকাপুত্র পারদারিক, সুবৰ্ণাভ সাম্প্রোয়াগিক, ও কুচুমার ঔপনিষদিক অধিকরণ সম্পর্কে স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেন।’ বাৎসায়ন তারপর বলছেন ‘বহু আচাৰ্য কর্তৃক কা/মশাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয় সন্মন্ধে বহু খণ্ড খণ্ড গ্ৰন্থ রচনার ফলে, সমগ্ৰ কা/মশাস্ত্ৰ নষ্ট হবার উপক্রম হয়েছিল। দত্তকাচাৰ্য, গোর্নদীয়, গোনিকাপুত্র, সুবৰ্ণাভ, কুচুমার প্রভৃতি আচার্যগণ কর্তৃক রচিত গ্রন্থগুলি কা/মশাস্ত্রের এক এক বিশেষ বিষয় সম্পর্কে রচিত হয়েছিল, আর বাভ্রব্য রচিত গ্ৰন্থখানি আকারে বিশাল বলে সাধারণের পক্ষে তা পাঠ করা দুঃসাধ্য ছিল। সেজন্য পূর্বসূরীদের এই সকল গ্ৰন্থ অবলম্বন করে স্বল্প আয়তনের মধ্যে ‘কা*সূত্র’ রচিত হল ।’ এই হচ্ছে বাৎসায়নের কা*সূত্র রচনার ইতিহাস। বাৎসায়নের ‘কা*সূত্র’ খানি ঠিক কবে রচিত হয়েছিল, তা আমাদের জানা নেই। তবে পণ্ডিতগণ অনুমান করেন যে এখানা খৃষ্টজন্মের এদিক-ওদিকে দুই-এক শতাব্দীর মধ্যে রচিত হয়েছিল। উপরে উদ্ধৃত বাৎসায়নের উক্তি থেকে এটা পরিষ্কার বুঝতে পারা যায় যে বাৎসায়নের সময় পর্যন্ত বাভ্রব্য রচিত বৃহৎ গ্ৰন্থখানিই কা/মশাস্ত্ৰ সম্বন্ধে একমাত্র প্রামাণিক গ্ৰন্থ ছিল । বাৎসায়নই বাভ্রব্যের লুপ্তপ্রায় গ্ৰন্থখানির সার সংগ্রহ করে সূত্রকারে ‘কা*সূত্র’ রচনা করেন । বাৎসায়নের প্রকৃত নাম ছিল মল্লনাগ । পরবর্তীকালে বাৎসায়নের গ্ৰন্থখানাই প্ৰাচীন ভারতের কা/মশাস্ত্রের সবচেয়ে প্রামাণ্য গ্ৰন্থ বলে স্বীকৃতি লাভ করে। এখানা ৩৬টি অধ্যায়ে, ৬৪ প্রকরণে ও সাত অধিকরণে বিন্যস্ত । সমগ্র বইখানির শ্লোক সংখ্যা হচ্ছে ১১২৫ ৷৷ বাৎসায়ন রচিত গ্রন্থের অনেকগুলি টীকা রচিত হয়েছিল। তন্মধ্যে যশোধরের ‘জয়মঙ্গলা” টীকাই প্ৰসিদ্ধ।